সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:
- জন্মের সময় নবজাতকের ওজন ২৫০০ গ্রাম হওয়া বাঞ্ছনীয়
- বাংলাদেশে প্রতিবছর ৬ লাখের বেশি শিশু কম ওজন নিয়ে জন্মায়
- কম ওজন নিয়ে যেসব নারী-পুরুষ জন্মেছিলেন, প্রাপ্ত বয়সে তাঁদের মধ্যে স্থূলতা, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের প্রকোপ সঠিক ওজন নিয়ে জন্মানো নারী-পুরুষের চেয়ে বেশি
কম ওজন নিয়ে জন্ম নেওয়া শিশুরা পরিণত বয়সে স্থূল হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে। আর বয়স্ক হলে এদের মধ্যে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের প্রবণতাও বেশি দেখা যায়।
কম জন্ম-ওজন ও তার সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী অসংক্রামক রোগের সম্পর্ক নিয়ে চীনের করা এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
গবেষকেরা বলছেন, জীবনের শুরুর দিকের পুষ্টি-পরিস্থিতি পরবর্তী জীবনে প্রভাব ফেলে। জন্মের সময় ওজন কম হলে পরবর্তী জীবনে শারীরিক গঠন কী হবে, তার কোনো সরল উত্তর নেই। তবে স্থূলতা, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি এদের বেশি থাকে।
চীনের সাংহাইয়ের ১১ হাজার ৫১৫ জন পুরুষ ও ১৩ হাজার ৫৬৯ জন নারীর ওপর এই গবেষণা করা হয়। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীরা এই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁদের গবেষণা নিবন্ধটি ২২ আগস্ট অস্ট্রেলিয়ার জার্নাল অব ডায়াবেটিস-এ ছাপা হয়েছে।
গবেষকেরা বলছেন, অসংক্রামক রোগ (উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, স্থূলতা, ক্যানসার ইত্যাদি) প্রতিরোধে যাঁরা কাজ করছেন, এই গবেষণার ফলাফল তাঁদের সহায়তা করবে।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক শামস-এল-আরেফিন প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে প্রতিবছর ৬ লাখের বেশি শিশু কম ওজন নিয়ে জন্মায়। পাশাপাশি দেশে স্থূলতা, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের প্রকোপ বাড়ছে। সুতরাং সাংহাইয়ের মানুষের ওপর করা গবেষণাটির প্রাসঙ্গিকতা ও গুরুত্ব রয়েছে বাংলাদেশেও।
গবেষণাপদ্ধতি
গবেষণায় অংশ নেওয়া নারীদের বয়স ছিল ৪০ থেকে ৭০ বছরের মধ্যে। পুরুষদের বয়স ছিল ৪০ থেকে ৭৪ বছর। এসব নারী-পুরুষের একটি বড় অংশ ১৯৫৯ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত স্থায়ী চীনা দুর্ভিক্ষের সময় বা তার পরপর জন্মগ্রহণ করেন। এসব নারী-পুরুষের কাছ থেকে তাঁদের জন্ম-ওজন, শিশু বয়সে বুকের দুধ খাওয়ার অভ্যাস, জীবনচর্চার ধরন, খাদ্যাভ্যাস, কায়িক শ্রমের অভ্যাস, পেশাগত ইতিহাস ও দীর্ঘস্থায়ী রোগের তথ্য সংগ্রহ করেন গবেষকেরা।
জন্মের সময় নবজাতকের ওজন ২৫০০ গ্রাম হওয়া বাঞ্ছনীয়। এর চেয়ে কম ওজন হলে তাকে লো বার্থ ওয়েট বা কম জন্ম-ওজন বলা হয়। জন্ম-ওজনের ভিত্তিতে অংশগ্রহণকারীদের চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। ২৫০০ গ্রামের কম, ২৫০০-৩৪৯৯ গ্রাম, ৩৫০০-৩৯৯৯ গ্রাম এবং ৪০০০ গ্রামের বেশি। প্রতি শ্রেণির সঙ্গে পরিণত বয়সে স্থূলতা, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের পরিস্থিতি তুলনা করেছেন গবেষকেরা। অংশগ্রহণকারী ৫ দশমিক ৩ শতাংশ পুরুষের এবং ৬ দশমিক ৯ শতাংশ নারীর জন্ম-ওজন ছিল ২৫০০ গ্রামের কম।
গবেষকেরা দেখেছেন, কম ওজন নিয়ে যেসব নারী-পুরুষ জন্মেছিলেন, প্রাপ্ত বয়সে তাঁদের মধ্যে স্থূলতা, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের প্রকোপ সঠিক ওজন নিয়ে জন্মানো নারী-পুরুষের চেয়ে বেশি। তবে জন্মের সময় কম ওজনের সঙ্গে পরিণত বয়সের স্থূলতা, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের সম্পর্ক সরলরৈখিক না। তাঁরা দেখেছেন, জন্মের পর বুকের দুধ খাওয়া, শিক্ষা অর্জন, মাথাপিছু আয়, ধূমপান, মদ্যপান এবং অবসর কাটানোর সঙ্গে স্থূলতা, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকির সম্পর্ক আছে।
দুষ্ট চক্র
গবেষকেরা বলছেন, কম জন্ম-ওজনের সঙ্গে অপুষ্টির সম্পর্ক রয়েছে। এটা স্বতঃসিদ্ধ যে, গর্ভবতী মা অপুষ্টির শিকার হলে, গর্ভাবস্থায় মায়ের ওজন পর্যাপ্ত পরিমাণে না বাড়লে, তার প্রভাব পড়ে গর্ভে থাকা শিশুর ওপর। গর্ভে অপর্যাপ্ত পুষ্টির পরিবেশে বেড়ে ওঠা ভ্রূণ এমনভাবে অভিযোজিত হয় যে ভ্রূণ শুধু তার মস্তিষ্কের বৃদ্ধিকে নিশ্চিত করে। তার বিনিময়ে অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যেমন অগ্ন্যাশয়, হৃৎপিণ্ড, কিডনি ও শিরদাঁড়াসংলগ্ন মাংসপেশির ব্যাপারে সমঝোতা করে। এই অভিযোজন পরবর্তী সময়ে বিপাকসংক্রান্ত রোগ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে।
এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলো নিয়ে গবেষণার তথ্য চীনের এই গবেষণায় ব্যবহার করা হয়েছে। এসব গবেষণায় বলা হয়েছিল, ভ্রূণ যদি অপুষ্টি বা দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতিতে পড়ে, তবে দীর্ঘ মেয়াদে তা স্বাস্থ্যের ওপর খারাপ পরিণতি ডেকে আনে।
পরিস্থিতি ও করণীয়
বাংলাদেশে বছরে ৩০ থেকে ৩৩ লাখ শিশুর জন্ম হয়। এর মধ্যে ২২ দশমিক ৬ শতাংশ শিশু কম ওজন নিয়ে জন্মায়। এদের মোট সংখ্যা ৬ লাখ ১০ হাজার থেকে ৭ লাখ ৬৫ হাজারের মধ্যে। গর্ভধারণের পর মায়ের ওজন কমপক্ষে ১০ কিলোগ্রাম বৃদ্ধি পাওয়া উচিত। বাংলাদেশে গড় বৃদ্ধির পরিমাণ ৫ কেজি।
শামস-এল-আরেফিন বলেন, কিশোর বয়সে পুষ্টি নিশ্চিত করার পাশাপাশি বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে হবে। প্রতিটি গর্ভবতী নারীর কাঙ্ক্ষিত ওজন বৃদ্ধির ব্যাপারে নজরদারি বাড়াতে হবে। পাশাপাশি জন্ম নেওয়া প্রতিটি শিশুর পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁরা এই গবেষণা ফলাফল তাঁদের প্রচারণার কাজে ব্যবহার করলে মানুষ উপকৃত হবে।