দিশাহারা বিএনপি ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক সার্কাস

বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ২০০৭ সাল থেকে ক্ষমতার বাইরে। ২০০৭ আর ২০০৮-এ অবৈধভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে ছিল একটি অসাংবিধানিক সেনা সমর্থিত বেসামরিক গোষ্ঠী, যারা এসেছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামে। সাংবিধানিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ হওয়ার কথা ৯০ দিন এবং এই সময়ের মধ্যে তাদের একমাত্র কাজ একটি সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে নিজ থেকেই বাতিল হয়ে যাওয়া। তবে ২০০৭ সালে গঠিত সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা ছাড়া আর সব কিছুই করেছে।

ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতাদের কারাবন্দি করা, কোনো কিছুই বাদ যায়নি। শেষতক একটি গণবিক্ষোভের মুখে তারা ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। সেই নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ভূমিধস বিজয় অর্জন করে। ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। সেই থেকে বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে। যে দলটির জন্ম ক্ষমতায় থেকে, সেই দলটির এত দীর্ঘ সময় রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে থাকা দলের নেতাকর্মীদের কাছে শুধু অসহনীয়ই নয়, চরম হতাশাব্যঞ্জক। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জেনারেল জিয়া ক্ষমতা দখল করে সেনা গোয়েন্দা সংস্থার কতিপয় সদস্যকে ব্যবহার করে বিএনপি গঠন করেছিলেন। দলটির স্বাভাবিক জন্ম হয়নি। বর্তমানে দলটি অনেকটা দিশাহারা ও বিপর্যস্ত। আবার এরই মধ্যে দেশের সর্বোচ্চ আদালত ২০১২ সালে সংবিধানে সন্নিবেশিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে দিয়েছেন। এ বিষয়ে রায়ে মহামান্য আদালত পরিষ্কার মন্তব্য করেছেন, একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় এক মিনিটের জন্যও রাষ্ট্রের ক্ষমতা কোনো অনির্বাচিত দল বা ব্যক্তির কাছে যাওয়া গ্রহণযোগ্য নয়। অন্য দুটি পৃথক মামলায় সব সময়ের জন্য দেশে সামরিক আইন জারি বেআইনি ঘোষণা করা হয়েছে।

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দুর্নীতির মামলায় উচ্চ আদালতে দণ্ডিত হয়েছেন। শেখ হাসিনার বদান্যে তিনি বর্তমানে নিজ গৃহে অবস্থান করে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাঁকে আবার কারাগারে যেতে হতে পারে। তাঁর ছেলে তারেক রহমান মানি লন্ডারিং থেকে শুরু করে অস্ত্র চোরাচালান ও হত্যা মামলায় দণ্ডিত হয়ে বর্তমানে লন্ডনে পলাতক জীবন যাপন করছেন। তিনি আবার দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন। তিনি কয়েক বছর আগে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছেন। ব্রিটেনে রাজনৈতিক আশ্রয়ে আছেন। তিনি সেখান থেকে ভার্চুয়ালি অহি পাঠিয়ে দেশে দল পরিচালনা করেন। দেশে নিত্যদিন দলের কয়েকজন নেতা মূলত জাতীয় প্রেস ক্লাবে ও এর সামনের রাস্তায় বা মাঝেমধ্যে কোনো জেলায় গিয়ে নিধিরাম সর্দারের মতো ২০২৩ বা ২০২৪-এ অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে গলাবাজি করেন। সঙ্গে থাকে কিছু ওয়ানম্যান পার্টির নেতা। এরই মধ্যে বিএনপির একজন বড়মাপের স্বঘোষিত উপদেষ্টা লন্ডনে গিয়ে তারেক রহমানের সঙ্গে মোলাকাত করেছেন। জেনে নিয়েছেন আগামী নির্বাচনে কী উপায়ে বর্তমান সরকারকে উত্খাত করা যায়। বলেছেন, বাংলাদেশে ‘গণতন্ত্রকে হত্যা’ করার জন্য ভারত দায়ী। এমনটা যদি হয়, তারেক রহমান হয়তো স্বপ্ন দেখছেন তিনি দেশে ফিরে ছলে-বলে-কৌশলে সব মামলা থেকে অব্যাহতি নিয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী হবেন এবং মাকে বানাবেন রাষ্ট্রপতি।

কিছুদিন ধরে বিএনপি ও তার মিত্র তাঁবেদাররা এই বলে জিকির তুলেছে যে আগামী নির্বাচন কিছুতেই তারা বর্তমান সরকারের অধীনে হতে দেবে না। কখনো বলে, অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে হবে; কখনো বলে, নির্দলীয় সরকারের অধীনে হতে হবে। আবার মত পাল্টে জাতীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের স্বপ্ন দেখে। কিন্তু বলে না, এসব বায়বীয় সরকার কিভাবে গঠিত হবে, কারা থাকবে এসব সরকারে।

পাঠকদের নিশ্চয় মনে আছে, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপি আর তার সমমনা দলগুলো মিলে জিকির তুলেছিল দেশের সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক বাতিল ঘোষিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ছাড়া কোনো নির্বাচনে তারা যাবে না, নির্বাচন হতেও দেবে না। তখন খালেদা জিয়াসহ সংসদে একাধিক বিএনপিদলীয় সদস্য ছিলেন। শেখ হাসিনা খালেদা জিয়াকে আহবান জানিয়ে বললেন, নির্বাচনকালে সংসদ সদস্যদের নিয়ে একটি জাতীয় সরকার গঠিত হবে এবং বিএনপি যতসংখ্যক মন্ত্রিসভার সদস্য চাইবে, তা তাদের দেওয়া হবে। প্রয়োজনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও তাদের দেওয়া হবে। খালেদা জিয়া এই প্রস্তাব শুধু ফিরিয়েই দিয়েছিলেন। বিএনপি তার তথাকথিত দাবি আদায়ের নামে দেশে শুরু করল ভয়াবহ অগ্নিসন্ত্রাস। খালেদা জিয়া এই সন্ত্রাস পরিচালনা করার জন্য তাঁর গুলশানের দপ্তরে স্থাপন করলেন নিজস্ব কমান্ড পোস্ট। সেই সন্ত্রাসে তিন শর বেশি নিরীহ মানুষ প্রাণ হারাল। আগুনে ঝলসে গেল অসংখ্য মানুষ। সরকার ও জনগণের সম্পদের হানি হলো কয়েক শ কোটি টাকার। কিন্তু নিজের লক্ষ্য ও সংবিধানের বাধ্যবাধকতা সমুন্নত রাখতে অবিচল ছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। শেষ পর্যন্ত ২০১৪ সালের ৪ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যা বিএনপি ও তার দোসররা বর্জন করে।

২০১৮ সালের নির্বাচনে মনে হচ্ছিল, ২০১৪ সালের নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি হবে। কিন্তু ২০১৪ সালের পরিণতি দেখে বিএনপি কৌশল পরিবর্তন করে। নির্বাচন মানেই মনোনয়ন বাণিজ্য আর সেই বাণিজ্যের বেশির ভাগ লাভ কার ঘরে যায়, তা সবার জানা। আগে থেকে বিএনপির একটি ২০ দলীয় জোট তো ছিলই; কিন্তু সেই জোটে সঠিক নেতৃত্ব দেওয়ার মতো তেমন কেউ ছিলেন না। ২০১৮ সালের ১৩ অক্টোবর গণফোরামের নেতা কামাল হোসেনকে আহ্বায়ক করে বিএনপি গঠন করে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। কথা ছিল, এই ফ্রন্টে জামায়াতের কোনো সদস্য থাকবেন না। আর ২০১৮ সালে অনুষ্ঠেয় সংসদ নির্বাচনে তাদের কোনো প্রার্থীও থাকবেন না। মনোনয়নের সময় ড. কামাল হোসেনকে ফাঁকি দিয়ে জামায়াতের ১২ জন প্রার্থী ফ্রন্ট থেকে মনোনয়ন পান। মনোনয়ন বাণিজ্য এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে একই নির্বাচনী এলাকায় একাধিক প্রার্থীকে পর্যন্ত মনোনয়ন দেওয়া হয়। হাজার কোটি টাকা লন্ডনে পৌঁছে যায়। অনেকে আবার লন্ডনে গিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসনের সঙ্গে দেখা করে নিজের মনোনয়নটা নিশ্চিত করে আসেন। নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসে, ততই সাধারণ ভোটাররা তাঁদের নির্বাচনী এলাকায় ফ্রন্টের প্রার্থী নিয়ে বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে যান। তাঁদের না ছিল কোনো পোস্টার, না ছিল কোনো কর্মী। আমি নিজে দুপুর ১২টায় ভোট দিতে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানলাম কেন্দ্রে ধানের শীষের কোনো এজেন্ট নেই। অথচ ওই কেন্দ্রে জেলার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন বিএনপি নেতা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিলেন। ওই নির্বাচনের ফল যা হওয়ার তা-ই হয়েছিল। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল নির্বাচিত হয়েছিলেন। দলের প্রভুর নির্দেশে সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেওয়া থেকে বিরত থাকেন। সংসদে থাকলে তিনি যে ভূমিকা রাখতে পারতেন সেই ভূমিকা জাতীয় প্রেস ক্লাবে দিনরাত চিৎকার করলেও রাখতে পারবেন না।

সরকার গঠন করলে কী করবে, কয়েক দিন আগে বিএনপি তার একটি নতুন ফর্মুলা দিয়েছে। বলেছে, তাদের চলমান শেখ হাসিনা হটাও কর্মসূচিতে যেসব দল বা ব্যক্তি অংশ নেবেন, তারা সরকার গঠন করলে তাঁদের নিয়ে সরকার গঠন করবে। জামায়াত বা হিযবুত তাহ্রীর থাকলেও আপত্তি নেই। তারেক রহমান তো অনেক আগেই বলেছেন, জামায়াত আর বিএনপি মায়ের পেটের ভাই। ভাইকে ফেলে ক্ষমতা ভোগ করে কিভাবে? আবার এই ফর্মুলার সঙ্গে ২০ দলের সবাই একমত নয়। অনেকের মতে জগাখিচুড়ি মার্কা সরকার বেশি দূর যেতে পারে না। পাকিস্তান তার উজ্জ্বল উদাহরণ।

অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগও যে খুব ভালো অবস্থানে নেই। গত দুই বছরে দলের ভেতর যেসংখ্যক উইপোকা ঢুকেছে, তা চিন্তা করলে আতঙ্কিত হতে হয়। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে কোনো কোনো এলাকায় এই নবাগত উইপোকারা বক্তব্য দেওয়ার সময় শেখ হাসিনা জননেত্রী, না দেশনেত্রী, তা-ও ভুলে যায়। এমনও ঘটেছে যে কয়েকজন ভুলেই গেছে তাদের নেতা শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া নন। সম্প্রতি জাতীয় মসজিদের খতিব নিয়োগ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। উদ্ধৃতি দেওয়া হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র, যেখানে তিনি লিখেছেন এই নবনিযুক্ত খতিবের বাবা তাঁর বিরুদ্ধে কী কী ফতোয়া দিয়েছিলেন। গোপালগঞ্জ বা ফরিদপুরে জন্মগ্রহণ করলেই সবাই আওয়ামী লীগের ভাবধারার মানুষ হবে, তা নয়। শেখ হাসিনাকে হত্যা করার জন্য যিনি একাধিকবার চেষ্টা করেছিলেন, সেই মুফতি হান্নানও গোপালগঞ্জের মানুষ। এই খতিব নিয়োগের ব্যাপারে নিশ্চয়ই কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সুপারিশ ছিল। তারা কারা, তা খুঁজে বের করা কি খুব কঠিন?

বঙ্গবন্ধুর ধারেকাছে গুটিকয়েক খন্দকার মোশতাক ছিলেন। এখন তাঁদের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বেড়েছে। সময় থাকতে সাবধান না হলে সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে।

লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ