জয়পুরহাটের ক্ষেতলালে ভিজিএফ’র চাল বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক, জয়পুরহাট:

জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল পৌরসভায় দুস্থ্যদের নতুন তালিকা তৈরি না করে আগের তালিকা দিয়ে ভিজিএফ’র চাল উত্তোলনের পর বিতরণে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে কিছু পরিমাণ চাল বিতরণ এবং বাকী চাল বিক্রি করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। দুস্থ্যদের চাল না দিয়ে সেগুলো দলীয় নেতা-কর্মীদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। অভিযোগের  ভিত্তিতে ১০৫ বস্তা চাল বিক্রির পর সেগুলো কালাই উপজেলার বালাইট মোড়ের একটি বাড়ী থেকে উদ্ধারও করেছে উপজেলা প্রশাসন।

ক্ষেতলাল পৌরসভার ভিজিএফ’র ১০৫ বস্তা চাল কালাই থেকে উদ্ধারের পর পুলিশ ওই বাড়ীর মালিককে ঘটনাস্থলে না পেয়ে তার স্ত্রীকে গ্রেফতার করেছে। এদিকে উদ্ধারকৃত চাল সিজার লিষ্টের মাধ্যমে জব্দ করা হয়েছে। এছাড়াও পৌরসভার ২ নম্বর ও ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলররা মেয়রের বিভিন্ন অনিয়মের কথাও উল্লেখ করেন। এর আগে মেয়রের বিরুদ্ধে বেশ কয়েক বার স্থানীয় প্রশাসনকে অভিযোগ করে কোন লাভ হয়নি। বরং এ অনিয়মের ব্যাপকতা দিনদিন বৃদ্ধিই পাচ্ছে। তারা দাবী করে বলেন, শুধু চাল বিক্রিই নয়, যে তালিকা দিয়ে চাল উত্তোলন করা হয়েছে, সেই তালিকা আসলে নতুন না পুরাতন। তালিকাগুলো একটু খতিয়ে দেখলে আসল রহস্য বেরিয়ে আসবে।

উদ্ধারকৃত চালগুলো যে ক্ষেতলাল পৌরসভার, সে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বাড়ীর মালিক কাশেম আলী। এ ঘটনায় কালাই উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা জিয়াউদ্দিন আহম্মেদ বাদী হয়ে সংশ্লিষ্ট আইনে বাড়ীর মালিক, তার স্ত্রী ও চালের মালিককে আসামী করে কালাই থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন।

অন্যদিকে একই রাতে জেলার পাঁচবিবি উপজেলার মোহাম্মদপুর ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয় থেকে আরও ১৪০ বস্তা ভিজিএফ’র চাল উদ্ধার করেছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। দুই উপজেলা মিলে মোট ২৪৫ বস্তা ভিজিএফ’র চাল উদ্ধার করা হয়েছে।

জানা গেছে, এবার ক্ষেতলাল পৌরসভার অধীনে জেলার প্রাপ্য অনুযায়ী ৩ হাজার ৮১ জন গরীব ও দুস্থ্যরা পাবেন ভিজিএফ’র চাল। সেই আলোকে তাদের নামের তালিকা নতুনভাবে তৈরি করে ঈদের আগে প্রত্যেককে ২০ কেজি করে ভিজিএফ’র চাল বিতরণ করার কথা। ওই পৌরসভার কাউন্সিলরদের সহযোগীতা নিয়ে নতুন তালিকা প্রস্তুত করবেন মেয়র। সেই তালিকা প্রস্তুত না করে আগের তালিকা দিয়েই ক্ষেতলাল পৌরসভার মেয়র সিরাজুল ইসলাম বুলু গত রোববার সকালে স্থানীয় খাদ্যগুদাম থেকে ৩ হাজার ৮১ জনের বিপরীতে ৬১.৬২ মেট্রিক টন চাল উত্তোলন করেন। চালগুলো দুস্থ্যদের মাঝে বিতরণ না করে তিনি কিছু পরিমাণ চাল আগের তালিকার কিছু লোকজনদের মাঝে ও দলীয় নেতা-কর্মীদের মাঝে বিতরণ করেন এবং বাকী সব চাল বিক্রি করে দেন।

ক্ষেতলাল পৌরসভার ভিজিএফ’র চাল কালাইয়ে বিক্রি হয়েছে এমন বিষয়ে অবগত হয়ে গতকাল সোমবার রাতে কালাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্টেট আফাজ উদ্দিন উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ও ওসি এলএসডিকে সাথে নিয়ে বালাইট মোড়ে কাশেম আলীর বাড়ীতে গিয়ে অভিযান চালান। সরকারিভাবে সীলযুক্ত সরবরাহকৃত বস্তা দেখে সেখান থেকে তিনি ৫০ কেজির ৮০ বস্তা এবং ৩০ কেজি ওজনের ৩৫ বস্তা মিলে ১০৫ বস্তা চাল (যার পরিমান ৫ মেট্রিক টন) উদ্ধার করেন। পরে তিনি ওই চালগুলো সিজার লিস্টের মাধ্যমে জব্দ করেন। এ সময় বাড়ীর মালিক পলাতক থাকায় তার স্ত্রী শান্তনা বেগমকে গ্রেফতার করেন।

স্থানীয়দের অভিযোগের ভিত্তিতে একই রাতে জেলার পাঁচবিবি উপজেলার মোহাম্মদপুর ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয় থেকে আরও ১৪০ বস্তা ভিজিএফ’র চাল উদ্ধার করেছে পাঁচবিবি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাজিবুল হাসান। তিনিও চালগুলো সিজার লিস্টের মাধ্যমে জব্দ করেছেন।

ক্ষেতলাল পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর খলিলুর রহমান কাজী সিল্কসিটি নিউজকে বলেন, কাউকে না জেনেই মেয়র তার দলীয় লোকজনদের নিয়ে সোমবার সকাল থেকে পূর্বের তালিকা অনুযায়ী নিজের মত করে কিছু লোকজনদের ডেকে নিয়ে ২০ কেজির পরিবর্তে ১৫ কেজি করে চাল বিতরণ করেন। সেই সাথে তালিকা ছাড়াই দুস্থ্যদের পরিবর্তে দলীয় নেতা-কর্মীদেরও চাল দেন তিনি। সব চাল বিতরণ না করে অর্ধেকেরও বেশী পরিমাণ চাল মেয়র বিক্রি করে দিয়েছেন। সোমবার রাতে কালাই উপজেলার বালাইট মোড়ের একটি বাড়ী থেকে মেয়রের বিক্রি করা ৫ মেট্রিক টন চাল উদ্ধার হয়েছে।

২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আরমান আলী বলেন, মেয়র শুধু চাল বিক্রির মত কাজই করেন না, এর চাইতেও বড় বড় কাজও তিনি করেন। এটা তার কাছে সামান্য বিষয়। প্রশাসনকে টাকা দিয়েই সব ম্যানেজ করবেন তিনি। যে ব্যক্তি গরীব দুস্থ্যদের চাল বিক্রি করে তার পকেটে রাখতে পারেন, তার দ্বারা সবকিছুই সম্ভব। কালাই থেকে যে পরিমাণ চাল উদ্ধার হয়েছে, একটু খোঁজ করলেই এর চাইতে আরও বেশী পরিমাণ উদ্ধার করা সম্ভব। কেননা মেয়র অর্ধেকেরও বেশী পরিমাণ চাল বিক্রি করেছেন। তালিকা অনুযায়ী কাউকেই চাল দেওয়া হয়নি। আর আমার নিকট থেকে তালিকাতো নেওয়াই হয়নি।

কালাইয়ের যে বাড়ী থেকে ক্ষেতলাল পৌরসভার ভিজিএফ’র চাল উদ্ধার করা হয়েছে, সেই বাড়ীর মালিক কাশিম আলী সাথে মুঠো ফোনে কথা বলে জানা গেছে, এই চালগুলো কালাইয়ের চাতাল ব্যবসায়ী মেহেদুল ইসলাম চৌধুরী ক্ষেতলাল পৌরসভার মেয়রের নিকট থেকে গত সোমবার সন্ধ্যায় কিনে নিয়েছেন। গোপনে চাল এনে ওই ব্যবসায়ী তার বাড়ীতে রেখেছেন। বাড়ীতে আনার পর সময়ের অভাবে বস্তাগুলো পরিবর্তন করতে পারেননি তারা। তার আগেই প্রশাসনের লোকজন টের পেয়েছে। তাদের উপস্থিতি টের পেয়ে তিনি বাড়ীর পিছন দরজা দিয়ে পালিয়ে গেছেন।

চাল ক্রয়ের বিষয়ে তিনি আরও জানান, আসলে এই চালগুলো তার নয়, কালাই খাদ্যগুদামে চালগুলো ঢুকানোর জন্য চাতাল ব্যবসায়ী মেহেদুল ইসলাম চৌধুরী গোপনে কম দামে ক্ষেতলাল পৌরসভার মেয়রের সাথে যোগাযোগ করে কিনেছেন।

ক্রয়কৃত চালের মালিক মেহেদুল ইসলাম চৌধুরীর মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তার ফোন বন্ধ পাওয়ায় বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

পৌরসভার ধনকুড়াইল মহল্লার আমিনা বেগম, সাথী বেগম, কবিতা বেগমসহ বেশ কয়েকজন অভিযোগ করে জানান, তালিকায় তাদের নাম থাকা সত্ত্বেও তারা চাল পাননি। অথচ গত সোমবার ভিজিএফ’র চাল বিতরণ করা হয়েছে। তারা সহায় সম্বলহীন। চাল বিক্রি করার কারণে তারা ভাতা থেকে বঞ্চিত।

ভিজিএফ’র চাল বিক্রির কথা অস্বীকার করে ক্ষেতলাল পৌরসভার মেয়র সিরাজুল ইসলাম বুলু বলেন, গুদাম থেকে তালিকা অনুযায়ী চাল উত্তোলন করে তা বিতরণ করা হয়েছে। বিতরণে কোন প্রকার অনিয়ম করা হয়নি। কালাই থেকে ভিজিএফ’র যে চাল উদ্ধার হয়েছে সেগুলো আমার নয়। রাজনৈতিক ক্যারিয়ার এবং সুনামকে ক্ষুন্ন করার জন্য একটি মহল আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে।

এ ঘটনায় পাঁচবিবি উপজেলার মোহম্মদপুর ইউপি’র চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান জানান, ঘটনার দিন তিনি পরিষদে ছিলেন না। তাই এ বিষয়ে তিনি কিছু বলতে পারবেন না।

কালাই উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আব্দুল হান্নান বলেন, যে চালগুলো জব্দ করা হয়েছে এগুলো সরাকারি ভিজিএফ’র চাল। তবে চালগুলো কোথায় থেকে আনা হয়েছে তা আমার জানা নেই। তবে লোকমুখে শুনছি এই চালগুলো নাকি ক্ষেতলাল থেকে ক্রয় করা।

কালাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্টেট আফাজ উদ্দিন বলেন, সোমবার রাতে বালাইট মোড়ের একটি বাড়ীতে অভিযান চালিয়ে ১০৫ বস্তা ভিজিএফ’র চাল উদ্ধার করা হয়েছে। সেই সাথে বাড়ীর মালিককে না পাওয়ায় তার স্ত্রীকে আটক করা হয়। চালগুলো সিজার লিস্টের পর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাকে বাদী করে তাদের বিরুদ্ধে মামলাও দেওয়া হয়েছে। এখন তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পাঁচবিবি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাজিবুল হাসান জানান, উপজেলার মোহাম্মদপুর ইউনিয়নের ভিজিএফ চাল বিতরণে ব্যাপক অনিয়ম হচ্ছে। স্থানীয়দের এমন অভিযোগের ভিত্তিতে ওই ইউনিয়ন পরিষদের একটি কক্ষ থেকে ১৪০ বস্তা চাল উদ্ধার করা হয়।

স/শা