জীবনযাপনের অধিকার থেকেও বঞ্চিত আফগান নারীরা

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্কঃ

আফগানিস্তানে গত বছর তালেবানরা ক্ষমতা দখলের পর থেকে নারীদের বেঁচে থাকার ন্যূনতম অধিকারটুকুও নেই। নারীদের বিন্দুমাত্র মর্যাদা দিতে রাজি নয় তালেবান জঙ্গিরা। নারীর প্রতি তাদের অমানবিক মনোভাবের নৃশংস চেহারা প্রকট ভাবে ধরা পড়ে পূর্ব আফগানিস্তানে ২২ জুনের ভূমিকম্পের পর। রিখটার স্কেলে ৫.৯ ম্যাগনিচুট ভূকম্পনে কম করে ১ হাজার মানুষ মারা যান এবং দেড় হাজারেরও বেশি মানুষ জখম হন বলে সরকারি গণমাধ্যম বখতার জানায়। এমনিতেই গত বছর তালেবানরা ক্ষমতা দখলের পর থেকেই ব্যাপক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে রয়েছে আফগানিস্তানে। অভাব-অনটনের মধ্যে দিয়ে সাধারণ মানুষ অনাহারে দিন কাটাতে শুরু করেন। ভূমিকম্পের পর পাকতিকা প্রদেশের মানুষ আরও চরম দুর্ভোগে পড়েন। পাকিস্তান সীমান্তবর্তী এলাকায় এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় পুরোপুরি ব্যর্থ তালেবানরা। তালেবান-হাক্কানি জঙ্গিবাদী শাসন দেরিতে হলেও দুর্যোগ মোকাবিলায় কিছুটা উদ্যোগ অবশ্য নেয়। তবে দুর্গতদের উদ্ধারের থেকে তাদের কাছে বেশি গুরুত্ব পায় বিরুদ্ধ মতবাদীদের প্রতি সশস্ত্র আক্রমণ। সেইসঙ্গে উদ্ধারকাজেও তাদের মধ্যে প্রকটভাবে দেখা দেয় অমানবিক নারী বিদ্বেষ। জখম নারীদের বিন্দুমাত্র চিকিৎসা পরিষেবা দিতে অস্বীকার করে তারা। এমনকি, ধংসস্তুপের মধ্যে আটকে থাকা নারীর লাশ উদ্ধারেও তারা সংকীর্ণতার পরিচয় দিয়েছে। ইসলামি শাসনের নামে নারীর মানবাধিকার হরণ করে তাদের সঙ্গে সমানে প্রতারণা করে চলেছে তালেবানরা। বাংলাদেশে সর্বক্ষেত্রে নারীর অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হলেও আফগানিস্তানে চলছে চরম নারী বিদ্বেষ এবং নারীর মৌলিক অধিকারটুকুও ছিনিয়ে নেয়ার সশস্ত্র প্রচেষ্টা।

মানবিক ও অর্থনৈতিক সংকট আফগান নারীদের জীবনে বিধ্বংসী প্রভাব ফেলেছে। নারীর বিরুদ্ধে সকল প্রকার বৈষম্য দূরীকরণ থেকে শুরু করে সমস্ত আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলিকে অনুসমর্থন করলেও আফগানিস্তানের দখলদারি সরকার আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা মেনে চলার ধারে কাছেও নেই। তালেবানরা আফগানিস্তানে শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা থেকে শুরু করে মৌলিক মানবাধিকারের যাবতীয় অধিকার ক্রমাগত ক্ষুণ্ণ করে চলেছে। সেখানকার বিস্তীর্ণ এলাকায় পুরুষ সঙ্গী ছাড়া স্বাস্থ্য পরিষেবা বা পুরুষ স্বাস্থ্যকর্মীদের কাছ থেকে চিকিৎসা গ্রহণও নারীদের জন্য নিষিদ্ধ।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর নারী অধিকারের সহযোগী পরিচালক হিদার বার বলেছেন, ভূমিকম্পে ১ হাজার ১৫০ জন নিহত হওয়ার পরেও তালেবানরা একজন পুরুষ আত্মীয় সঙ্গী ছাড়া নারীকে স্বাস্থ্যসেবা দিতে অস্বীকার করেছে। হিদার বলেন, ‘নারী চিকিৎসায় তালেবান বিধিনিষেধ বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একজন বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা, অনাথ বা পুরুষ বর্জিত পরিবারের কোনও নারী স্বাস্থ্য পরিষেবা পাচ্ছে না! এমনকি, আপনার সঙ্গে যদি পুরুষ আত্মীয় থাকেও, নারী স্বাস্থ্যকর্মী না থাকলে আপনার চিকিৎসা হবে না। মেনে নিতে হবে নিজের দুর্ভাগ্যকে। এমনটাই চলছে এখানে।’

আফগান সংসদের সাবেক ডেপুটি স্পিকার ফওজিয়া কুফি জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে বলেছেন, ‘এখানে নারীর কোনও অধিকার নেই। তাই প্রতিদিনই একজন বা দুজন নারী তালেবানি বর্বরতার কারণে মানসিক অবসাদ থেকে আত্মহত্যা করছেন।’ উচ্চবিদ্যালয়গুলি নারীদের জন্য দরজা ফের খুলে দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিলেও জানা গিয়েছে, গত মার্চ থেকে তালেবানরা ফের নারী শিক্ষার বিরোধিতা শুরু করেছে। নারীশিক্ষার ওপর এই প্রতিবন্ধকতা আফগানিস্তানকে আরও বেশি করে পিছনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। নারীর শিক্ষার মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন তো হচ্ছেই, সেইসঙ্গে নারীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় যে উন্নয়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, তালেবানরা সেটিও ধ্বংস করছে।

প্রায় এক বছর আগে তালেবান ক্ষমতা দখলের পর তাদের মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ প্রকাশ্যে শপথ নিয়েছিলেন, ‘নারীদের অধিকার সুরক্ষিত থাকবে। কোনও ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হবেনা।’ কিন্তু দু-দশক পর তালেবানদের পুনরুত্থানে বোরখা থেকে শুরু করে নারীদের ওপর সমস্ত ধরনের অমানবিক বিধিনিষেধ ফিরে এসেছে। জাতিসংঘের হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেটের মতে, দমনমূলক তালেবান আচরণবিধিতে জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তাঁর মতে, ১১ লক্ষ ছাত্রী বিদ্যালয়ে যাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত। এছাড়াও কঠোর হিজাব বিধি প্রয়োগ, নারী চাকরির অধিকার হরণ, এমনকি, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায়ও নারীর কাজের অধিকারে নিষেধাজ্ঞা, নারীর সাধারণ এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিষেধাজ্ঞা থেকে শুরু করে নারীর সমস্ত মৌলিক অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। মিশেল বলেন, ‘আমি স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, এখন আফগানিস্তানে যেটা হচ্ছে সেটা আসলে নারীর প্রতি প্রাতিষ্ঠানিক, পদ্ধতিগত নিপীড়ন।’

তালেবানরা নারী বিদ্বেষী ৩০টিরও বেশি দমনমূলক নীতি ঘোষণা করেছে। গত এপ্রিলে এই নীতিতেই মাজার-ই-শরীফে প্রকাশ্যে এক নারীর দুই পা কেটে তাকে ক্ষতবিক্ষত করে ১২ বার গুলি করে হত্যা করা হয়। আফগানিস্তানে জাতিসংঘের সহায়তা মিশনের ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক রমিজ আলাকবারভ বলেছেন, ‘আফগানিস্তানে নারীদের যেভাবে শেষ করার চেষ্টা চলছে দুনিয়াতে তার দ্বিতীয় কোনও নজির নেই।’ সম্প্রতি আফগানিস্তানে নারী চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি জানিয়েছে ৫৭ হাজার বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নতুন করে বন্ধ করা হয়েছে। এর আগে ২০২২ সালের আগস্টে তালেবানরা ফের ক্ষমতায় আসার পর বন্ধ হয়েছিল আরও বহু প্রতিষ্ঠান।

এরই মধ্যে ৩০ জুন ইসলামিক ধর্মগুরু এবং উপজাতীয় প্রবীণদের লয়া জিরগা বলে পরিচিত সংগঠনের তিন দিনের সম্মেলনে তালেবানদের ক্ষমতা দখলকে অনুমোদন দেয়ার নাটক মঞ্চস্থ হয়। সম্মেলনে যোগদানকারী আলেম ও ওলামারাও ছাড়া বেশিরভাগই ছিলেন তালেবানদের কর্মকর্তা। তাই এই বৈঠককে ‘প্রতীকী’ বৈঠক বলে কটাক্ষ করেছেন আফগানিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই।

আসলে তালেবানরা নারীর বিন্দুমাত্র স্বাধীনতায় বিশ্বাসী নয়। নারীদের কোনও মর্যাদাই নেই তাদের কাছে। এমনকি, আফগান নাগরিকদের মন জয় করার বা সেখানকার উন্নতি নিয়েও তাদের কোনও মাথাব্যথা নেই।

নারীশক্তির উন্নয়ন ছাড়া যে কোনও দেশ উন্নতি করতে পারেনা, সেই ধারণাটুকুও তাদের নেই।

সম্প্রতি আফগানিস্তানে তালেবানদের আরেকটি সিদ্ধান্ত অবাক করেছে পুরো বিশ্বকে। ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট আশরাফ গনি সরকারকে হটিয়ে দিয়ে পুনরায় আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে তালেবান। তারা ক্ষমতা দখলের পরই আফগানিস্তানের অর্থ মন্ত্রণালয়ে কর্মরত সকল নারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়।

এরপর কোনো কাজ করা ছাড়াই সেসব নারীদের বেতন দিয়ে যাচ্ছিল তালেবান সরকার। কিন্তু বেতনের পরিমাণ অনেক বেশি কমিয়ে দেওয়া হয়। তবে এখন অর্থ মন্ত্রণালয়ে চাকরি করা এসব নারীদের বসিয়ে রেখে আর বেতন দেওয়া হবে না। এসব নারী কর্মচারীদের চাকরিচ্যুত করে সেখানে তাদের পুরুষ আত্মীয়দের চাকরি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তালেবান সরকার। ব্রিটিশ গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, নারী সরকারি চাকুরিজীবীদের বলা হয়েছে, তাদের আর চাকরির জন্য আসতে হবে না। কিন্তু তাদের জায়গায় তাদের কাছের পুরুষ আত্মীয়দের চাকরি দেওয়া হবে। এজন্য নাম চাওয়া হয়েছে।

অর্থাৎ পদ্ধতিগতভাবে ধীরে ধীরে সকল অধিকার থেকে নারীদের বিচ্যুত করা হচ্ছে আফগানিস্তানে। অন্যদিকে, দূর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশের নারীরা। তাই স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী সম্প্রতি যথার্থই বলেছেন, দৃশ্যমান নারীর ক্ষমতায়ন এবং নারীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গৃহীত পদক্ষেপসমূহ বিশ্ব দরবারে রোল মডেল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। তার কথার বাস্তবতা বোঝা যায় বাংলাদেশ সরকারের নারী-পুরুষের লৈঙ্গিক বৈষম্য কমাতে বর্তমান অর্থ বছরে প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করার মাধ্যমে। বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলনেত্রী, জাতীয় সংসদের অধ্যক্ষ থেকে শুরু করে বহু গুরুত্বপূর্ণ শীর্ষ পদে নারীরা দক্ষতার সঙ্গে দেশকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। গ্রামীণ অর্থনীতিতেও নারীদের ভূমিকা অপরিসীম। দেশের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই নারী। তাই বাংলাদেশের ব্যাপক উন্নয়নে সমান অবদান নারীদেরও। তাই নারী শিক্ষা বা নারীর ক্ষমতায়নে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেশের অগ্রযাত্রার পথ সুপ্রশস্ত করে চলেছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে, তালেবান শাসনে নারীকে দাবিয়ে রেখে তালেবানি শাসন আফগানিস্তানকে আরও পিছিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আফগানিস্তানে বিগত দুই দশকে ধীরে ধীরে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠান যেই উদ্যোগ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাচ্ছিলো তার গোঁড়ায় কুড়াল দিয়ে আঘাত করেছে তালেবান সরকার।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

 

 

সুত্রঃ জাগো নিউজ