টিপু হত্যার পরিকল্পনা এক মাস আগের! ছিল ‘ব্যাকআপ’ টিম

এক মাস আগে পরিকল্পনা করে রাজধানীর মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপুকে হত্যা করা হয়। ওই বৈঠকের সমন্বয় করেন সাবেক যুবলীগ নেতা বোচা বাবু হত্যা মামলার অন্যতম আসামি মুসা। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা এসব তথ্য জানিয়েছেন।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট ডিবি সূত্র জানিয়েছে, রাজধানীর গোড়ান এলাকার একটি ভবনে এক মাস আগের ওই পরিকল্পনায় স্থানীয় বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা, পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী প্রকাশ-বিকাশ গ্রুপ, জিসান গ্রুপ, ফ্রিডম মানিক গ্রুপ ও ইখতিয়ারের লোকজন উপস্থিত ছিলেন।

ওই সভার সমন্বয়কারী ছিলেন বোচা বাবু হত্যার মামলার অন্যতম আসামি মুসা। মূলত বোচা বাবু হত্যাকে কেন্দ্র করে টিপুর সঙ্গে বিরোধের পাশাপাশি এলাকার রাজনীতি, চাঁদাবাজি ও ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করতে অনেক ব্যক্তির স্বার্থে টিপুকে হত্যা করা হয়। টিপুকে হত্যার সমন্বয় করে মুসা এরই মধ্যে দেশ থেকে পালিয়েছেন বলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

ওই সূত্র আরো জানিয়েছে, পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী টিপুকে হত্যার জন্য দুটি কিলার গ্রুপ বাছাই করা হয়। এর মধ্যে একটি গ্রুপের শ্যুটার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন মাসুম মোহাম্মদ আকাশ ও তার সহযোগী এবং আরেকটি গ্রুপ ব্যাকআপ হিসাবে ঘটনাস্থলে ছিলেন। সেই গ্রুপের অস্ত্রধারীর অস্ত্র থেকেও গুলি হয়েছে বলে আলামত পাওয়া গেছে। তবে সেই গ্রুপের শ্যুটার কে সে বিষয়ে এখনও নিশ্চিত হতে পারেননি তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

ডিবির এক কর্মকর্তা বলেন, এর আগে ক্যাসিনো কাণ্ডের ঘটনায় আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের প্রভাবশালী বেশকয়েকজন নেতা গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছে। এরপর থেকে টিপু একক আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করেন মতিঝিল এলাকায়। নিয়ন্ত্রণ করেন ঠিকাদারি। এ ছাড়া রিয়াজুল হক খান মিল্কী হত্যাকাণ্ডের পর দীর্ঘদিন গুরুত্বের বাইরে থাকলেও হঠাৎ দলে তার গুরুত্ব বাড়তে থাকে। প্রভাব হারাতে থাকেন আগের ক্ষমতাসীনরা। মতিঝিল, আরামবাগ, এজিবি কলোনি, শাহজাহানপুর, কমলাপুর টিপুর একক নিয়ন্ত্রণে আসতে থাকে ক্রমান্বয়ে। টিপু ও তার স্ত্রী কাউন্সিলর ডলির ঘনিষ্ঠজনরাই এলাকা দাপিয়ে বেড়াচ্ছিলেন।

টিপু হত্যাকাণ্ডে তদন্তের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিবির মতিঝিল বিভাগের উপ কমিশনার রিফাত রহমান শামীম বলেন, টিপু হত্যাকাণ্ডে বিভিন্ন সূত্র থেকে নানান ধরনের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। তদন্তে কিছুটা অগ্রগতি আছে।

ডিবির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সকালে কমলাপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে দামাল নামে এক শ্যুটারের কাছ থেকে একটি বিদেশী রিভলবার উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধার করা এই অস্ত্রটি টিপু হত্যায় ব্যবহার হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য আদালতের অনুমতি নিয়ে ব্যালিস্টিক পরীক্ষার জন্য পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ বা সিআইডির কাছে পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এ ছাড়া গ্রেপ্তার দামালকে জিজ্ঞাবাদের জন্য রিমান্ডের আবেদন জানিয়ে শুক্রবার সকালে আদালতে হাজির করা হবে।

ঘটনাস্থল থেকে দুই ধরণের আগ্নেয়স্ত্রের খোসা উদ্ধার করা হয়েছে জানিয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, এগুলো পরীক্ষা করা হচ্ছে। এ থেকে ধারনা করছি, টিপু হত্যায় দুই গ্রুপের দুটি অস্ত্র ব্যবহার হয়েছে।

দামালকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিবির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, উদ্ধার হওয়া অস্ত্রটি একটি রিভলবার। টিপু হত্যাকাণ্ডে এই অস্ত্রটি ব্যবহার হয়েছে কিনা তা পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া গ্রেপ্তার অস্ত্রধারীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডের আবেদন জানিয়ে শুক্রবার আদালতে তোলা হবে।

দামাল প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে কোনো তথ্য দিয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, দামাল ফ্রিডম মানিকের হয়ে কাজ করে থাকেন। এ ছাড়া ফ্রিডম মানিকের ক্যাশিয়ার মারুফ হোসেনকে আটক করা হয়েছে। তাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মারুফ জানিয়েছে, মতিঝিলের বিভিন্ন এলাকা থেকে চাঁদাবাজির তোলা টাকার ভাগবাটোয়ারা ও বাইরে পাঠানোর কাজ তিনিই করতেন।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, টিপু হত্যাকাণ্ডে ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা আলামত বিশ্লেষণে দেখা গেছে, টিপু হত্যাকাণ্ডে দুই ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। গুলির খোসার ধরণ দেখে তারা এমনটা মত দিয়েছেন। যদিও এসব আলামত পরীক্ষার জন্য পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ বা সিআইডির কাছে পাঠানো হয়েছে। পরীক্ষার রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত চূড়ান্ত মতামত দিতে রাজি হননি এই কর্মতারা।

গুলির খোসার ভিন্নতার কারণে এই কর্মকর্তাদের ধারণা- টিপু হত্যাকাণ্ডে একাধিক শ্যুটার টিম ছিল। মাসুম মোহাম্মদ আকাশ ও তার সহযোগী ছাড়াও তাদের ব্যাকআপ টিম হিসাবে আরেক দল ছিল। যাদের তথ্য আকাশের কাছে ছিল না। এই হতাকাণ্ডের নিখুঁত পরিকল্পনায় জড়িত ছিল শীর্ষ সন্ত্রাসীদের প্রতিনিধিরা।

সূত্র জানায়, হত্যার আগে রাজধানীর কমলাপুর ও গোড়ান এলাকায় শীর্ষ সন্ত্রাসীদের ক্যাডার বাহিনী পরপর দুটি বৈঠক করে। প্রায় মাসখানেক আগে করা সেই বৈঠকে ফ্রিডম মানিক, ফ্রিডম মানিকের শিষ্য ইখতিয়ার, জিসান ও বিকাশের লোকজন ছিল। এসব মিটিংয়ের আয়োজনে স্থানীয় একাধিক নেতার সংশ্লিতার পাশাপাশি পলাতক আরেক সন্ত্রাসী মুসার সমন্বয়ের তথ্য পেয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে টিপু হত্যায় গ্রেপ্তার হওয়া শ্যুটার মাসুম মোহাম্মদ আকাশকে দফায় দফায় জিজ্ঞসাবাদ করা হয়েছে। তার তথ্যের আলোকে এরই মধ্যে স্থানীয় একাধিক নেতা ও পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসীর একাধিক সন্দেহভাজন সহযোগীকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। এর বাইরে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার নিজস্ব তদন্তে এই হত্যাকাণ্ডে অনেকের জড়িত থাকার তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

গত ২৪ মার্চ রাতে রাজধানীর শাহজাহান পুর আমতলা এলাকায় টিপুকে বহনকারী মাইক্রোবাসে এলোপাতাড়ি গুলি চালানো হয়। সেই গুলিতে টিপু ও মাইক্রোবাসের পাশে থাকা রিকশাআরোহী কলেজছাত্রী সামিয়া আফনান জামাল প্রীতি গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। এ ঘটনায় ২৫ মার্চ টিপুর স্ত্রী শাহজাহানপুর থানায় হত্যা মামলা করেন। পরদিন টিপু হত্যার শ্যুটার মাসুম মোহাম্মদ আকাশকে গ্রেপ্তার করে। তারপর আদালতের মাধ্যমে সাত দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে।

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ