থামছে না জীবন বিমা করপোরেশনের অবৈধ ব্যয়


সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক :

বছরের পর বছর আইন লঙ্ঘন করে গ্রাহকের টাকা অবৈধভাবে খরচ করছে একমাত্র সরকারি জীবন বিমা প্রতিষ্ঠান জীবন বিমা করপোরেশন। সবশেষ ২০২২ সালে কোম্পানিটি আইন লঙ্ঘন করে ব্যবস্থাপনা ব্যয় হিসেবে অতিরিক্ত খরচ করেছে প্রায় ৩২ কোটি টাকা। আগের বছর একইভাবে খরচ হয়েছিল প্রায় ৫০ কোটি টাকা।

এমন অবৈধ ব্যয়ের কারণে পলিসি গ্রাহকরা বঞ্চিত হচ্ছেন তাদের প্রাপ্য বোনাস থেকে। একই সঙ্গে লভ্যাংশ থেকে সরকারও বঞ্চিত হচ্ছে। আর উপযুক্ত বোনাস দিতে না পারায় গ্রাহকের আস্থা হারাচ্ছে এই সরকারি বিমা প্রতিষ্ঠানটি।

গ্রাহকদের টাকা অবৈধভাবে ব্যয় করার পাশাপাশি কোম্পানিটির বিরুদ্ধে সঠিকভাবে বিমা দাবির টাকা পরিশোধ না করার অভিযোগও রয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে (২০২২ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত) কোম্পনিটিতে ৬৫ কোটি টাকার বেশি বকেয়া পড়েছে।

আমাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বেড়েছে। সবকিছু মিলে খরচের পরিমাণ বেড়ে গেছে। ব্যবসা যে আমরা খুব বেশি বাড়াতে পেরেছি তা কিন্তু নয়।

প্রতিবেদকের কাছে  রাষ্ট্রীয় মালিকাধীন এ জীবন বিমা প্রতিষ্ঠানটির ১১ বছরের ব্যয়ের তথ্য রয়েছে। এই ১১ বছরে কোম্পানিটি ব্যবস্থাপনা খাতে আইন লঙ্ঘন করে ৪৫৫ কোটি ৭৬ লাখ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করেছে।

এরমধ্যে সর্বশেষ ২০২২ সালে কোম্পানিটি আইন লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত ব্যয় করেছে ৩১ কোটি ৮১ লাখ টাকা। আইন অনুযায়ী বছরটিতে কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা খাতে সর্বোচ্চ ব্যয়ের সীমা ছিল ২২৯ কোটি ২২ লাখ টাকা। এর বিপরীতে কোম্পানিটি ব্যয় করেছে ২৬১ কোটি ৩ লাখ টাকা।

ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের মধ্যে কোম্পানিটি কমিশন বাবদ ব্যয় করেছে ৬৬ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। আর উন্নয়ন কর্মকর্তাদের বেতন বাবদ ৬৪ কোটি ৫৫ লাখ টাকা ব্যয় করেছে। বাকি ১৩০ কোটি ১৫ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে প্রশাসনিক ও অন্যান্য খাতে। প্রশাসনিক ও অন্যান্য খাতের ব্যয়ের মধ্যে অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ৬৬ কোটি ১১ লাখ টাকা, অফিস ভাড়া ৩ কোটি ৭৬ লাখ এবং অন্যান্য ব্যবস্থাপনা ব্যয় ৬০ কোটি ২৮ লাখ টাকা।

এর আগে ২০২১ সালে কোম্পানিটি ব্যবস্থাপনা খাতে অতিরিক্ত ব্যয় করে ৪৪ কোটি ৩ লাখ টাকা। ২০২০ সালে ৪৩ কোটি ১৭ লাখ টাকা আইন লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত ব্যয় হয়। ২০১৯, ২০১৮ ও ২০১৭ এই তিন বছরের কোম্পানিটির ব্যয়ের তথ্য পাওয়া যায়নি।

তবে ২০০৯ থেকে ২০১৬ সালের ব্যয়ের তথ্য পাওয়া গেছে। এরমধ্যে ২০১৬ সালে ৬৯ কোটি ১০ লাখ টাকা, ২০১৫ সালে ৫১ কোটি ৫৬ লাখ, ২০১৪ সালে ৪৩ কোটি ৫৫ লাখ, ২০১৩ সালে ৪৪ কোটি ১৮ লাখ, ২০১২ সালে ৩৭ কোটি ৭৭ লাখ, ২০১১ সালে ৪৭ কোটি ৬৯ লাখ, ২০১০ সালে ২৭ কোটি ৫৮ লাখ এবং ২০০৯ সালে ১৫ কোটি ৩২ লাখ টাকা ব্যবস্থাপনা খাতে অতিরিক্ত ব্যয় করা হয়।

এদিকে কোম্পানিটির বিমা দাবির চিত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০২২ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত সময়ে কোম্পানিটি বিমা দাবি বকেয়া পড়েছে ৬৫ কোটি ১১ লাখ ৪৬ হাজার ৭৭৯ টাকা। গ্রাহকদের ৫৮৫ কোটি ৫ লাখ ১৬ হাজার ৭৭৯ টাকা দাবির বিপরীতে কোম্পানিটি ৫১৯ কোটি ৯৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা পরিশোধ করেছে। ২০২১ সালে কোম্পানিটিতে বকেয়া বিমা দাবির পরিমাণ ছিল ৫৯ কোটি ৪৭ লাখ টাকা।

জীবন বিমা করপোরেশনের এ পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজার ও বোর্ড সেক্রেটারি শ্যামল কান্তি ভৌমিক জাগো নিউজকে বলেন, বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) প্রতিবেদনেই দেখতে পাবেন আমাদের দাবি পরিশোধের হার ভালো।

ব্যয় আইনি সীমার মধ্যে রাখতে না পারার বিষয়ে তিনি বলেন, ব্যয় আইনি সীমার মধ্যে রাখতে পারিনি। কারণ আমাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বেড়েছে। সবকিছু মিলে খরচের পরিমাণ বেড়ে গেছে। ব্যবসা যে আমরা খুব বেশি বাড়াতে পেরেছি তা কিন্তু নয়। আমরা যদি আরও ব্যবসা বাড়াতে পারতাম, তাহলে ব্যয় কমে আসতো।

কোম্পানিটির আয়ের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২২ সালে কোম্পানিটি প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয় করেছে ২১৪ কোটি ১৬ লাখ টাকা। আগের বছর ২০২১ সালে প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয় হয় ১৮৮ কোটি ৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয় বেড়েছে ২৬ কোটি ৮ লাখ টাকা বা ১৩ দশমিক ৮৭ শতাংশ।

প্রথম বর্ষের পাশাপাশি কোম্পানিটির নবায়ন প্রিমিয়াম আয়ও বেড়েছে। ২০২২ সালে প্রতিষ্ঠানটি নবায়ন প্রিমিয়াম আয় করেছে ৫৪৬ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। ২০২১ সালে নবায়ন প্রিমিয়াম আয় হয় ৪৮৩ কোটি ৯২ লাখ টাকা। অর্থাৎ নবায়ন প্রিমিয়াম আয় বেড়েছে ৬২ কোটি ৯৪ লাখ টাকা বা ১৩ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ।

২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে ব্যবসা বেড়েছে। জাগো নিউজের পক্ষ থেকে এমন তথ্য তুলে ধরা হলে শ্যামল কান্তি ভৌমিক বলেন, হ্যাঁ, ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে ব্যবসা বেড়েছে। তবে ২০২০ সালে ব্যবসা কম ছিল। নবায়ন প্রিমিয়াম আয় আমাদের প্রতি বছর বাড়ছে। কিন্তু বিনিয়োগ রিটার্ন আমরা কম পাচ্ছি।