জয় করেও ভয় তবু কেন যায় না?

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

সন্ধ্যা নামছে শহরে। একে একে জ্বলে উঠছে রাস্তার আলোগুলো। চলছে আসন্ন সন্ধ্যাকে স্বাগত জানানোর প্রস্তুতি। উত্তুরে হাওয়ায় শীতের টান। ৪৮ বছর আগে ডিসেম্বরের এই বাতাসে মিশে ছিল কত লাখো কোটি মানুষের হাহাকার। সন্দেহ নেই সেই ডিসেম্বরটি ছিল বাংলাদেশের দুঃসহতম ডিসেম্বর। এরপর এ দেশে বিভিন্ন সময়ে এসেছে বিবিধ সামরিক শাসন। রাজনৈতিক স্মৃতির ক্যানভাসে গোয়ের্নিকাকে মনে করিয়ে দেয় এক-এগারোর জরুরি অবস্থার নিকৃষ্টতম স্মৃতি। একাত্তরের মতো সরাসরি বেয়নেটের গুলি লাখ লাখ প্রাণ কেড়ে নেয়নি তখন; কিন্তু সেই দুঃশাসন মন-মস্তিষ্ক-স্নায়ুর ওপর যে চাপ সৃষ্টি করেছিল সে অভিঘাত আছে এখনও।

নাগরিক অধিকারে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ কী প্রবল মনস্তাত্ত্বিক চাপ তৈরি করতে পারে, এক-এগারো তার নির্মম উদাহরণ। যদিও শেষ পর্যন্ত আর সব সামরিক সরকারের ক্ষেত্রে যা হয়, এক-এগারোর সরকারের ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছিল। প্রবল জনঅসন্তোষের আগুনে ঝলসে গিয়েছিল সেই সময়ের শাসকের সব অহমিকা, দম্ভ আর উন্নাসিকতা। শৃঙ্খলার শিক্ষা দিতে গিয়ে জনজীবন কীভাবে দুর্বিষহ করে তোলা যায় সেই বিষবৃত্ত আমরা দেখেছি। কিন্তু সামরিক শাসন তো সামরিক শাসনই।

সেখানে মনকে প্রবোধ দেয়া যায় এটা ভেবে যে, সামরিক শাসনে শাসক-শাসিতের সম্পর্ক টিকে থাকে একচিলতে সুতার ওপর। সামরিক শাসকের মন প্রতিমুহূর্তে উৎকণ্ঠায় থাকে কখন ফুঁসে ওঠে জনরোষ। আশঙ্কা থাকে, এই বুঝি ভেঙে পড়ল সাধের অবৈধ সিংহাসন। যে কারণে যখন-তখন যে কারও বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা, রাজনৈতিক নেতাদের জেলহাজতে পাঠানো, গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ, ফ্যাসিস্ট কায়দায় রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানের ওপর দমননীতি, লেখক-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীদের মাথার ওপর অদৃশ্য খড়্গ, যে কাউকে যখন-তখন ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ ট্যাগ জুড়ে দেয়া হয়। জরুরি অবস্থায় এসব ডালভাত।

এখন কেমন আছে বাংলাদেশ? ভিন্নমতকে নির্মূল করার জবরদস্তি থেকে কি রেহাই মিলেছে? বিএনপি ‘সন্ত্রাসী’ দল, জনজীবনকে স্বস্তি দিতে তাদের মিছিল-মিটিং, সভা-সমাবেশে বাধা দেয়া হবে- এ তো ‘জনস্বার্থেই’ প্রয়োজন। কিন্তু এখন তো দেখা যাচ্ছে পুলিশের চোখে সিপিবিও সন্ত্রাসী দল। নইলে তারাও কেন মিটিং-মিছিল, সভা-সমাবেশে বাধা পাচ্ছে? সবাইকেই কি ঢোঁড়া সাপ হয়ে থাকতে হবে? এতদিন জেনে এসেছি, ফাঁকা মাঠে গোল দেয়াটা দুর্বলতার পরিচয়। এখন শুনি সেটাই সাফল্য। চারপাশের সব প্রতিদ্বন্দ্বীকে নির্মূল করার মধ্যে সামরিক নেতাদের সাফল্য থাকতে পারে, রাজনৈতিক নেতাদের নয়। ভয়ের সংস্কৃতিও সামরিক শাসনের অংশ। কিন্তু রাজনৈতিক শাসনের অধীন আমরা কি ভয়মুক্ত আছি?

পেঁয়াজ না খেতে পারি, আড়াইশ’ টাকায় পেঁয়াজ কিনতে যে কষ্ট হয় সেটা প্রতিবাদ করে জানানোর স্বাধীনতাটুকু থাকলেও পেঁয়াজ না খাওয়ার কষ্ট কিছুটা কমে। আওয়ামী লীগের কোনো কোনো গুরুত্বপূর্ণ নেতা বলেছেন, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। আড়াইশ’ টাকায় পেঁয়াজ কিনে মানুষ খাচ্ছে তো। বাজারে পেঁয়াজের অভাবও নেই। আর চিকন চালের দাম বেড়েছে কারণ এর চাহিদা বেড়েছে। সব মিলিয়ে বাজার পরিস্থিতি দেখে তার মনে হয়েছে, সচ্ছলতা উপচে পড়ছে ক্রেতাদের। পেঁয়াজ দিতে পারেন না, চাল দিতে পারেন না, আবার সেটা বলতে গেলে আগ্রাসী ভঙ্গিমায় তা দমন করবেন।

কথা বলতে ভয়, লিখতে ভয়, যে কোনো মাধ্যমে মত প্রকাশে ভয়, এমনকি ঘরে ফেরার সময় রাস্তায়ও ভয়। রাস্তায় বের হলে কোনো না কোনো অসিলায় বহু স্তরের তল্লাশি। কেন? তবে কি শাসকশ্রেণির সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক হয়ে উঠেছে ভয়ের? নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর, চারপাশের কোথাও যখন আওয়ামী লীগার ছাড়া আর কেউ নেই তখন সামান্য ভিন্নমতেও এত ভয় কেন? রবীন্দ্রনাথের ভাষা ধার করে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, জয় করেও তবু ভয় কেন যায় না? বিজয়ের মাসের শুরুতে হিসাবের খাতা নিয়ে বসেছিলাম- কী চেয়েছি আর কী পেলাম সেই হিসাব কষতে। দেখছি, আমরা জনগণ ভয়ে আছি- কখন কোন অজুহাতে ফেঁসে যাব, কখন কোন ভুল হয়ে যায়। তবে শাসকশ্রেণিও আছে ভয়ে। যদিও তাদের ভয় কীসের আমরা জানি না।

২.

নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় প্রতিটি জিনিসের দাম বেড়েছে। সবজির এ ভরা মৌসুমে কখনও সবজির এত দাম দেখিনি। বিদ্যুতের দাম বাড়বে কিনা তার জন্য আবারও গণশুনানি ডাকা হয়েছিল। অতএব নিশ্চিত ধরে নিতে পারি বিদ্যুতের দাম বাড়বেই। এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের গণশুনানি ডাকা মানেই বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি পাওয়া, তা সে দামবৃদ্ধি যতই অযৌক্তিক প্রমাণ হোক শুনানিতে। রাষ্ট্রের বিশাল ব্যয়ের ভার মেটানোর দায় যে জনগণেরই! লুটপাটের টাকা তো ফেরত আনা যাচ্ছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে শতকোটি টাকা লোপাট হয়ে গেছে, সেই টাকার হদিস আজও মিলল না। খেলাপি ঋণে ব্যাংকগুলো হেলে পড়েছে। সরকারি অর্থ নয়ছয়ের মাধ্যমে কেনাকাটায় গুরুতর দুর্নীতি থামানো যায়নি। বিদেশে বেআইনি টাকা পাচার চলছেই। পানামা পেপারসের তালিকাভুক্তদের কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারেনি দুদক।

জানি, প্রশ্ন ছুড়ে দেয়া হবে- পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলের সুবিধা কি আমরা ভোগ করব না? জনগণের ভ্যাট ও করের পয়সা ছাড়া কিন্তু রাষ্ট্রের উন্নয়নের একটি ইটও গাঁথা সম্ভব ছিল না। এ তো আমাদের পাওনা ভোগ। শাসক দলের পক্ষ থেকে সবসময় প্রত্যাশা থাকে, জনগণ যেন তাদের হাত শক্ত করে। কিন্তু এ আকাঙ্ক্ষার তো একটি উল্টো দিকও আছে। জনগণেরও নিবেদন আছে, দয়া করে আপনারাও শক্ত করে দুর্নীতিবাজদের ধরুন। প্রশাসন যন্ত্রটিকেও শক্ত হাতে না ধরলে সব উন্নয়ন থেমে যেতে বাধ্য। মানুষের স্বপ্ন ভেঙেচুরে গুঁড়িয়ে যেতে বাধ্য। ইতিমধ্যেই কি সেই ম্বপ্ন নানাভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়নি? মানছি মেগা প্রকল্প কোনো বিচ্ছিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নয়। এটি সার্বিক আর্থসামাজিক উন্নয়নের ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। কিন্তু চারটি পদ্মা সেতু, জেলায় জেলায় মেট্রোরেল কিংবা সোনা দিয়ে দেশ মুড়িয়ে দিলেও মানুষের মন থেকে কষ্ট যাবে না দুর্নীতির পথ বন্ধ না করলে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ব্যয়ে নির্মিত রাস্তা (প্রতি কিলোমিটার ১৬৭ কোটি টাকা) যদি ছ’মাসের মাথায় ভেঙে যায়, তবে উন্নয়নের দশা হয় পাটিগণিতের সেই তৈলাক্ত বাঁশের বানরের মতো।

সরকারি হাসপাতালগুলোতে গেলে দেখবেন সাধারণ গজ-তুলা টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে। ময়লা বিছানার চাদর, চাকাহীন ট্রলি, অপরিষ্কার টয়লেট, দালালদের উৎপাত, বেঠিক রক্ত দেয়ায় রোগীর মৃত্যু, চিকিৎসা কর্মীদের অবহেলা। স্বাধীন দেশের সরকারি হাসপাতালের কি এই দশা হওয়ার কথা ছিল? কুকুর-বেড়ালের মতো রোগীদের টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। স্বাস্থ্যব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণ নিয়ে শাসক দলের এক গর্বের নাম কমিউনিটি হাসপাতাল। কমিউনিটির মোহ কেটে যাবে সেখানে চিকিৎসা নিতে গেলে। গরিবের হাসপাতাল বলেই কি কমিউনিটি হাসপাতালের এ দুর্দশা?

শিক্ষার পরিষেবা রীতিমতো ব্যাধিগ্রস্ত। চাকরির অভাবে শিক্ষিত তরুণ দিশাহীন। কৃষিনির্ভরশীল হয়ে আছে প্রকৃতির দয়ার ওপর। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষী কৃষক সমাজের সবচেয়ে বড় অংশ। পুঁজির অভাব, উন্নত বীজ-সার-সেচের অভাব, ব্যাংকের ঋণের জালে আজও তারা স্রেফ গণি মিয়া। নারীর ইচ্ছা-অনিচ্ছা, স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা. রুচি-অরুচি, ভালো-মন্দ বেঁচে থাকার আয়োজন সবই নিয়ন্ত্রিত এ রাষ্ট্রে। নারীর জন্য স্বাধীনতা আজও কেবল কথার কথা। এ নিয়ে যত আন্দোলই হোক, আইন প্রণীত হোক, সংবিধান সংশোধন হোক, রাষ্ট্র যতই শাস্তিযোগ্য আইনি ব্যবস্থার কথা স্বগর্বে ঘোষণা করুক, আসল ছবির কোনো পরিবর্তন হয়নি। সব নাগরিকের ওপরই আছে চোরাগোপ্তা নিয়ন্ত্রণ।

পাঁচশ’ বছর আগে ম্যাকিয়াভ্যালি বলেছিলেন, রাজপুরুষের প্রজাবৎসল হওয়ার দরকার নেই, শুধু প্রজাবৎসল ভাবমূর্তি গড়ে তোলাই যথেষ্ট। আমাদের শাসকশ্রেণি ম্যাকিয়াভ্যালির পরামর্শ মতো প্রজাবৎসল ভাবমূর্তিটি গড়ে তুলেছেন বটে! মহাভারতের মৌষলপর্বে লেখা আছে যুধিষ্ঠিরের রাজ্য লাভের পর ছত্রিশতম বছরে দারোকায় বৃষ্ণি বংশীয়রা দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে নিজেরাই নিজেদের বিনষ্ট করেছিলেন। বৃষ্ণি বংশ মানে যদু বংশ। যাদবদের ঔদ্ধত্য ও অধঃপতনের কালে এরকা নামের এক ধরনের শর বা তুণ বজ্র্যতুল্য লৌহমুষলে পরিণত হয়েছিল। সেই শর কে, পিতা কে, পুত্র কে, সখা কে, শত্রু কে, সাধু কে, চতুর কে, নিষ্ঠাবান কে- কৌশলী সেই বিচারে ছিল অপারগ। সবাইকে বিদ্ধ করত সেই শর বা তুণ রূপান্তরিত হয়েছিল মুষলে। আওয়ামী লীগের নেতারাও কে বন্ধু কে শত্রু তা বিচার করে কথা বলছেন না। পরীক্ষিত বন্ধুদের তারা শত্রু বানিয়ে ছেড়েছেন।

৩.

গান্ধারী বলেছিলেন, ‘জয়, জয় চেয়েছিনু, জয়ী আমি আজ।’ শাসকশ্রেণি জয় তো পেয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি জিতলেন? জনগণের মন কতটুকু জয় করতে পেরেছেন? উত্তর দেয়ার স্বাধীনতাও কি জনগণের আছে? জনগণের কাজ কেবল অশেষ ধৈর্যের পরীক্ষা দেয়া। প্রতিদিন তা-ই দিয়ে যাচ্ছি আমরা।

জয়া ফারহানা : গল্পকার ও প্রাবন্ধিক