দর্শনের পথ ধরে জীবনের পথ চলা

হাসান আজিজুল হক স্যার চলে গেলেন। বেশ কিছুদিন ধরে তাঁর শারীরিক অবস্থা ভালো যাচ্ছিল না। ২০১২-১৩ সালের দিকেও যখন রাজশাহীতে দেখা হতো বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, বুঝতাম আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে পড়ছেন শারীরিকভাবে। আশঙ্কা হতো তাঁকে নিয়ে। সর্বশেষ যখন ঢাকার ওসমানী মিলনায়তনে তাঁকে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করা হলো, সেখানেও দেখলাম তিনি বড় বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চুয়ালি প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। পুরস্কার গ্রহণের পর যখন তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও দর্শকদের উদ্দেশে স্মিতহাস্যে সালাম দিলেন, তখন কেন যেন মনে হলো এটাই কী আমার চোখে শেষ দেখা তাঁকে।

দর্শনের শিক্ষক ছিলেন তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু তাঁর সেই পরিচয় ঢাকা পড়ে যায় সাহিত্যিক পরিচয়ের কাছে। সরদার ফজলুল করিমকে আমরা যেভাবে দেখতে পাই—হাসান স্যার সেভাবে বিচরণ করেননি দর্শনের জগতে। তিনি ডুব দিয়েছিলেন গল্প, উপন্যাস—এসবের মধ্যে। মানুষের জীবনকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন গভীর মমতা দিয়ে। দর্শন বিষয়ে খুব বেশি লেখালেখি না করলেও তাঁর লেখায় দর্শনের প্রভাব ছিল অনিবার্যভাবে। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এক প্রবন্ধে বলেছিলেন, কোনো রচনা তখনই কালজয়ী হয় যখন সেটা দর্শনের আনুকূল্য পায়। আমরা অনেক লেখা পাঠ করি; কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী ছাপ ফেলে খুব কম লেখা। দর্শনের আনুকূল্য লাভ করত বলেই হয়তো বা হাসান আজিজুল হক স্যারের লেখা আমাদের মনে দাগ কাটতে পেরেছে।

স্যারের লেখা প্রথম পড়ি কলেজজীবনে। তখন আমি রাজশাহী কলেজের ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র। কলেজ হোস্টেলের সি ব্লক, কক্ষ নং-০১-এ থাকি। রুমমেট বর্তমান সময়ের উল্লেখযোগ্য লেখক রফিকুর রশীদ। বাংলা বিভাগের মেধাবী ছাত্র। তাঁর টেবিলে বাংলা সাহিত্যের অনেক বইপুস্তক। আমি পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি সেই বইগুলো পড়ার চেষ্টা করতাম। রশীদ ভাইয়ের মুখেও শুনতাম হাসান আজিজুল হক স্যারের গল্প। তাঁর টেবিল থেকেই খুঁজে পাই—হাসান স্যারের ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’। ভালো লাগে, খুব ভালো লাগে তাঁর বর্ণনার ভাষা। তখন থেকেই স্যারের লেখার ভক্ত আমি। ‘আগুনপাখি’, ‘জীবন ঘষে আগুন’, ‘করতলে ছিন্ন মাথা’—এসব লেখার স্বাদ আস্বাদন করেছি গভীরভাবে। পত্রপত্রিকায় তাঁর লেখা, সাক্ষাৎকার, আমার চোখে পড়েছে অথচ পাঠ করিনি—এ রকম হয়নি কখনোই।

মৃত্যুর খবর শোনার পর আমার ব্যক্তিগত বুকশেলফে তাঁর লেখা বই খুঁজতে থাকি। গল্প ও উপন্যাস রয়েছে বেশ কটি। হঠাৎ এসবের মধ্যে খুঁজে পাই অনবদ্য একটি বই—‘সক্রেটিস’। বইটির প্রকাশনার বিষয়ে তিনি লিখেছেন, “সক্রেটিস বের হয় বাংলা একাডেমীর অমর একুশে গ্রন্থমেলা সিরিজের একশটি বইয়ের একটি হিসেবে, ১৯৮৬ সালে। মাত্র দু’সপ্তাহের মধ্যে বইটি লেখা হয়। কিছুকাল পরে কলকাতার ‘অনুষ্টুপ’ প্রকাশনী থেকে এর একটি পশ্চিমবঙ্গীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় এবং বাংলা একাডেমী থেকে, আশ্চর্যের ব্যাপার, বের হয় এর দ্বিতীয় মুদ্রণ। এখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দেখছি, এর একটি ছিনতাই সংস্করণ বের হয়েছে ঢাকা থেকে এবং বাসে ট্রেনে পনেরো টাকা দামে বিকোচ্ছে। এই ভয়াবহ ছিনতাইয়ের যুগে আত্মরক্ষার কোনো উপায় নেই। মামলা মকদ্দমা করেও আর লাভ নেই। আইন উপনিবেশিক, দায়সারা এবং গা-জ্বলুনে ঠেসমারা। এখন তড়িঘড়ি বৈধ একটা সংস্করণ বের করে যতোটুকু রক্ষা করা যায়।

মানুষের আড়াই হাজার বছরের সভ্যতার বিশাল ওজনের খানিকটার চিরকালের বহনকারী টাইটানিক এই মানুষটি—সক্রেটিস। এখানে তাঁর জীবন কর্ম এবং ভাবনা নিয়ে বাংলায় কোনো বই নেই। সক্রেটিসের অনুরাগী হিসেবেই বইটি লিখেছিলাম। কিন্তু, পরে পাঠকদের এর প্রতি আগ্রহ দেখে মুগ্ধ হয়েছি, সেই জন্যই আর একবার প্রকাশ।”

বইটি পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। ক্ষীণতনু একটি বইয়ের মধ্যেই সক্রেটিসের জীবন ও দর্শনকে কত চমৎকারভাবেই না তুলে ধরেছেন তিনি।

২০১৯ সালে বর্তমান সরকার তাঁকে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভার্চুয়াল উপস্থিতিতে ওসমানী মিলনায়তনে এ পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান হয়। আমারও সে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। অনুষ্ঠানে পুরস্কারপ্রাপ্তদের সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত পরিচয় উল্লেখ করা হয়। সাহিত্য ক্ষেত্রে হাসান আজিজুল হকের অবদান সম্পর্কে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কর্তৃক উপস্থাপনা থেকে জানতে পারি তাঁর গল্প ইংরেজি ছাড়াও হিন্দি, উর্দু, রুশ ও চেক ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, একুশে পদক ছাড়াও এ দেশে অনেক পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন তিনি। ২০১২ সালে আসাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং ২০১৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টর অব লিটারেচার উপাধিতে ভূষিত করে। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও তাঁর ভূমিকা অগ্রগণ্য। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট রাজশাহী শাখার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ছিলেন সোচ্চার। ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি রাজশাহী শাখার উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।

আমার মনে হয়, দর্শনের অধ্যাপক হাসান আজিজুল হক স্যার আসলে সারাটি জীবন দর্শনেরই পথ ধরে চলেছেন। আর সেই দর্শনের ছাপ পড়েছে তাঁর সাহিত্য রচনায়, জীবন ও সমাজ বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে। তাঁর মৃত্যু আমাদের জন্য, বর্তমান প্রজন্মের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি।

লেখক : সরকারি কর্মকর্তা

 

সুত্রঃ কালের কণ্ঠ