জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে করোনা

করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতিতে গর্ভবতী মায়েদের নিয়মিত চেকআপ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ভাটা পড়েছে। একইসঙ্গে বাল্যবিবাহের সংখ্যাও বাড়ছে। এই সময়ে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহারের হারও কমেছে।

ফলে চলমান পরিস্থিতি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে বিরূপ প্রভাব ফেলবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

আজ ১১ জুলাই বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারি পরিস্থিতিতে ‘কভিড-১৯ কে প্রতিরোধ করি – নারী ও কিশোরীর সুস্বাস্থ্যের অধিকার নিশ্চিত কর”-এই প্রতিপাদ্য নিয়ে দিবসটি পালিত হচ্ছে।

কিন্তু দিবসটি সামনে রেখে বিশেষ কোনো সুখবর নেই। বরং করোনা মহামারির কারণে আর্থিক সংকটে থাকা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার কিশোরী কন্যাদের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়মিত সেবা প্রদান না করায় কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। এ বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট জরিপ না থাকলেও আগামী দুই বছরে বিশ্বে ৪০ লাখ শিশু বাল্যবিয়ের ঝুঁকিতে পড়বে বলে ওয়ার্ল্ড ভিশন ইনটারন্যাশনাল আশঙ্কা প্রকাশ করছে।

জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ)’র এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনা পরিস্থিতির কারণে নিম্ন-মধ্যম আয়ের ১১৪টি দেশে প্রায় চার কোটি ৭০ লাখ নারী আধুনিক পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফলে অনাকাঙ্খিত গর্ভধারণ এবং অনিরাপদ গর্ভপাতের হার বাড়বে। ঝুঁকিতে পড়বে নারী ও মেয়েশিশুর প্রজনন স্বাস্থ্য। বিশেষ করে বাল্যবিয়ের শিকার নারীরা সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়বে।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিভিন্ন দেশে পরিবার পরিকল্পনার চাহিদা পূরণে বাধা, স্বাস্থ্যকর্মীদের সংকট বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে যথাযথ সেবাদানে বিঘ্ন ঘটছে। করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার ভয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সেবা নিতে যাওয়া নারীর সংখ্যাও কমেছে। আর এ  ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে বিভিন্ন দেশের বিদ্যমান লকডাউন ছয় মাস অব্যাহত থাকলে বিশ্বে অতিরিক্ত ৭০ লাখ অনাকাঙ্খিত গর্ভধারণ করবে। এক্ষেত্রে নিরাপদ গর্ভপাত নিয়েও সংকট দেখা দিবে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।

ইতোমধ্যে বাংলাদেশে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন এএফপি মিডিয়া অ্যাডভোকেসি ইনিশিয়েটিভ, বাংলাদেশ-এর টিম লিডার পুলক রাহা। তিনি বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে বাল্যবিয়ের খবর গণমাধ্যমে আসছে। করোনা পরিস্থিতির মধ্যে নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার চাপিলা ইউনিয়নের একটি বালিকা বিদ্যালয়ের ১৩ জন কিশোরীর বিয়ের খবর পাওয়া গেছে। বাল্যবিয়ের ফলে কিশোরী গর্ভধারণের হারও বাড়বে। যা আমাদের জনসংখ্যার ওপর নতুন চাপ সৃষ্টি করবে।

পুলক রাহা আরো বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্র সীমিত আকারে স্বাস্থ্য পরিসেবা চালু রেখেছে। স্বাস্থ্যকর্মীদেরও নিয়মিত পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে হাতের কাছে পরিবার পরিকল্পনার সেবা না পাওয়ায় অনেক নারী অনাকাঙ্খিত গর্ভধারণে বাধ্য হচ্ছে।

করোনাবিষয়ক পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির দেওয়া তথ্য মতে, ২০১৯ সালের মার্চে প্রসবপূর্ব সেবা পাওয়া নারীর সংখ্যা ছিল ৪২ হাজার ৫২৬ জন। ২০২০ সালের মার্চে এই সংখ্যা ৩৬ হাজার ৪১৫ জনে ছিল। গত এপ্রিলে এই সেবা পেয়েছে মাত্র ১৮ হাজার ৬২ জন। করোনা পরিস্থিতির কারণে অধিকাংশ বাড়িতে গর্ভবতী মায়েরা প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যসেবা কর্মীর সেবা পাচ্ছে না। একইসঙ্গে প্রসব পরবর্তী পরিবার পরিকল্পনা সেবাও ব্যাহত হচ্ছে।

এই অবস্থায় পরিবার পরিকল্পনার পলিসিতে কৌশলগত পরিবর্তন আনার কথা বলছেন মেরিস্টোপ বাংলাদেশের অ্যাডভান্স ফ্যামিলি প্লানিং কার্যক্রমের সমন্বয়কারী মনজুন নাহার। তিনি বলেন, পরিবার পরিকল্পনার পলিসিতে কৌশলগত পরিবর্তন করতে না পারলে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহারের হার ২০২২ সালে ৭৫ শতাংশে উন্নিত করার পরিকল্পনা, অপূরণীয় চাহিদা ১২ শতাংশ থেকে নামিয়ে আনা এবং বাল্যবিবাহের হার কমানোর পরিকল্পনা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাবে। এরপর জনসংখ্যা বৃদ্ধির যে চাপ তৈরি হবে, তা সামলানো অনেক কঠিন হয়ে পড়বে। যা দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক ভারাসাম্যকে বিঘ্নিত করবে।

তবে করোনা পরিস্থিতিতে জনগণ যাতে ঘরে বসেই ডিজিটাল সেবা পায়, সে ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সাহান আরা বানু। তিনি বলেন, গর্ভবতী মায়েদের সেবা দেয়ার জন্য ২৪ ঘণ্টা  হাসপাতাল খোলা রাখা হয়েছে। গর্ভবতী মায়েরা বাসায় থেকে নিয়মিত ফোন কলের মাধ্যমেও চিকিৎসকের সেবা নিতে পারছেন। এছাড়া তাঁদের জন্য উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ছাড়াও বিভিন্ন কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে।

সাহান আরা বানু আরো বলেন, এমতাবস্থায় নিবন্ধিত নবদম্পতি যাতে দেরিতে সন্তান নেয়, সে জন্য নিবন্ধীকরণ কেন্দ্রের মাধ্যমে তাদের গিফট বক্স দেওয়া হচ্ছে। এসব বক্সে থাকছে গর্ভনিরোধক এবং তথ্য, শিক্ষা ও উদ্বুদ্ধকরণ (আইইসি) সামগ্রী। দুর্গম এলাকায় প্রথম সারির কর্মীদের চুক্তিবদ্ধ নিয়োগের মাধ্যমে এবং গর্ভবর্তী নারীদের নিবন্ধীকরণের মাধ্যমে পরিবীক্ষণ এ কার্যক্রমকে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য প্রফেসর ডা. মুনসুর রহমান  বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা খাতের ন্যায় পরিবার পরিকল্পনা খাতকে সমান গুরুত্ব দিয়ে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের সমন্বয়ের মাধ্যমে এই সেবাকে আরো শক্তিশালী করতে হবে। অন্যথায় নারী ও কিশোরী স্বাস্থ্য এবং জনসংখ্যার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। সংসদীয় কমিটির পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলেও তিনি জানান।

 

সুত্রঃ কালের কণ্ঠ