টিউশনির টাকা বাড়েনি, ব্যয় বেড়েছে

সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক :

ছাত্র পড়িয়ে পড়াশোনার খরচ জোগাচ্ছেন মারুফ হাসান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের ছাত্র তিনি। থাকেন সূর্য সেন হলে। নরসিংদীর রায়পুরায় এই তরুণ অভিভাবকদের আর্থিক চাপ থেকে রেহাই দিতে টিউশনি করছেন।

এতে খাবার, শিক্ষাসহ অন্যান্য ব্যয় মেটাচ্ছেন। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এতে বাদ সেধেছে। টিউশনির টাকা বাড়েনি, অথচ প্রতিদিনের খাবার, শিক্ষা ও অন্যান্য ব্যয় বেড়ে চলেছে। গুনতে হচ্ছে বাড়তি টাকা। খেতে হচ্ছে হিমশিম।
মারুফের মতো এমন আরো অনেক শিক্ষার্থী আছেন, যাঁরা মফস্বল বা দূরের গ্রাম থেকে রাজধানী ঢাকায় এসেছেন উচ্চশিক্ষার জন্য। থাকছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের হল বা মেসে। নিত্যপণ্যসহ জীবনযাপনের আনুষঙ্গিক ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বেশ দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে তাঁদের।

মারুফ হাসানের ভাষ্য, আগে সকালের নাশতায় ২৫ থেকে ৩০ টাকা খরচ হতো। ডিম, তেলসহ অন্যান্য খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ায় এখন খরচ হচ্ছে ৪০ থেকে ৫০ টাকা।

তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন খাবারের পেছনে যে খরচ হচ্ছে, টিউশনির সম্মানীতে আর কুলানো যাচ্ছে না। সকালের নাশতা ৩০ টাকার মধ্যে রাখার চেষ্টা করি। দুপুর ও রাতের খাবারেও কম খরচের চেষ্টা চলছে। কিন্তু এতে হচ্ছে না। সম্মানী বাড়ানোর কথা বললে হয়তো টিউশনিই চলে যাবে। ’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির আগে ডিম, পরোটা ও ডাল-ভাজি দিয়ে সকালের নাশতায় তাঁদের খরচ হতো ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। দাম বাড়ায় তালিকা থেকে বাদ পড়েছে ডিম। ডাল-ভাজি আর দুটি পরোটা খেতেই এখন গুনতে হচ্ছে ৩০ টাকা।

দাম বাড়ায় তুলনামূলক সস্তা খাবার বেছে নিয়েও ২৫০ টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে। মাস শেষে ব্যয় দাঁড়াচ্ছে সাড়ে সাত হাজার টাকার মতো। আর টিউশনির জন্য পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা পেয়ে থাকেন একজন শিক্ষার্থী।

ইমরান নাফিসের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার পেরুল গ্রামে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজে স্নাতকোত্তরের ছাত্র। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হলে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি বিসিএস পরীক্ষারও প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এ জন্য সহায়ক বই কিনতে হচ্ছে। তিনি জানান, সাধারণ বিজ্ঞানের বই ‘সায়েন্স আওয়ার’ গত মাসে ৩৩০ টাকায় কিনেছিলেন। এক মাস যেতেই সে বইয়ের দাম ৫৫ টাকা বাড়িয়ে বিক্রি করা হচ্ছে ৩৮৫ টাকায়।

নাফিস বলেন, ‘টিউশনির টাকায় এসব বই কিনি। প্রতি মাসে নানা প্রয়োজনে বই কিনতে হয়। নিজেকে যোগ্য করে তুলতে আমরা সাহিত্য থেকে শুরু করে সহায়ক বিভিন্ন বই কিনে থাকি। বইয়ের দাম বাড়ায় এখন এসব কেনা কষ্টকর। ’

বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য সহায়ক অন্যান্য বইয়ের মধ্যে কারেন্ট অ্যাফেয়ার্সসহ স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব স্তরের বইয়ের দাম বেড়েছে। বই-খাতা, কলম, পেন্সিলসহ সব শিক্ষা উপকরণের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন জীবনে। এসবের পাশাপাশি বেড়েছে ফটোকপি, প্রিন্ট নেওয়ার খরচ।

নীলক্ষেত বইয়ের মার্কেটের তাজ লাইব্রেরির স্বত্বাধিকারী হারুনুর রশীদ বলেন, ‘কাগজ আর জ্বালানি তেলের দাম দুইটাই বেড়েছে। নতুন কইরা কেউ বই ছাপাইতে গেলে তার খরচ বেশি পড়ব। বাজারের সব কিছুর দাম বাড়লে, তার একটা প্রভাব তো বই-খাতায় পড়বই। ’

বিপাকে মেসবাসী

নিত্যপণ্যসহ শিক্ষা উপকরণের দাম বাড়ায় সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন মেসে থাকা শিক্ষার্থীরা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির তড়িৎ প্রকৌশলের ছাত্র ইয়াসিন আরাফাত রুবেল বিজয় সরণি এলাকার একটি মেসে থাকেন। থাকা-খাওয়া ও শিক্ষার যাবতীয় ব্যয় নির্বাহে টিউশনির ওপর নির্ভরশীল তিনি।

রুবেল জানান, আগে টিউশনি করে ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকা আয় করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ দিয়েও বাড়িতে টাকা পাঠাতে পারতেন। করোনা সংকটের পর থেকে আগের মতো টিউশনি খুঁজে পাচ্ছেন না।

তিনি বলেন, মেসের সিট ভাড়া, বুয়ার খরচ, শিক্ষা উপকরণের দাম বেড়েছে। আগামী ডিসেম্বর-জানুয়ারি নাগাদ মেসের ভাড়া বাড়তে পারে ভেবে চিন্তিত তিনি। অতিরিক্ত ব্যয় সামাল দিতে প্রতিদিনই নতুন টিউশনি খুঁজে বেড়াচ্ছেন।

রুবেল বলেন, ‘করোনার পরে মেসের এক সিটের ভাড়া এখন চার হাজার টাকা। বুয়ার খরচ বেড়েছে এক হাজার টাকা। গ্যাস-বিদ্যুতের খরচ বেড়েছে। অথচ হাতে এখন কোনো টিউশনি নেই। অভিভাবকরা ছেলেমেয়ের জন্য আগের মতো প্রাইভেট টিউটর রাখছেন না। ’

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে ভুক্তভোগী এসব শিক্ষার্থীর জন্য সরকার, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসিকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক ডিন অধ্যাপক সাদেকা হালিম। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে হলের খাবারের মান বৃদ্ধি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ডরমিটরি স্থাপনের আহ্বান জানান তিনি।

তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করে আসছে, তাদের হলগুলোতে যে মানের খাবার পরিবেশন করা হয়ে থাকে, সেগুলোতে পর্যাপ্ত পুষ্টি পাওয়া যায় না। এখানে কিন্তু নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীই বেশি। তারা সুষম খাবারের জন্য টিউশনি করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের কর্তব্য এসব শিক্ষার্থীর খাবারের যথাযথ পুষ্টিমান নিয়ন্ত্রণ করা। ’

সাদেকা হালিম বলেন, ‘দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ফলে এখন শিক্ষার্থীদের পরিবারের ব্যয় সংকোচন হচ্ছে, শিক্ষার ব্যয়ও সংকুচিত। ঢাকায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছে এমন ৭০ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী এই পরিস্থিতির শিকার। সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইউজিসিকে শিক্ষার্থীদের অসুবিধাটা অনুধাবন করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। ’

সূত্র : কালের কণ্ঠ