জলসা-জি বাংলা পরকীয়ায় প্রলুব্ধ করছে, হাইকোর্টকে আইনজীবী

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

ভারতীয় তিনটি টিভি চ্যানেল স্টার জলসা, স্টার প্লাস ও জি বাংলা বন্ধের বিষয়ে রুলের পরবর্তী শুনানি ১৯ জানুয়ারি পর্যন্ত মুলতবি করেছেন হাইকোর্ট।

আজ বুধবার বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি জে বি এম হাসানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ আংশিক শুনানি শেষে এ আদেশ দেন।

শুনানির সময় উভয় পক্ষের আইনজীবীরা এসব চ্যানেলের পক্ষে-বিপক্ষে বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরেন। নিচে বিস্তারিত তুলে ধরা হলো :

রিটকারীর পক্ষে আইনজীবী মো. একলাস উদ্দিন ভূইয়া, রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুর্টি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহের হোসেন সাজু, স্টার জলসা, স্টার প্লাসের পক্ষে রুল শুনানিতে অংশ নেন সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু। অপরদিকে জি বাংলার পক্ষে শুনানি করবেন ব্যারিস্টার সামসুল হাসান।

দুপুরের পর রিটকারী আইনজীবী একলাছ উদ্দিন ভূইয়া তৃতীয় দিনের মতো শুনানিতে বলেন, ‘বাংলাদেশে বিদেশি টেলিভিশন চ্যানেল স্টার জলসা ও স্টার প্লাস, জি বাংলা টিভি প্রদর্শনের মাধ্যমে নারী-পুরুষদের পরকীয়ায় জড়াতে প্রলুব্ধ করা হচ্ছে। দিন দিন সমাজের চরম অবক্ষয় ঘটছে।’

একলাস উদ্দিন বলেন, ‘ছোট ছোট শিশুরা হিন্দি ভাষায় আকৃষ্ট হয়ে নিজস্ব মাতৃভাষা হারিয়ে ফেলছে। অনেক পরিবারে ছোট বাচ্চাগুলো বাংলা ভাষা শেখার পরিবর্তে হিন্দি ভাষায় কথা বলে, যা আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির জন্য চরম ক্ষতি। ভিনদেশি ভাষা আমাদের কোমলমতি শিশুদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।’

আদালতে কয়েকটি পত্রিকার সংবাদ উপস্থাপন করে আইনজীবী বলেন, ‘বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এর ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে। অনেক মহিলা দেখা যায়, এসব সিরিয়ালের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতেও ভুলে যায়। একটি সংবাদে দেখা যায়, নিজের ঘরে আগুনে পুড়ে বাচ্চা মারা যাচ্ছে অথচ মা অন্য বাড়িতে গিয়ে স্টার জলসা দেখেছে। এ তিনটি চ্যানেল বাংলাদেশের মানুষের জন্য এক ধরনের অভিশাপ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘দেশের পুরুষ-নারীদের এসব টিভি চ্যানেলের সিরিয়াল প্রদর্শনের মাধ্যমে পরকীয়ার প্রতি আকৃষ্ট করা হয়। অনেক গৃহবধূ গৃহহীন হয়ে পড়ছে। এসব চ্যানেলে পারিবারিক কূটচাল, বউ-শাশুড়ির ঝগড়া, হিংসাত্মক কার্যক্রমে প্রলুব্ধ করা হয়। এরই মধ্যে এসব কার্যক্রমের কারণে ২০ জনের মতো নারী-পুরুষের আত্মহত্যা ও খুনের ঘটনা ঘটছে। এটি আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির পরিপন্থী। বিভিন্ন টকশোতে দেশীয় মূল্যবোধ হারানো ও সামাজিক অবক্ষয়ের জন্য এসব সিরিয়ালকে দায়ী করা হচ্ছে।’

আইনজীবী মো. একলাস উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, বাংলাদেশে পরিচালনাকারী ক্যাবল নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠানগুলোর লাইসেন্স থাকলেও ক্যাবল টেলিভিশন পরিচালনা আইন ২০০৬-এর ৩, ৪, ৫, ৮, ৯, ১০ ও ১৯ ধারা লঙ্ঘন করা হচ্ছে। এসব চ্যানেলের সম্প্রচার সাময়িক বা স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেওয়া যাবে। ধারা ভঙ্গ করলে এ আইনের ১৫ ও ২০ ধারার আলোকে এসব চ্যানেল বন্ধ করার সুযোগ রয়েছে। ৯ ও ১০ ধারা অনুযায়ী এসব চ্যানেল এসব ধারা লঙ্ঘন করেছে। কেননা এটা শিশুদের মানসিক বিকাশের অন্তরায়।

আইনজীবী আবদুল মতিন খসরু বলেন, ‘আমি স্টার জলসা ও স্টার প্লাসের বাংলাদেশের পরিবেশনকারী প্রতিষ্ঠান ডিজি জাদু ব্রডব্যান্ড লিমিটেডের পক্ষে রুল শুনানিতে অংশ নেব। এই ক্যাবল অপারেটরের মাধ্যমে বিদেশি ১৩টি টিভি চ্যানেল বাংলাদেশে প্রদর্শন করা হয়।’ তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকারের নির্ধারিত বিধি অনুযায়ী এসব চ্যানেল প্রদর্শন করা হচ্ছে। তারা সরকারকে সকল প্রকার কর, ভ্যাট দিয়ে লাইসেন্স নিয়েছে এবং দেশের চ্যানেলগুলোতে প্রদর্শন করা হচ্ছে। এসব চ্যানেল বন্ধ হলে সারা দেশের অনেক গ্রাহক বিনোদন থেকে বঞ্চিত হবে।

এর জবাবে আইনজীবী মো. একলাস উদ্দিন ভূঁইয়া আদালতে বলেন, ‘জনস্বার্থ মামলায় ব্যক্তিস্বার্থ পক্ষভুক্ত হওয়ার সুযোগ নেই। ক্যাবল অপারেটরগুলো লাইসেন্স নিয়ে পরিচালনা করলেও তারা ২০০৬ সালের ক্যাবল টেলিভিশন পরিচালনা আইন ২০০৬-এর ৩, ৪, ৫, ৮, ৯, ১০ ও ১৯ ধারা লঙ্ঘন করা হচ্ছে।

এ সময় আদালত আইনজীবীকে প্রশ্ন করেন, ভারতে বাংলাদেশি কোনো টিভি চ্যানেল কি প্রদর্শন করা হয়?

জবাবে রিটকারী আইনজীবী মো. একলাস উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, বাংলাদেশের কোনো টিভি চ্যানেল ভারতে প্রদর্শন করতে হলে সাড়ে সাত কোটি রুপি দিতে হয়। এতে করে দেশের টিভি চ্যানেলগুলো তেমন প্রদর্শন করা হয় না। অথচ বাংলাদেশে ভারতীয় কোনো টিভি চ্যানেল প্রদর্শন করতে হলে দুই বছরে মাত্র তিন লাখ টাকা দিতে হয়।

এরপর রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু আদালতে বলেন, সারা দেশে মোট ৭০টি বিদেশি টিভি চ্যানেল প্রদর্শিত হয়। বন্ধ করতে হলে সকল বিদেশি চ্যানেল বন্ধ করতে হবে।

আইনজীবী সাজু বলেন, ভারতীয় চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে দেশের নারীরা নষ্ট হচ্ছে না। বরং দেশে মানুষের আয়তনের তুলনায় জায়গা সংকট রয়েছে। খেলার মাঠ নেই। ঘোরার জায়গা নেই। মানুষ ক্রমশ নিজ ঘরের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে পড়ছে। মানসিক স্বস্তির জন্য বিনোদন হিসেবে এসব সিরিয়াল দেখে সময় পার করছে। এসব চ্যানেল বন্ধ হলে দেশের কোটি কোটি দর্শক মনঃক্ষুণ্ণ হবে। এ ছাড়া আজ পর্যন্ত কোনো নাগরিক কোনো আদালতে এসব বিষয়ে মামলা দায়ের করেনি। শুধু এসব টিভি চ্যানেলের সিরিয়াল দেখে নারী-পুরুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না। বরং বহুমাত্রিক সমস্যার অংশ হিসেবে নারীরা পরকীয়া ও আত্মহত্যা করছে। তাই এ মুহূর্তে এসব চ্যানেল বন্ধ করা ঠিক হবে না।

এ বিষয়ে ব্যারিস্টার সামসুল হাসান বলেন, ‘জি বাংলার বাংলাদেশের পরিবেশনকারী প্রতিষ্ঠান নেশন ওয়াইড মিডিয়া লিমিটেডের পক্ষে রুল শুনানিতে পক্ষভুক্ত হয়েছি।  আমি ও আমার টিম আজ রুল শুনানিতে অংশ নেব।’

এ পর্যায়ে আদালত আগামী ১৯ জানুয়ারি এ বিষয়ে পরবর্তী শুনানির জন্য দিন ধার্য করেন।

এর আগে গত ৮, ৯ ও ১০ জানুয়ারি হাইকোর্টে ভারতীয় তিনটি টিভি চ্যানেল স্টার জলসা, স্টার প্লাস ও জি বাংলা বন্ধে জারি করা রুলের শুনানি হয়।

তিনদিনের শুনানিতে রিটকারী আইনজীবী মো. একলাস উদ্দিন ভূঁইয়া আদালতে বলেছেন, ভারতীয় চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত বিভিন্ন ধারাবাহিক সিরিয়াল বাংলাদেশের সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধ ধ্বংস করছে। এর সপক্ষে তিনি পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন আদালতে তুলে ধরেছেন।

২০১৪ সালের ১৯ অক্টোবর এক রিট আবেদনের শুনানি শেষে ভারতীয় এই তিন টিভি চ্যানেল বন্ধে নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। ওই সময় বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ রুল জারি করেন।

রুলে তথ্যসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়ে জবাব দিতে বলা হয়। এর আগে ২০১৪ সালের ৭ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দা শাহীন আরা লাইলি হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় এই রিট দায়ের করেন।

সূত্র: এনটিভি