জীবিকার তাগিদে চাঁপাই থেকে রাজশাহীতে ধুনকররা

নিজস্ব প্রতিবেদক:


ছবির মানুষগুলো ধুনকর। তারা সবাই চাঁপাইনবাবগঞ্জ শিবগঞ্জের মনাকষা টোকনা গ্রামের বাসিন্দা। এবছরও ওই গ্রামের ৪০ থেকে ৪৫ জন ধুনকর এসেছেন রাজশাহীতে। এসময় গ্রামে কাজের সঙ্কট তাদের। জেলাজুড়ে এই ধুনকররা শীতের লেপ, তোষক, জাজিম ও বালিশ তৈরির কাজ করে। শীতের আগে-পরে মিলে সাড়ে তিন মাস নগরীর মোল্লাপাড়ায় ভাড়া থাকেন ধুনকররা।

বুধবার (৩ নভেম্বর) সকালে সাড়ে ৬টার দিকে নগরীর চারখুটার মোড় কয়েকজন ধুনকরদের দেখা মেলে। তারা জানালেন একই গ্রামের বাসিন্দা তারা। তারা খুব সকালেই বেরিয়ে পড়েন কাজের সন্ধানে। নগরীর বিভিন্ন মহল্লা ছাড়াও আশে-পাশের উপজেলাতে লেপ, তোষক তৈরির কাজ করেন।

ধুনকর জাহাঙ্গীর জানান, ‘আমার ধুনকরের কাজের বয়স ২০ বছর। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া-শোনা করা অবস্থায় রাজশাহীতে এ কাজে আসি। আগে ছোট বাপুর (ছোট চাচা) সঙ্গে রাজশাহীতে আসতাম। বর্তমানে প্রতিবছর একই গ্রামের ৪০ থেকে ৪৫ জন ধুনকর রাজশাহীতে লেপ, তোষক তৈরির কাজে আসি।’

তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই একই গ্রামের বাসিন্দা। সম্পর্কে চাচা, মামা, ভাই- ভাতিজা। রাজশাহীতে একই এলাকায় পাশাপাশি থাকি। কাজের ক্ষেত্রে আলাদাভাবে বের হই। এক সঙ্গে চার থেকে পাঁচজন করে। একই ভাবে সবাই চার-পাঁচজনের দল করে বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় যাই।’

জাহাঙ্গীরের মতই কাজে এসেছেন দুরুল, বাবু, নাঈম ও দুখু। এই পাঁচজনের একটি দল। তারা সকালে এক সঙ্গে কাজের খোঁজে বের হন।

দুরুল ও বাবু জানায়, তারা নিজ এলাকায় বিভিন্ন ধরনের কাজ ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তাদের কেউ আমের ব্যবসা করে, কেউবা কৃষি কাজ করে। তবে বেশির ভাগই দিনমজুরের কাজ করে। বছরের এই শীতের সময়ে তাদের আশেপাশে তেমন কাজ থাকে না। ফলে অলস সময় কাটাতে হয়। তাই বাড়িতে বসে না থেকে তারা রাজশাহীতে কাজের খোঁজে আসেন।

ধুনকর আয়ুব আলী জানান, ‘আমি ২০০৫ সাল থেকে এই কাজ করছি রাজশাহীতে। ভোর পাঁচটার দিকে ঘুম থেকে উঠে রান্নার করে খাই। সকাল সাড়ে ৬টার দিকে বের হয়ে চারকুটার মোড়ে সবাই একত্রিত হই। এর পরে কে কোন এলাকায় যাবে পরামর্শ করে নিই।’

তিনি আরো জানান, ‘দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে চার হাত বাই পাঁচ হাত লম্বাÑ এমন লেপ তৈরি করতে খরচ পড়বে ১৩০০ টাকা। আর শিমুলের তুলার বালিশের খরচ পড়বে ৫ থেকে ৭০০ টাকা। এছাড়া জাজিম তৈরিতে খরচ পড়বে ২৭০০ থেকে ২৮০০ টাকা। বাজারে সবচেয়ে ভালো কার্পাসের তুলা।’

আয়ুব আলী আরো জানান, তাদের গ্রামের ৭০ শতাংশ মানুষ এই ধুনকরের কাজ করে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ঢাকায় গেছে। কেউ গোদাগাড়ী, দিনাজপুর, নাটোর, পাবনা, রংপুরে লেপ তোষক তৈরির কাজে গেছে।

অন্যদিকে, শীত আসাকে কেন্দ্র করে ব্যস্ততা বেড়েছে নগরীর গণপাড়ার ধুনকরপট্টিতে। শীতের এই সময়ে লেপ, তোষকের বিক্রি বাড়ে। ফলে অবিরাম চলে সুঁই-সুতার সেলাই। দেখা গেছে- কেউ কিনছেন, আবার কেউ পছন্দ মত অর্ডার দিয়ে বানিয়ে নিচ্ছেন। ব্যবসায়ীরা বলছেন- তুলনামূলক ভীড় বেড়েছে দোকানগুলোতে।

খালেক এন্ড ব্রাদাসের বিক্রেতা ইসলাম জানান, ফোমের তুলা ১৩০ টাকা কেজি, শিমুল তুলা ৩২৫ টাকা কেজি, কার্পাস তুলা ১২০ টাকা, গার্মেন্টেসের তুলা ৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। তারা নগরীর সাহেববাজার থেকে ৩০ কেজির তুলার বস্তা কিনেন। বিক্রি করছেন লেপ বানিয়ে।

লেপ কিনতে আসা নগরীর দাসপুকুরের দেলোয়ার হোসেন জানান, ‘শীতে লেপের বিকল্প নেই। ব্যবহারের লেপ পুরাতন হয়ে গেছে। গায়ে দিলে ঠান্ডা লাগে। এবার শিমুলের তুলার লেপ বানিয়ে নেব।’

গৃহিণী নিশা ইসলাম জানান, ‘স্বামীর কাজের সুবাদে ঢাকায় থাকতাম। সেখান থেকে রাজশাহীতে এসেছি। তবে শীতের লেপ-তোষক ঢাকাতে থেকে গেছে। এখন নতুন করে কিনতে হচ্ছে। প্রতিবছর রাজশাহীতে বেশি শীত পড়ে। তাই আগেভাগে কিনে নিলাম।’
লক্ষ্মীপুরের রনি বেড হাউজের কারিগর আব্দুস সামাদ জানান, শীতে লেপ বিক্রি বেশি হয়। কাছেই ক্লিনিক-হাসপাতালে দূর-দূরান্ত থেকে আসা রোগি ও তাদের স্বজনরা লেপ কেনেন।

এছাড়া সিঙ্গেল লেপের কাভার ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। ডাবল লেপের কাভার ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া ৪ থেকে ৫ কেজি তুলা লেপ তৈরিতে খরচ পড়ে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা। ভালো মানের হলে ১ হাজার থেকে ১২০০ টাকা দাম।

স/আ