তুংচি: চীনের ২২তম সৌরপদ

চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা পড়েছে। গত কয়দিন ধরেই ভোরের দিকে তাপমাত্রা থাকে মাইনাস ৭/৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রোদ থাকলে দিন গড়ানোর সাথে সাথে তাপমাত্রা খানিকটা বাড়ে বটে, তবে বিকেল থেকে আবার কমতে থাকে। বাতাস থাকলে শীতের তীব্রতাও বাড়ে। ইদানিং শীতের সাথে পাল্লা দিয়ে বাতাসও বাড়ছে। ফলে, সকালে ও সন্ধ্যায় যারা ঘর থেকে বের হন, তাদের উপযুক্ত গরম কাপড় পরতে হয়। আমি শীতের শুরুতে একটা জ্যাকেট কিনে ভেবেছিলাম, শীতকালটা দিব্যি কাটিয়ে দেওয়া যাবে। কিন্তু আমাকে, অনেকটা বাধ্য হয়েই, আরেকটি মোটা ও লম্বা জ্যাকেট কিনতে হয়েছে সেদিন।

এ সময়টায় শীতের তীব্রতা বেশিই হবার কথা; অন্তত চীনের চান্দ্রপঞ্জিকা অনুসারে। গত ২১ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়েছে চীনা চান্দ্রপঞ্জিকার ২২তম সৌরপদ বা সোলার টার্ম। এ সৌরপদের নাম ‘তুংচি’ (Dong zhi)। চীনা ভাষায় ‘তুং’ মানে ‘শীতকাল’ এবং ‘চি’ মানে ‘চরম’। তার মানে, এ সময় থেকেই চীনে চরম শীত পড়তে শুরু করে। নিদেনপক্ষে, এই সৌরপদ চরম শীতের বার্তাবাহক। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, এবার তুংচি শুধু বার্তাই বহন করে আনেনি, খোদ চরম শীতকেও সাথে নিয়ে এসেছে। তুংচি সৌরপদের শেষদিন হচ্ছে ৫ জানুয়ারি, ২০২২।

 তুংচি-র প্রথম দিন লাল শিম ও আঠালো ভাত খায় চীনের ইয়াংজি নদীর দক্ষিণের কয়েকটি অঞ্চলের মানুষ। পরিবারের সকল সদস্য এদিন একসঙ্গে বসে এ খাবার খায়। তাদের অনেকেই আজও বিশ্বাস করে যে, এ খাবার খেলে ভূত-প্রেত ও অন্যান্য খারাপ জিনিসের কুপ্রভাব থেকে বেঁচে থাকা যায়।

jagonews24

তুংচি নিয়ে কথা বাড়ানোর আগে বলে রাখি, চীনের চান্দ্রপঞ্জিকা অনুসারে বছরকে ভাগ করা হয় ২৪টি সৌরপদ (solar terms)-এ। প্রাচীন চীনে হলুদ নদীর অববাহিকায় এই ২৪ সৌরপদের উৎপত্তি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই ২৪ সৌরপদ ‘চীনের পঞ্চম মহান আবিষ্কার’ (Fifth Great Invention of China) হিসেবে স্বীকৃত। ইউনেস্কোও একে মানবজাতির অবৈষয়িক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। প্রতিটি সৌরপদের আছে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য।
প্রাচীনকাল থেকেই চীনারা সৌরপদ অনুসারে নিজেদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে কৃষিকাজ আঞ্জাম দিয়ে আসছে। বছরের কোন সৌরপদে আবহাওয়া কেমন থাকবে— তা নামগুলো দেখলেই বোঝা যায়। সৌরপদ অনুসারে চীনারা তাদের খাওয়া-দাওয়ায়ও পরিবর্তন আনে, পরিবর্তন আনে পোশাক-আশাকে। তুংচি সৌরপদ চলাকালেও এর ব্যতিক্রম হবে না বা হচ্ছে না।

jagonews24

আগেই বলেছি, তুংচি শুরু হয়েছে ২১ ডিসেম্বর। পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে বছরের সবচেয়ে ছোট দিন ছিল সেটি। দিন সবচেয়ে ছোট হওয়া মানে রাতটি ছিল সবচেয়ে বড়। সেদিন বেইজিংয়ের সিচিংশান জেলায় (আমরা যে-জেলায় বাস করি) সূর্য উঠেছিল ৭টা ৩১ মিনিটে এবং ডুবেছিল ৪টা ৫৩ মিনিটে। তার পরের দিন থেকেই অবশ্য ক্রমে দিন বড় হচ্ছে ও রাত ছোট হচ্ছে। এ ধারা চলতে চলতে ২০ বা ২১ জুনে গিয়ে আমরা পাবো বছরের সবচেয়ে বড় দিন ও সবচেয়ে ছোট রাত।

প্রাচীন আমলে তুংচি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। তখন তুংচি উৎসবকে বসন্ত উৎসবের সমান গুরুত্ব দেওয়া হতো। তুংচি উৎসবপালন শুরু হয়েছিল হান রাজবংশ আমলে (২০৬ বিসি থেকে ২২০ এডি)। থাং ও সুং রাজবংশ আমলেও এ উৎসব পালিত হতো অনেক গুরুত্বের সাথে। তখন লোকেরা তুংচি সৌরপদের প্রথম দিনে দেব-দেবীর পূজা করতো। প্রথম দিনটি তখন নতুন বছরের প্রথম দিন হিসেবেও গণ্য করা হতো।

jagonews24

হান রাজবংশ আমলে (২০৬ বিসি থেকে ২২০ এডি) তুংচি শীত-উৎসবে পরিণত হয়। তখন তুংচি-র প্রথম দিনে রাজ কর্মকর্তা ও সাধারণ মানুষ নির্বিশেষে সবাই বিশ্রাম নিতেন। পরে থাং রাজবংশ (৬১৮-৯০৭), সুং রাজবংশ আমল (৯৬০-১২৭৯) ও ছিং রাজবংশ আমলেও (১৬৪৪-১৯১১) তুংচি-র প্রথম দিন লোকেরা স্বর্গ ও পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে বলি দিতেন। আজকাল আর আগের মতো ধুমধাম করে তুংচি পালন করা হয় না। তবে, এখনও চীনের কোনো কোনো অঞ্চলের লোকজন তুংচি-র প্রথম দিনে একসঙ্গে বিশেষ খাবার খায় ও পূর্বপুরুষদের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করে।

তুংচি চরম শীত নিয়ে আসে। শীতে শরীরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের প্রয়োজন হয় বিশেষ পুষ্টির; অন্তত ঐতিহ্যবাহী চীনা চিকিত্সাবিদ্যা (টিসিএম) তাই বলে। টিসিএম অনুসারে, তীব্র শীতে বাদামজাতীয় খাবার কিডনি, মস্তিষ্ক ও হার্টের কর্মক্ষমতা বাড়ায়। আর তাই, তুংচি-তে চীনারা চীনা বাদাম, আখরোট, চেস্টনাট, কাজুবাদাম, ইত্যাদি পরিমাণমতো খেয়ে থাকে।

jagonews24

তুংচি-তে উত্তর চীনের মানুষ ডাম্পলিং খায়। আসলে ডাম্পলিং বলতে গেলে গোটা চীনে সারা বছর ধরেই খাওয়া হয়। কিন্তু তুংচি-র প্রথম দিনে ডাম্পলিং খাওয়া হয় অনেকটা বাধ্যতামূলকভাবে (২১ ডিসেম্বর, মানে তুংচি-র প্রথম দিনে, আমাদের ক্যান্টিনেও ডাম্পলিং ছিল)। ডাম্পলিং শীতের নেতিবাচক প্রভাব কাটাতে সাহায্য করে বলে চীনাদের বিশ্বাস। চীনে একটি কথা প্রচলিত আছে: তুংচি-র প্রথম দিন ডাম্পলিং খাও এবং সিয়াচি-র (দশম সৌরপদ, যার শুরুতে বছরের সবচেয়ে ছোট দিন ও সবচেয়ে বড় রাত পাওয়া যায়) প্রথম দিন খাও নুডলস।

jagonews24

চীনের সিয়াংসু প্রদেশের সুচৌ-এর বাসিন্দারা তুংচি-তে ওনথন নামক একটি বিশেষ খাবার খেতে অভ্যস্ত। সেখানকার লোককাহিনী অনুসারে: প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে উ রাজ্যের রাজা একবার দামি দামি খাবার খেয়ে বিরক্ত হয়ে সাধারণ কিছু খেতে চাইলেন। তখন তুংচি উৎসব চলছিল। রাজার চাহিদা পূরণ করতে সুন্দরী সিশি বিশেষ অথচ সাধারণ খাবার ওনথন রান্না করেন। রাজা সে খাবার পছন্দ করেন এবং পেটপুরে খান। সেই থেকে সুচৌ-এ তুংচি উৎসবের মূল খাবার ওনথন। আজও সেই রীতি প্রচলিত আছে।

jagonews24

তুংচি-তে শাংহাইয়ের মতো কিছু অঞ্চলের মানুষ মিষ্টি ডাম্পলিং বা থাংইউয়ান খেতে পছন্দ করে। এ ধরনের ডাম্পলিংয়ের পুর হিসেবে ব্যবহার করা হয় চিনি-মাখানো চালের গুড়া। আর এ খাবার খেয়েই তারা তুংচি উৎসব পালন করে। নিংসিয়া হুই স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের ইনছুয়ানের বাসিন্দারা তুংচি উত্সবকে ডাকে ‘ভূতের উৎসব’। এসময় ভেঁড়ার মাংস দিয়ে তৈরি এক ধরনের বিশেষ স্যুপ খায় তাঁরা। স্যুপের সঙ্গে ডাম্পলিংও থাকে। এই স্যুপের একটি বিচিত্র নামও আছে। ইনছুয়ানের বাসিন্দারা এই স্যুপকে ডাকে ‘মস্তিষ্ক বা মগজ’ (brain) এবং রান্নার পর তা প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে খায়। ইংরেজি ব্রেইন শব্দটির অর্থ ‘বুদ্ধি’, ‘ধীশক্তি’, ‘মেধা’ ইত্যাদিও হয়। সম্ভবত তাঁরা বিশ্বাস করে যে, এই স্যুপ খেলে বুদ্ধি বাড়ে।

jagonews24

তুংচি-র সময় হাংচৌ-এর বাসিন্দারা চালের তৈরি পিঠা খাবেই খাবে। এটা একটি ঐতিহ্যবাহী রীতি। অতীতে তুংচি-র প্রাক্কালেই হাংচৌবাসীরা চালের পিঠা বানিয়ে পূর্বপুরুষদের স্মৃতির প্রতি উৎসর্গ করতো এবং উপহার হিসেবে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের ঘরে ঘরে পাঠাতো। আজকাল খুব কম বাড়িতেই চালের তৈরি পিঠা হাতে বানানো হয়। তবে, প্রায় সবাই তুংচি-র সময় বাজার থেকে রেডিমেড পিঠা কিনে খায় ও খাওয়ায়।

jagonews24

তুংচি’র সময় নয় স্তরের কেক বানানোর রীতি ধরে রেখেছে তাইওয়ানের বাসিন্দারা। এই কেক তারা উত্সর্গ করে পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে। একই বংশের বিভিন্ন পরিবারের সদস্যরা তুংচি-র প্রথম দিনে পূর্বপুরুষদের সমাধিতে একত্রিত হয় এবং বয়সভেদে পর্যায়ক্রমে পূর্বপুরুষদের কবরে নয় স্তরের কেক উৎসর্গ করে। পূর্বপুরুষদের সমাধিতে কেক উৎসর্গ করার পর সবাই মিলে ভোজের আয়োজন করাও তাদের একটি প্রাচীন রীতি, যা এখনও প্রচলিত আছে।

এদিকে, তুংচি-র প্রথম দিন লাল শিম ও আঠালো ভাত খায় চীনের ইয়াংজি নদীর দক্ষিণের কয়েকটি অঞ্চলের মানুষ। পরিবারের সকল সদস্য এদিন একসঙ্গে বসে এ খাবার খায়। তাদের অনেকেই আজও বিশ্বাস করে যে, এ খাবার খেলে ভূত-প্রেত ও অন্যান্য খারাপ জিনিসের কুপ্রভাব থেকে বেঁচে থাকা যায়।

jagonews24

লেখক: বার্তা-সম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি)।
alimulh@yahoo.com

 

সূত্রঃ জাগো নিউজ