দক্ষ প্রশাসনিক কাঠামোর বিকল্প নেই

মানবিক স্বাস্থ্যসেবার ধারণাটি এক ধরনের মিথ। আগামী দিনে যদি স্বাস্থ্যসেবা খাতকে ঢেলে সাজাতে চাই, তাহলে অবশ্যই হেলথকেয়ার সিস্টেমকে শিল্প-কারখানার মতো একটা সমন্বিত ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। সেবার তুল্যমূল্য সেখানে নির্ধারিত হতে হবে। কেবল উচ্চমূল্যের সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে দরিদ্র জনগণকে সরকারের পক্ষ থেকে ভর্তুকি দিতে হবে।

চিকিৎসক ছাড়াও এই সেবা খাতে জড়িত প্রত্যেকে নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করলে রোগীদের কোনো ধরনের বাড়তি অভিযোগ থাকার কথা নয়। জনগণ যে চিকিৎসাসেবা নেবে তার যথাযথ পণ্যমূল্য থাকতে হবে। তা এখনো আছে, কিন্তু যথাযথ জবাবদিহির প্রশাসনিক সক্ষমতা নেই। হাসপাতাল প্রশাসনের আধুনিকায়নে বড় ধরনের ঘাটতি থাকায় রোগীদের অভিযোগ থেকেই যাচ্ছে। রোগী সেবার জবাবদিহি হতে হবে দ্বিপক্ষীয়।

রোগীদের যাবতীয় অভিযোগ ও জবাবদিহি নিশ্চিত করবে স্বাস্থ্যসেবা প্রশাসন। সরাসরি চিকিৎসক বা নার্স দায়বদ্ধ থাকবে প্রশাসনের কাছে। রোগীর সঙ্গে সরাসরি বাগবিতণ্ডায় চিকিৎসক-নার্সদের কোনো ভূমিকা নেই। একই সঙ্গে রোগী ও রোগীপক্ষের আচরণবিধি বেঁধে দিতে হবে। আর দশটা সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের মতো ক্রেতা-ভোক্তা সুসম্পর্ক বজায় রেখে হেলথ ইন্ডাস্ট্রির অবকাঠামো গড়ে তোলা বাংলাদেশে করোনা-পরবর্তী যুগের দাবি।

উন্নত বিশ্বে উন্নত স্বাস্থ্য খাত তথা হেলথকেয়ার ইন্ডাস্ট্রির অংশ হচ্ছে হাসপাতাল, সাধারণ চিকিৎসক, নার্স, দন্ত চিকিৎসক, বিশেষায়িত চিকিৎসক, বহির্বিভাগ ও জরুরি চিকিৎসা, ডায়াগনস্টিক ল্যাব ও প্রচলিত চিকিৎসাসেবা।

আমাদের দেশে এই কাঠামো থাকলেও এগুলোর মাঠ পর্যায়ে অদক্ষতা স্বাস্থ্য খাতের ভঙ্গুর অংশ হিসেবে প্রমাণিত।

করোনা মহামারি স্বাস্থ্য খাতের এই গুমর ফাঁস করে দিয়েছে। পরবর্তী সময়ে এই খাতে শৃঙ্খলা কিছুটা হলেও ফিরে আসে চিকিৎসকদের সমন্বিত পরিশ্রমের মাধ্যমে।

কিন্তু বাস্তবে প্রতীয়মান হয়েছে, হাসপাতালের মূল সংজ্ঞার সঙ্গে চিকিৎসাসেবার মানের বাস্তব পার্থক্য এখনো বিদ্যমান। বিশেষ করে যোগাযোগবিচ্ছিন্ন এলাকায়, অপরিকল্পিত পরিকল্পনায়, অদক্ষ প্রশাসনিক কাঠামোতে নির্মিত হাসপাতাল কখনো পরিপূর্ণ সেবা প্রদানে সক্ষম হবে না।

করোনা মহামারি সূত্রে অতীত অভিজ্ঞতার দৃষ্টান্ত তুলে ধরলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। করোনাভাইরাস পরীক্ষার প্রটোকল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাদের ওয়েবসাইটে প্রথম প্রকাশ করে ২০২০ সালের ১৭ জানুয়ারি। তারা মডেল হিসেবে গ্রহণ করে জার্মানির টিআইবি মোলবিয়ল কম্পানির টেস্ট কিট। তবে শুধু কিট নয়, গুণগত মান বজায় রাখার জন্য আরো কিছু নিয়ামক প্রয়োজন হয়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—পরীক্ষার জন্য দূষণমুক্ত ল্যাব, সম্পূর্ণ সংক্রমণমুক্ত পরিবেশে সংরক্ষিত ল্যাব পরীক্ষার রাসায়নিক দ্রব্য, রোগীর দেহ থেকে সংগৃহীত নমুনা দূষণমুক্ত পরিবেশে সংরক্ষণ ইত্যাদি।

সর্বোপরি ‘আরটি-পিসিআর’ পদ্ধতিতে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি শনাক্তের পরীক্ষাটি অত্যন্ত সংবেদনশীল। প্রশিক্ষিত ল্যাব টেকনোলজিস্ট ছাড়া সাধারণ টেকনিশিয়ানদের পক্ষে এই পরীক্ষা করা দুরূহ ব্যাপার। সে ক্ষেত্রে ইচ্ছা থাকলেও সর্বত্র রাতারাতি কভিড-১৯ পরীক্ষা করা সম্ভব নয়। এটা সরকারের নীতিনির্ধারকরা জানুয়ারি মাসেই টের পেয়েছিলেন।

তবে জেলা পর্যায়ে মানসম্পন্ন ল্যাব প্রতিষ্ঠা এবং যথাযথ আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টিন সেন্টার স্থাপনে সহায়তা করার ক্ষেত্রে পরবর্তী দুই মাস ছিল যথেষ্ট দীর্ঘ সময়। আমরা তা রাতারাতি করতে পারিনি। কিন্তু চীনের পাশের দেশ ভিয়েতনাম তাদের দুর্বল স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা নিয়েও নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় কোয়ারেন্টিন পদ্ধতিতে করোনার বিস্তার ঠেকাতে সফল হয়েছিল।

এটা স্পষ্ট, ২০২০ সাল থেকে করোনা নিয়ে আমাদের পূর্বপ্রস্তুতি কার্যকর হয়নি মূলত স্বাস্থ্যসেবা খাতে নীতিনির্ধারকদের সুদূরপ্রসারী চিন্তা-ভাবনার সীমাবদ্ধতার কারণে। এর অন্যতম কারণ, আমাদের দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতে এখনো যথোপযুক্ত প্রশাসনিক কাঠামো আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গড়ে ওঠেনি।

পরিস্থিতি অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারকরা স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতামতকে খুব একটা গুরুত্ব দেন না। অথচ মহামারি রোধে রাষ্ট্রের উচিত ছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সুপারিশকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া।

মূলত স্বনামধন্য চিকিৎসক কিংবা প্রশাসনের আমলাদের মাধ্যমে স্বাস্থ্য প্রশাসন পরিচালনার যে রীতি চালু আছে তা আমূল পরিবর্তনের সময় হয়েছে। রোগতত্ত্ব বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়া ব্যক্তিরাই রাজনৈতিক বিবেচনায় স্বাস্থ্য প্রশাসনে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। এই ঐতিহ্য থেকে সরে আসার সময় হয়ে এসেছে।

আমরা অনেকেই এখনো জানি না, উন্নত বিশ্ব ছাড়াও পাশের দেশ ভারতেও ‘হেলথকেয়ার ম্যানেজমেন্ট’ ও ‘হসপিটাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ বিষয়ে পড়াশোনার ব্যবস্থা রয়েছে।

উপরোক্ত বিষয়ের মূল লক্ষ্য হলো, স্বাস্থ্য খাতের যাবতীয় ভৌত অবকাঠামো, রোগীর সেবার মান, হাসপাতালের সার্বিক ব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্যসেবা খাতের আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করা। সর্বোপরি রোগী ও চিকিৎসকের মধ্যে সেতুবন্ধ করা।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আমরা এখনো হয়তো ভাবছি মহামারিটি সাময়িক। কিন্তু আগামী দিনে স্বাস্থ্য খাতের মূল চ্যালেঞ্জ হবে নতুন ভেরিয়েন্টের অজানা ভাইরাসের বিরুদ্ধে।

সেই পরিস্থিতি মোকাবেলায় করণীয় হলো, যেকোনো ধরনের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সংক্রমণ রোধে রোগীদের সেবা প্রদানের জন্য নির্দিষ্ট সংক্রামক হাসপাতাল তথা আইসোলেশন হাসপাতাল স্থাপন। সেটি হতে হবে কভিড টেস্ট ল্যাব, আইসিইউ, পর্যাপ্ত ভেন্টিলেটরসমৃদ্ধ দক্ষ জনবলে স্বয়ংসম্পূর্ণ।

একই সঙ্গে দরকার চিকিৎসক থেকে রোগী পর্যায়ে যথাযথ গাইডলাইন বেঁধে দেওয়া। রোস্টার সিস্টেমে স্বাস্থ্যসেবাকর্মীদের কাজে লাগানো, পাশাপাশি দেশব্যাপী জনসচেতনতা গড়ে তোলা।

তবে রাষ্ট্রের আমলাতান্ত্রিক স্বাস্থ্যসেবা খাতের নির্দেশনায় নতুন টেকসই সেবা কাঠামো নির্মাণ কতটুকু কার্যকর হবে, বর্তমান পরিস্থিতির নিরিখে তা আশা করা মুশকিল। কিন্তু ভবিষ্যৎ মহামারি ঠেকাতে তার বিকল্প নেই। চলতি ব্যবস্থাপনা দিয়ে অন্য অনেক রোগের চিকিৎসা হয়তো করা যাবে, কিন্তু মহামারি ঠেকানো সম্ভব নয়—এটা প্রমাণিত।

স্বাস্থ্যসেবা খাতকে আগামী দিনের উপযোগী হিসেবে ঢেলে সাজাতে না পারলে অদৃশ্য ভাইরাসের কারণেই রাষ্ট্রযন্ত্রের অন্য অর্জনগুলো ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে।

আগামী দিনের বাংলাদেশে তাই যেকোনো বিবেচনায় স্বাস্থ্যসেবায় আধুনিক দক্ষ প্রশাসনিক কাঠামোর বিকল্প নেই।

লেখক : চিকিৎসক ও

হাসপাতাল প্রশাসক (ডিএইচএ)

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ