জীবনের পরীক্ষায় পাশ ফেল নেই

একটা খুব ছোট উদাহরণ দিয়ে লেখাটা শুরু করবো। একটা ট্রেন পু ঝিক ঝিক, পু ঝিক ঝিক করে ছুটে চলেছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির ৩০-৩৫ বছরের একটা লোক, তার ছোট দুটো ছেলেমেয়ে আর বউ ভ্রমণে বের হয়েছে। একটা পেপার হাতে নিয়ে লোকটা খুব মনোযোগ সহকারে সেটা পড়ছে। চোখে কালো ফ্রেমের মধ্যে সোনালী ডিজাইন করা চশমা। ট্রেনটা একটা স্টেশনে এসে থামতেই খেলনা বিক্রেতা সেই বগিতে উঠলো। মধ্যবিত্ত লোকটার ছেলেমেয়ে দুটো খেলনাগুলো দেখে কান্না জুড়ে দিলো। লোকটা খুব বিরক্ত হলো। অনেকটা রাগতস্বরে খেলনা বিক্রেতাকে বললো “আপনি সরেন তো এখান থেকে। দেখছেন না আপনাকে দেখে ওরা খেলনা নেবার জন্য কাঁদছে। না সরলে কিন্তু গলা ধাক্কা দিবো”। ট্রেনের মধ্যে খেলনা বিক্রেতা অনেকটা কষ্ট বুকে চেপে একটা কথা বলে গেলো “আপনার বাচ্চা খেললে আমার বাচ্চা খেতে পারবে”। কথাটা খুব ছোট। মাটি থেকে উঠে আসা মানুষের কথা। জীবনবোধের কথা। তবে বুকের খোলা জায়গাটাকে আঘাত দেবার মতো, ঠাণ্ডায় শীতল হওয়া শবদেহের মতো।

জীবনের পরীক্ষা কি তবে এটা, যেটা চোখকে ফাঁকি দিয়ে চোখের বাইরেই থেকে যায়। যেখানে একজন আরেকজনের সাথে নিজের অজান্তে যুক্ত হয়ে যায়। তখন প্রশ্ন জাগে জীবনের পরীক্ষাটা কেমন। এই সময়ে এসে এটা জানা বোধ হয় খুব দরকার হয়ে পড়েছে। কারণ জীবনের পরীক্ষাগুলো কখনো একই রকম হয়না। এক একটা পরিবর্তিত রূপ নিয়ে জীবনের পরীক্ষা মানুষের সামনে এসে দাঁড়ায়। যেখানে গতানুগতিক পরীক্ষার মতো সে পরীক্ষার কোনো প্রশ্ন থাকে না, উত্তরও থাকে না। তবে কিছু একটা থাকে। এই কিছু একটাই একধনের স্পেস বা জায়গা যেখানে অনেক ছোট ছোট ছিদ্র থাকে, যাতে করে সে ছিদ্রের ভিতর দিয়ে অন্ধকারের মধ্যেও আলোর বিন্দু বিন্দু কণা সেখানে ঢুকতে পারে। এ প্রসঙ্গে আমেরিকান লেখক ফ্রেড্ররিক ব্রাউনের ‘নক’ নামের গল্পটির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। জীবনের খুব ছোট একটা অমীমাংসিত গল্প। গল্পটি হলো- ‘দ্য লাস্ট ম্যান অন আর্থ সেট আ রুম। দেয়ার ওয়াজ আ নক অন দা ডোর’। এর বাংলা অনুবাদ হলো, পৃথিবীর সর্বশেষ মানুষটি একাকী একটা রুমে বসে আছেন। হঠাৎ কে যেন তার দরজায় নক করল।

অনেকভাবে এই গল্পটিকে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। যে কারণে জীবনের পরীক্ষায় কখনো কখনো মানুষ ধ্বংসস্তুপের মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকেও অনেকগুলো জানালাকে খুলতে পারে। মানুষ জীবনের পরীক্ষার লড়তে গিয়ে অনেকগুলো দুর্বোধ্য আবেগকে হাতুড়ি বানিয়ে শক্তি সঞ্চয় করে। জীবনের পরীক্ষা যেখানে মানুষকে থামিয়ে দেয়, কঠিন ধাক্কা দিয়ে দাবিয়ে দেয়, সেখান থেকে জেগে উঠার অমিত শক্তিটা মানুষকে অনেকটা পথ ধরে টেনে এগিয়ে নিয়ে যায়। পরীক্ষার খাতার মতো জীবনের খাতায় কল্পনা দিয়ে গল্পটা মানুষকে তার মতো করে লিখতে শেখায়।

 

যদি গল্পটা এমন হয়: সারা পৃথিবী ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। মৃত্যুপুরীর মধ্যে বেঁচে আছে মাত্র একজন। দুঃসহ শুন্যতার দহন জ্বালা বুকে নিয়ে একটা অন্ধকার ঘরে দরজা জানালা বন্ধ করে বসে আছে সে। সে পুরুষ বা নারী যে কেউ হতে পারে। পৃথিবী কি তবে থেমে যাবে। জীবনের পরীক্ষাগুলো তবে কি আর কারো দেওয়া হবে না। এমন একটা সময়ে দরজায় একটা ঠক ঠক আওয়াজ, পিনপতন নীরবতার অচলায়তন ভেঙে হতচকিত চোখ। ঘরের ভিতরে চোখ বন্ধ করে বসে আছে যে, হয়তো তার বিপরীত লিঙ্গের কেউ হবে। কেউ তারা কাউকের চেনা জানে না। তবে জীবনের পরীক্ষা তাদের খুব কাছাকাছি টেনে আনে। যাদের সম্পর্কের বন্ধনে জন্ম নিবে মানুষ। মানুষের পর মানুষ। মানুষের ভিতরে মানুষ। পৃথিবী মরে যাওয়া জনপদের জীবনের পরীক্ষায় সফল হয়ে আবার গড়ে তুলবে সভ্যতা। সভ্যতার পর সভ্যতা। সভ্যতার ভিতরে সভ্যতা।

অনেক টাকা, সম্পদ, ক্ষমতা থাকলেও মানুষ জীবনের পরীক্ষায় সফল হতে পারে না। জীবনের পরীক্ষায় সফল হতে হলে কোনো ফাঁক ফোকড় রাখলে চলে না। বরং সেখানে কঠিন জীবনবোধের দীক্ষা ও শিক্ষা থাকতে হয়। আমেরিকার খুব হিমশীতল এক রাতে রাতে, ধনী এক লোক বৃদ্ধ ও বস্ত্রহীন একজন মানুষকে গরম কাপড় দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো। ধনী লোকটা ঘরের ভিতর বৃদ্ধের জন্য কাপড় আনতে গিয়ে নানা ব্যস্ততায় কাপড় আনার কথা ভুলে গেলো। সকালে সেই বৃদ্ধ লোকটার কথা মনে পড়লে ধনী লোকটা তার মৃতদেহ দেখতে পেলো। ঠান্ডার সাথে লড়তে লড়তে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেও বৃদ্ধ লোকটা একটা চিরকুট হাতে ধরে রেখেছিলো। সেখানে লেখা ছিল “যখন আমার কোন উষ্ণ কাপড় ছিল না, তখন ঠাণ্ডার সাথে লড়াই করার ক্ষমতা আমার ছিল কারণ আমি মানিয়ে নিয়েছিলাম। কিন্তু যখন আপনি আমাকে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তখন আমি আপনার প্রতিশ্রুতির সাথে আসক্ত হয়ে গিয়েছিলাম এবং আমি আমার তীব্র ঠাণ্ডা প্রতিরোধ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলি”।

কথা দিয়ে প্রতিশ্রুতি না রাখলে জীবনের পরীক্ষা উতরে যাওয়া যায় না। জীবনের পরীক্ষায় সফল হতে হলে মানুষকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলকণার মতো বিনীত হতে হয়। ছোট হতে হয়। অনেক ছোটোর ছোট হয়ে বরফের মতো ছোট হতে হতে বরফ গলা পানি হতে হয়। তারপরও জীবনের পরীক্ষা কি এতো সহজ। জীবনের পরীক্ষা মানুষকে আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করে। অপমানে অপমানে ক্ষত বিক্ষত করে। মানুষকে চেনায়। মানুষের ভিতরের মানুষকে চেনায়। চেনা চেনা শহরে অনেক অচেনা রাজাদের অচেনা প্রজাদের চেনায়। প্রজাদের ভিতরের অচেনা রাজাদের চেনায়। তারপর সবাইকে রাজা বানায়। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথের গানটা ভেসে আসে এমন করেই “আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে-নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে?” হয়তো সব মানুষ রাজা হতে পারে না, তবে জীবন পরীক্ষায় সফল হওয়া কেউ কেউ রাজা হয়। আবার জীবন পরীক্ষায় বিফল হওয়া মানুষও রাজা হতে পারে। কারণ সে বিফলতায় ত্যাগ থাকে, স্বেচ্ছায় পরাজয় থাকে, স্বেচ্ছা নির্বাসন থাকে। রাজা মানে রাজ্য নয়, ক্ষমতা নয়, অহংকার নয়, বড়ত্ব নয়, পদ পদবি নয়, রাজা মানে মানুষের জীবনযুদ্ধে এক একটা জয়, এক একটা পরাজয়, ঘাত-প্রতিঘাত। যেখানে জয় পরাজয়, ঘাত প্রতিঘাত বড় কথা নয়, জীবনবোধের নগ্ন প্রাচীর পেরিয়ে বাস্তবতার আগুনে পোড়াটাই বড় কথা। মানুষের পরীক্ষায় ১০০ নম্বরের  মধ্যে ৩৩ পেলে পাশ করা যায়। অথচ জীবনের পরীক্ষায় কোনো পাশ ফেল নেই। মানুষের পরীক্ষার মতো কোনো নম্বর নেই। একটা মানুষ জীবনের পরীক্ষায় লেখার জন্য কোনো খাতা কলম পায় না। অথচ জীবনের পরীক্ষাটা দিয়ে যায় অবলীলায়, রুদ্ধদ্বার বৈঠকের মতো, টান টান উত্তেজনার মতো। সে পরীক্ষায় সে পাশ করেছে না ফেল করেছে সেটা সে কখনো জানতে পারে না। কারণ জীবনের পরীক্ষায় পাশ করাটা যে খুব কঠিন।  বেনজির আহমেদ শুভর এপিঠ-ওপিঠ যেমন। এপিঠে আছে, সন্তানের প্রথম জন্মদিন, বাবা মায়ের নানা আয়োজন; কেক ক্রয়, বন্ধবান্ধব, আত্মীয়স্বজনকে দাওয়াত, লক্ষ টাকার আয়োজন। ওপিঠে আছে, দরজা ঠক ঠক, আম্মাগো আপনার সন্তানের পুরোনো কাপড় আছে আমারে দিবেন, মেয়েটার শীতে কাপড় দিতে পারিনাই, ঠান্ডায় কাঁপতাছে।

এপিঠ ওপিঠের কোন একটা জায়গায় জীবনের পরীক্ষাটা খুব কাছাকাছি থাকে। তবে সেটা বোঝার জন্য একটা মনের মতো মন থাকতে হয়। যেখানে হেলাল হাফিজের “নিউট্রন বোমা বোঝ মানুষ বোঝ না !” বার বার কানের পর্দায় এসে থেমে যায়। তবে তা রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লার “চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়- বিচ্ছেদ নয়” এর মতোই আবার চলতে থাকে জীবনের এক পরীক্ষা থেকে আরেক পরীক্ষায় আমৃত্যু।

 

সূত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন