দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা দায় এড়াতে পারেন না

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্কঃ

রাজধানীর উত্তরায় নির্মীয়মাণ ফ্লাইওভারের গার্ডারে চাপা পড়ে পাঁচজনের মৃত্যুর ঘটনায় আমি খুবই মর্মাহত। কয়েকজন মানুষ নির্মমভাবে মারা গেছেন—আমি শুধু এ জন্যই মর্মাহত নই। আমি মর্মাহত, এই ঘটনায় একটি সুবিচার পাওয়া যাবে না। কারণ ঘটনাটিতে সংশ্লিষ্ট সরকারি ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি স্তরে যাদের দায় রয়েছে, তা সঠিকভাবে নিরূপণ করা হবে না।

ফলে সঠিক বিচারটা হবে না। শুনলাম এই ঘটনায় একটি নবদম্পতির একটি পরিবার শেষ হয়ে গেছে। এটা অত্যন্ত হৃদয়বিদারক। এই ঘটনায় সরকারের ঝাঁকুনি খাওয়া উচিত। কারণ সরকার পয়সা তো কম দিচ্ছে না।

দেখা গেছে, কাজটিতে শুধু ঝুঁকি মোকাবেলায় অনীহাই দেখানো হয়নি. বরং দুর্ঘটনা-পরবর্তী উদ্ধার কার্যক্রমেরও কোনো প্রস্তুতি ছিল না। যেভাবে কাজটি হচ্ছিল, তা অত্যন্ত দায়সারা গোছের এবং তাতে কোনো ধরনের নিরাপত্তা বাধ্যবাধকতাই (কমপ্লায়েন্স) ছিল না। পরিহাস হচ্ছে, এই দায়সারা ও নিরাপত্তাহীন কাজের শিকার হলেন সড়ক ব্যবহারকারী কয়েকজন নিরীহ ব্যক্তি; দায়িত্বপ্রাপ্তদের কেউ নন। এমন নয় যে এটাই প্রথম ঘটল। অতীতের ঘটনাগুলোতেও কাউকেই দায় নিতে দেখা যায়নি। ফলে একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তির ক্ষেত্র তৈরিই থাকবে হয়তো।

নির্মাণ একটি শিল্প। অতীতের শিক্ষা নিয়েই সারা বিশ্বে শত শত বছর ধরে ঝুঁকি এড়িয়ে এই কাজটি করা হয়। বড় কাজের ক্ষেত্রে দরপত্র থাকে, সেখানে ঝুঁকি এড়ানো এবং দৈবাৎ ঘটনা ঘটলে তার তাত্ক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়গুলো নথিবদ্ধ করা থাকে। কিন্তু এ ঘটনায় প্রতিটি স্তরেই গাফিলতি দেখা যাচ্ছে। ঠিকাদারের দায় অবশ্যই আছে। কিন্তু এটাও অনুধাবন করতে হবে যে তাঁর একটি কর্মাশিয়াল এনটিটি (বাণিজ্যিক সত্তা) আছে। ঝুঁকি মোকাবেলায় যে অর্থটা ব্যয় করতে হবে, সেটা রক্ষা করতে চাইবে। এটাই তাঁর চরিত্র। কিন্তু তাঁর থেকে কাজ আদায় করার দায়িত্বে যাঁরা ছিলেন, বিশেষ করে বাস্তবায়নকারী সরকারি কর্মকর্তারা, তাঁরা কোনোভাবেই দায়টা এড়াতে পারেন না।

অতীতে দেখা গেছে, যখনই কোনো ঘটনা ঘটে এবং সেখানে যেসব কর্তাব্যক্তি ছুটে যান, তাঁরা সেখানে স্রেফ লিপ সার্ভিস বা সাময়িক অঙ্গীকার করার জন্য গিয়েছিলেন। তাঁরা বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে নেননি। যদি নিতেন, তাহলে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতো না। আমরা স্বল্প সময়ের বিরতিতে একই প্রকল্পে ঘটনার পুনরাবৃত্তিটা দেখছি। এর মধ্য দিয়ে একটা উন্নয়ন যন্ত্রণায় পেয়ে বসেছে আমাদের। উন্নয়ন যন্ত্রণায় এবং নির্মাণ ব্যয়ে আমরা এরই মধ্যে বিশ্বরেকর্ড করে ফেলেছি। প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রতায়ও আমরা অনেক বড় রেকর্ড করে ফেলেছি। শুধু এই বিআরটি প্রকল্পেই তিন-তিনটি দুর্ঘটনা। তাই উন্নয়নকাজর দুর্ঘটনার দিক থেকে আমাদের রেকর্ড হয়ে গেছে।

এটা বলা দরকার যে বিআরটি প্রকল্প বিষয়টি খুবই সহজসাধ্য এবং কম সময়সাপেক্ষ। এ জন্যই এটা জনপ্রিয় হয়েছে। কিন্তু আমরা যে কতটা অক্ষম, এই ধরনের ঘটনাগুলো জানান দিচ্ছে। আবার নির্দিষ্ট কোনো প্রকল্পেই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে তা-ও নয়। চট্টগ্রামে ঘটেছে, সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে ঘটেছে, ভাটারায় ঘটেছে; ঘটেই যাচ্ছে। জনবহুল ও ব্যস্ত সড়ক নির্মাণ করার নিরাপত্তা বাধ্যবাধকতা রয়েছে, আমরা সেগুলো প্রতিপালন করি না। দায়টা এড়িয়ে যাই। এর মধ্যে সুশাসনের অভাবটি স্পষ্ট হয়ে পড়ে।

সরকার উন্নয়নের জোয়ার বইয়ে দিচ্ছে। অথচ বারবার ঘটনাগুলোর পুনরাবৃত্তি ঘটছে। এর অর্থ হচ্ছে, পুরো চেইনের মধ্যে গণ্ডগোল আছে। দায় দেওয়ার জন্য শুধু ঠিকাদারনির্ভর চিন্তা করলে চলবে না। ঠিকাদার একটা বাণিজ্যিক সত্তা, তিনি সুযোগসন্ধানী। তাঁর মুনাফা মানসিকতা পুরো পৃথিবী জানে। সে জন্য তাঁর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হতে হয়। সে জন্য ঝুঁকি কত আছে এবং ঝুঁকি মোকাবেলায় কত টাকা লাগবে, তা আগেই নির্ধারণ করা হয়। তার পরও তাঁরা পার পাচ্ছেন কেন? কারণ যিনি ঠিকাদারের কাছ থেকে কাজটা আদায় করবেন, তাঁর ওপরের স্তরের জবাবদিহি, নিচের স্তরের জবাবদিহি নেই। এর কারণটি হচ্ছে, তাঁরা সবাই সুবিধাভোগী হয়ে যান। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বিষয়টি নিয়ে ভাবা উচিত। কারণ কিছু লোক সুবিধা নিচ্ছেন এবং আখেরে জনগণ উন্নয়ন যন্ত্রণায় নিষ্পেষিত হচ্ছে।

আমরা দেখি, ঢাকা শহরের রাস্তার পাশে সেবাপ্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করছে; ফুটপাত. ড্রেন উন্নয়নের কাজ চলছে, কিন্তু কোথাও কোনো বেষ্টনী নেই। এতটা ঝুঁকিপূর্ণ, যেকোনো সময় একটা মানুষ পড়ে যেতে পারেন। কিন্তু আমাদের নগরপিতারা কিছুই করছেন না। আসলে সংস্কৃতি এক দিনে তৈরি হয় না। ছোট ছোট কাজেই দেখা যাচ্ছে, কিভাবে একে অন্যের সঙ্গে যোগসাজশ করে কমপ্লায়েন্সগুলো এড়িয়ে যাচ্ছে। চট্টগ্রামে ড্রেন উন্নয়ন করতে গিয়ে কতগুলো হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটল, কিন্তু কেউ দায়িত্বশীল আচরণ করেনি।

এখানে উন্নয়নকাজগুলোতে প্রতিনিয়তই যোগসাজশ বা আপস করতে দেখা যায়। এই জায়গায় সরকারকে এখন অনেক সতর্ক হতে হবে। যেকোনো নির্মাণের প্রথম নীতিই হচ্ছে ‘নিরাপত্তাই প্রথম’। বিশ্বে এই একটাই নীতি সব জায়গায় নেয়। অথচ আমাদের দুর্ঘটনার ভাবটা এমন, যেন এইমাত্র হুঁশ হলেন। তারপর সবাই ঘটনাস্থলে যান, তৎপরতা দেখান, কিছু হুংকার দেন, গর্জন করেন। এতে যেন দায়িত্ব সারা হয়ে যায়।

এই কাজে শুধু বিআরটি প্রকল্প কর্তৃপক্ষই নয়, পুলিশেরও দায়িত্ব ছিল। সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করাটা পুলিশের একটি অর্পিত দায়িত্ব। তাদের অবস্থান হবে কেউ যদি ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে, তাহলে হয় ঝুঁকি মোকাবেলায় সহযোগিতা করবে, না হয় বলবে, ‘আমি এ ধরনের কাজ অনুমোদন করব না। ’ এই সচেতনতা আধুনিক পুলিশের ভেতর আসতে হবে। সর্বোপরি আমাদের নগরপিতা হিসেবে মেয়রকেও দায়িত্ব নিতে হবে। ঘটনার পর কিছু নড়াচড়া করে এটাকে সংস্কৃতি হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। একই সঙ্গে দায়িত্বটা বুঝতে হবে যে পদ মানে প্রাপ্তি নয়, পদ মানে দায়িত্ব। আমরা কোনো স্তরেই এটা দেখতে পাচ্ছি না।

মূল কথা, উন্নয়নটা হতে হবে নিরাপদ। আমাদের সরকারি কর্মকর্তাদের যথেষ্ট পরিমাণ দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। একই সঙ্গে প্রতিটি ঘটনায় দায় নির্ধারণ করে দায়ী ব্যক্তিদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের এখানে দায়িত্ব নেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগেন। এর কারণটা হচ্ছে, তাঁকে মূল দায়িত্ব পালন করতে হয় না। আমাদের যেভাবে দায়সারা উন্নয়নকাজ হচ্ছে, তা স্বপ্নের কাছাকাছি যায় না। সরকারকে সেটা দেখতে হবে। এটা সংশোধন না করলে স্বস্তির উন্নয়ন আমরা পাব না।

লেখক : প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের সাবেক পরিচালক

 

সূত্রঃ কালের কন্ঠ