দশ টাকার শেয়ারের দাম ৪ হাজার ৯শ’ টাকা

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

পুঁজিবাজারে অস্বাভাবিক ওঠানামা করছে বস্ত্র খাতের কোম্পানি স্টাইল ক্র্যাফটের শেয়ারের দাম। ১০ টাকা মূল্যের প্রতিটি শেয়ারের দাম বুধবার উঠেছিল ৪ হাজার ৯শ’ টাকা পর্যন্ত। তবে বৃহস্পতিবার তা কমে ৩ হাজার ৫৪৭ টাকায় নেমে আসে।

৬ মাসে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের দাম ২শ’ শতাংশ বেড়েছে। এদিকে বিনিয়োগকারীদের জন্য মঙ্গলবার ৪১০ শতাংশ বোনাস শেয়ার ঘোষণা করেছে বস্ত্র খাতের এই প্রতিষ্ঠান। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির লভ্যাংশের এই মূল্য সংবেদনশীল তথ্য আগাম বাজারে ছড়ানো হয়েছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এটি কারসাজি। কারা এর সঙ্গে জড়িত, তদন্ত করা উচিত। তবে এ ব্যাপারে নিষ্ক্রিয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। স্টক এক্সচেঞ্জের পক্ষ থেকে শুধু দাম বৃদ্ধির কারণ জানতে চাওয়া হয়েছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ড. খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যুগান্তরকে বলেন, কোম্পানির শেয়ারের দাম কেন অস্বাভাবিক বাড়ছে, বিএসইসিকে তদন্ত করে বের করতে হবে।

কারা এই প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কিনছে, কেন দাম বাড়ছে তা অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা না নিলে বাজারে এ ধরনের অপরাধ বাড়তে থাকবে। কারণ এ ধরনের কোম্পানিই বাজারে অস্বাভাবিকতা তৈরি করে।

জানতে চাইলে স্টাইল ক্র্যাফটের কোম্পানি সচিব এডমান্ড জুদা বলেন, মূলধন বাড়াতে এই লভ্যাংশ ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু কোম্পানির পক্ষ থেকে লভ্যাংশের কোনো সংবাদ আগে বাজারে ছড়ানো হয়নি বলে দাবি করেন তিনি।

তবে শেয়ারের অতিরিক্ত মূল্যের ব্যাপারে তিনি বলেন, এটি আমাদেরও প্রশ্ন, এই কোম্পাানির শেয়ারের দাম এত বাড়বে কেন। এটি যৌক্তিক নয়। তার মতে, সবকিছুর একটি সীমা থাকা উচিত। তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন সময়ে শেয়ারের অতিরিক্ত দাম নিয়ে চিঠি আসে। কিন্তু এর কোনো ব্যাখ্যা দেয়া যায় না।

জানা গেছে, বর্তমানে ৯৯ লাখ পরিশোধিত মূলধনের এ প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান ব্যাংক ঋণ ২৪ কোটি টাকা। এ হিসাবে প্রতিষ্ঠানটির ঋণ ও মূলধন অনুপাত প্রায় (ডেট ইক্যুইটি রেশিও) ২৫:১। ছয় মাস আগে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের দাম ছিল ১৭শ’ টাকা।

এ অবস্থায় বাজারে খবর ছড়ানো হয়, প্রতিষ্ঠানটি এ বছর প্রতিটি শেয়ারের বিপরীতে লভ্যাংশ হিসাবে ৫টি বোনাস শেয়ার দেবে। এরপরই বিরামহীনভাবে বাড়তে থাকে দাম। দুর্বল মৌলভিত্তির এ প্রতিষ্ঠানটির ১০ টাকার শেয়ার, বাজারে বিক্রি হয়েছে ৪ হাজার ৯শ’ টাকা পর্যন্ত।

অর্থাৎ অভিহিত মূল্যের চেয়ে শেয়ারের দাম ৫শ’ গুণ বেশি। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ওয়েবসাইটে কোম্পানিটির ব্যাপারে সতর্ক বার্তা দেয়া হয়েছে। অস্বাভাবিকভাবে দাম বৃদ্ধির কারণ জানতে চেয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে।

সূত্র জানায়, মাত্র ২৫ লাখ টাকায় কোম্পানি গঠন করে উদ্যোক্তারা শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ৩০ লাখ টাকা সংগ্রহ করেন। দুই খাত মিলিয়ে কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন দাঁড়ায় ৫৫ লাখ টাকা।

এরপর ২০১৭ সালে ৮০ শতাংশ বোনাস শেয়ার দিয়ে পরিশোধিত মূলধন ৯৯ লাখ টাকায় উন্নীত করা হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে উপর্যুপরি ব্যাংক ঋণ নেয় উদ্যোক্তারা। পরিশোধিত মূলধনের চেয়ে ২৫ গুণ বেশি ব্যাংক ঋণ নিয়েছে এই প্রতিষ্ঠান।

অ্যাকাউন্টিং মানদণ্ডে একে বলা হয় ফাইন্যান্সিয়াল লিভারেজ (ঋণজনিত ঝুঁকি) অত্যন্ত বেশি। আর কোনো কারণে কোম্পানিটি দেউলিয়া হলে ব্যাংক ঋণের পরিশোধের পর বিনিয়োগকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারবে না। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির বাজার মূলধন ৪০৪ কোটি টাকা।

অর্থাৎ পরিশোধিত মূলধনের ৪শ’ গুণ। সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার স্পট মার্কেটে লেনদেন করতে বলা হয়েছে। জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, মন্দাবাজারেও কিছু কিছু শেয়ারের দাম এমনভাবে বাড়ছে, যা কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়।

কারা এসব কোম্পানির শেয়ার কিনছে, বিএসইসিকে তা খতিয়ে দেখতে হবে। তার মতে, কোম্পানি ঋণ বেশি থাকলে দায় বেড়ে যায়। কারণ কোম্পানি যে মুনাফা করবে, সেখান থেকে সবার আগে ঋণের সুদ পরিশোধ করতে হয়। এরপর সরকারকে কর দিতে হয়।

সবকিছু বাদ দিয়ে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দেয়। আর কোনো কারণে কোম্পানি দেউলিয়া হলে সবার আগে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে হবে। ওই বিবেচনায় ইক্যুইটির চেয়ে ঋণ বেশি হলে ওই কোম্পানির ঝুঁকি বেশি। তিনি আরও বলেন, ছোট মূলধনের কোম্পানি হলে শেয়ারের দাম বাড়াতে সুবিধা। কয়েক বিনিয়োগকারী একত্রিত হয়ে শেয়ারের দাম বাড়ায়। এটি একটি চক্রের কাজ।

কোম্পানির ওয়েবসাইটের তথ্য অনুসারে প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন ডিজাইনের পোশাক বানায়। ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠানটির মূল্য আয়ের অনুপাত ১২৮। অর্থাৎ আজ যে বিনিয়োগকারী শেয়ার কিনবে, আয়ের মাধ্যমে তা ফেরতে ১২৮ বছর সময় লাগবে।

চলতি বছরে প্রতিষ্ঠানটি প্রতিটি শেয়ারের বিপরীতে আয় (ইপিএস) করেছে ৩৬ টাকা ১৬ পয়সা। আগের বছর যা ছিল ৫২ টাকা ৪৭ পয়সা। এছাড়া প্রতি শেয়ারের বিপরীতে সম্পদ মূল্য ৩১৭ টাকা ৯৩ পয়সা। আগের বছর যা ছিল ৫০৮ টাকা ৪ পয়সা।

কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন ওমর গোলাম রব্বানী। এছাড়া অন্য পরিচালকরা হলেন ড. আলমাস বেগম, শরীফ আলমাস রহমান, নাভিদ হাসমাত, এম ফজলুর রহমান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস আলমাস রহমান।