জেলা ও মহানগর আ.লীগের প্রস্তাবিত পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে দুর্নীতিবাজ বিতর্কিতরা

দুর্নীতি ও নারী নির্যাতন মামলার একাধিক আসামি, চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধী পরিবারের সদস্যরাও স্থান পেয়েছেন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন জেলা ও মহানগরের প্রস্তাবিত পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে। জেলা ও মহানগর কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা, নিকটাত্মীয়রাও আছেন কমিটিতে। কমিটি গঠনে স্বজনপ্রীতি পরিহার ও বিতর্কিতদের না রাখার কঠোর কেন্দ্রীয় নির্দেশনার পরও এসব কাণ্ডে ক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা।

আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো এমনটাই জানিয়েছে। সূত্র মতে, আগামীকাল শনিবার আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে এসব বিষয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হবে।

গত বছর সম্মেলন হওয়া আওয়ামী লীগের ৩১টি সাংগঠনিক জেলায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের তোড়জোড় চলছে। এর মধ্যে ২০টির মতো কমিটি কেন্দ্রীয় দপ্তরে জমা পড়েছে। বাকি কমিটিগুলোও শিগগিরই জমা পড়বে। জমা হওয়া কমিটিগুলোতে অনেক বিতর্কিত নেতা স্থান পাওয়ায় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ক্ষোভ জানিয়েছেন। বেশ কয়েকটি কমিটি ফেরত দিয়ে সেগুলো পুনরায় গঠন করে জমা দিতেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

বিতর্কিতদের কমিটিতে স্থান পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ বলেন, ‘কমিটিগুলো রিভিউ করার জন্য বলা হয়েছে। নেত্রী কয়েকটি কমিটি ফেরত দিয়েছেন। যাচাই-বাছাই করে বিতর্কিতদের বাদ দিয়েই কমিটি ঘোষণা হবে।’

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘অনেক কমিটিতেই বিতর্কিতরা স্থান পেয়েছে। এ নিয়ে দলের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। যাচাই-বাছাই করে সবাইকে নিয়ে সমন্বয় করেই কমিটি গঠন হবে।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত কমিটিতে সদস্য রাখা হয়েছে হাবিবুর রহমান মজনুকে। তিনি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে রাজাকার ছিলেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা। নারী নির্যাতন মামলায় জেল খাটা অপরাধী বেনজির আলীকে প্রস্তাবিত জেলা কমিটির সদস্য করা হয়েছে।

জানতে চাইলে শিবগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য আব্দুল মতিন বলেন, ‘মজনু রাজাকার ছিল, এটা এলাকার সবাই জানে। এতে কোনো মিথ্যা নেই। তাকে কমিটিতে রাখা হয়েছে। আওয়ামী লীগের পুরনো নেতাকর্মীদের বাদ দিয়ে জেলা কমিটিতে বিভিন্ন দল থেকে আসা ব্যক্তি ও বিতর্কিতদেরই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।’

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মঈনুদ্দিন মণ্ডলের ছয়জন নিকটাত্মীয়কে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদে রাখা হয়েছে। মঈনুদ্দিন মণ্ডলের ভাই মর্তুজা আলী সহসভাপতি, ভাতিজা পারভেজ হাসান বাবু সাংগঠনিক সম্পাদক, নাতি সামিউল হক লিটন সদস্য, শ্যালিকা রানী বেগম ও ভায়রা মেসবাহুল হক জুয়েলকে সদস্য পদে প্রস্তাব করা হয়েছে। মঈনুদ্দিনের ভাতিজা ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আরিফ রেজা ইমনকে জেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক পদে রাখা হয়েছে।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানার জন্য জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মঈনুদ্দিন মণ্ডলকে একাধিকবার মোবাইল ফোনে কল দিলেও তিনি ধরেননি। এসএমএস পাঠিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

জানা যায়, সরকারি চাকরিজীবী হয়েও রাজশাহী জেলা কমিটিতে জায়গা পেয়েছেন মোজাম্মেল হক ও একরামুল হক। মোজাম্মেল দুর্গাপুর উপজেলার দাওকান্দি সরকারি ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ এবং একরামুল হক পুঠিয়ার বানেশ্বর সরকারি ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ।

রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ প্রস্তাবিত জেলা কমিটির বেশ কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বরাবর লিখিত চিঠি পাঠিয়েছেন। সেখানে তিনি লিখেছেন, সহসভাপতি পদে প্রস্তাবিত সাবিয়ার রহমান মাস্টার কখনো আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন না। এমনকি তাঁর প্রাথমিক সদস্য পদও নেই।

পুঠিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে অব্যাহতি পাওয়া আবদুল মালেককে সদস্য পদে প্রস্তাব করা হয়েছে। মাদকাসক্ত ও নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

সদস্য পদে প্রস্তাবিত নীলিমা বেগম চারঘাট পৌরসভায় চাকরিরত। তিনি কখনোই জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও মিথ্যা তথ্য দিয়ে তাঁকে সদস্য করা হয়েছে বলে অভিযোগ জানিয়েছেন আসাদুজ্জামান আসাদ। অভিযোগপত্রে আরো লেখা হয়, প্রস্তাবিত কমিটিতে শ্রম সম্পাদক পদে রাখা আসলাম আলী ছাত্রশিবিরের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁর বড় ভাই আহাদ আলী ২০১৫ সালে পুঠিয়া পৌরসভা নির্বাচনে জামায়াতের প্রার্থী ছিলেন।

সিলেটে প্রভাবশালী নেতাদের বিরুদ্ধে আর্থিক সুবিধা নিয়ে পদ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। কমিটিতে স্থান পাওয়া অনেকে আওয়ামী লীগ বা এর সহযোগী সংগঠনের রাজনীতিতে পরিচিত মুখ নন। ভর্তি ও বদলি বাণিজ্যের কারণে একাধিকবার সংবাদমাধ্যমে আলোচিত হয়েছেন অ্যাডভোকেট আব্বাস উদ্দিন। সাংগঠনিক কাজে তাঁর উপস্থিতিও নেই তেমন। শুধু জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন খানের এলাকার লোক এবং ঘনিষ্ঠ হওয়ার কারণে তিনি প্রস্তাবিত কমিটিতে প্রচার সম্পাদকের পদ পেয়েছেন। একইভাবে প্রস্তাবিত কমিটিতে স্থান দেওয়া হয়েছে পাথরখেকো হিসেবে বিতর্কিত মজির উদ্দিনকে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কাছে পরিচিত না হলেও সিলেট জেলা কমিটির সভাপতি লুৎফুর রহমানের ব্যক্তিগত চিকিৎসক হওয়ার সুবাদে প্রস্তাবিত কমিটির স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক পদটি পেয়েছেন ডা. শাকির আহমদ শাহীন। বিগত কমিটিতে এই পদে ছিলেন সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের ছেলে আরমান আহমদ শিপলু। তাঁকে সেখান থেকে সরিয়ে তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক পদ দেওয়া হয়েছে।

সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন খান প্রচার সম্পাদক পদে আব্বাস উদ্দিনকে রাখার প্রসঙ্গে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাই না। তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতি করে এসেছেন। প্রস্তাবিত কমিটি কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। এটা নিয়ে যখন বসা হবে, সেখানে আমাদের অভিভাবক নুরুল ইসলাম নাহিদও থাকবেন। তাঁরা সিদ্ধান্ত নেবেন।’

স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. শাকির আহমদ শহীন প্রসঙ্গে নাসির উদ্দিন খান বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না।’

সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত কমিটিতে বিগত কমিটির তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক তপন মিত্রকে রাখা হয়নি। তিনি বিগত সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী হয়েছিলেন। তাঁর জায়গায় তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক করা হয়েছে গোলাম সোবহান দীপনকে। তৃণমূল নেতাকর্মীদের অভিযোগ, পেশায় আইনজীবী দীপন বছরের প্রায় পুরোটা সময় ঢাকায় অবস্থান করেন।

আওয়ামী লীগের কোনো পর্যায়ের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা না থাকলেও শুধু পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের ব্যক্তিগত সহকারী হওয়ার সুবাদে মহানগর কমিটিতে স্থান করে নিয়েছেন শফিউল আলম জুয়েল। একইভাবে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেনের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা হওয়ার সুবাদে কমিটিতে স্থান পেয়েছেন অমিতাভ চক্রবর্তী।

সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক দপ্তর সম্পাদক শামসুল ইসলাম বলেন, ‘একপেশে একটি কমিটির তালিকা কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। কেন্দ্রে জমা হওয়া কমিটিতে চাঁদাবাজ ও অনুপ্রবেশকারীরা রয়েছেন বলে আমরা জেনেছি। অতীতে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের আগে সবার মতামত নেওয়া হতো। এবার তা হয়নি।’

জানতে চাইলে সিলেট মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন বলেন, ‘কেন্দ্রের সুস্পষ্ট নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা কমিটি করার চেষ্টা করেছি।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী শফিউল আলম জুয়েলকে কমিটিতে রাখা প্রসঙ্গে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান জাকির হোসেন। তিনি বলেন, ‘কমিটি না আসা পর্যন্ত কোনো ব্যক্তির বিষয়ে আলাদা করে কিছু এই মুহূর্তে বলা ঠিক হবে না।’

নিজের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা অমিতাভ চক্রবর্তীকে কমিটিতে রাখার প্রসঙ্গে জাকির হোসেন বলেন, ‘এটা অপপ্রচার। এখন প্রযুক্তির যুগ, প্রযুক্তি বিষয়ে দক্ষ এবং লেখালেখিতে ভালো দক্ষতা আছে এ রকম একজনকে বিবেচনা করতে গিয়ে আমরা অমিতাভ চক্রবর্তীকে নিয়েছি। বঙ্গবন্ধু এবং জননেত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে তাঁর একাধিক গ্রন্থ রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীকে তিনি ছড়া আকারে লিখছেন।’

খুলনা জেলা কমিটিতে সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে ‘একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প’-এর সাবেক প্রকল্প পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদারকে। আলোচিত ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে মামলা চলমান রয়েছে। কমিটিতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক পদে রাখা হয়েছে গাজী মামুনুর রশিদকে। তিনি কখনো আওয়ামী লীগের মিছিল-সমাবেশে ছিলেন না বলে জানিয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী। সদস্য পদে আছেন অধ্যাপক মনোয়ার হোসেন। তাঁর বাবা নগরীর রূপসা এলাকার ওহাব মোল্লা স্থানীয় লোকজনের কাছে রাজাকার হিসেবে পরিচিত। কমিটিতে সদস্য হিসেবে ডুমুরিয়ায় তালিকাভুক্ত রাজাকারের ছেলে ঢাকায় বসবাসকারী নুরুল ইসলাম বাদশা, রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কহীন রবার্ট নিক্সনের নামও রয়েছে।

সূত্র: কালের কণ্ঠ