জনগণের উপর পুলিশের নির্যাতন ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য

ইংরেজিতে একটি কথা আছে “whoever owns the gold, makes the rules” অর্থাৎ টাকা আছে তো ক্ষমতা আছে। প্রশাসকের এমন মানসিকতা একটি সভ্যতাকে ধ্বংসের দিকে ধাবিত করে। ক্ষমতার মোহ একটি রাষ্ট্রে অশান্তি সৃষ্টি করে। শান্তি বিনষ্ট করে। কথায় আছে সিংহের মত সাহস থাকা ভালো কিন্তু তা যদি সাধারণ মানুষের উপর প্রয়োগ করা হয় তা হয় অন্যায়। দেশের সাধারণ জনগণ, সাংবাদিক ও সমাজকর্মীদের উপর পুলিশ প্রশাসনের অনধিকার প্রভাব খাটানো এমন অন্যায়ের আভাস দেয়। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের পুলিশ দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার নাম করে অনেকটা মারমুখী আচরণ করছেন। পুলিশের এ অসহিষ্ণু আচরণ অনেকটা দিন দিন বেড়েই চলেছে। রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে এটিএন নিউজের দু’জন সাংবাদিকের উপর হামলা সেই বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত দেয়। আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়ের একটি বক্তব্য বিষয়টিকে আরো ঘোলাটে করে তুলেছে।

শাহবাগের ওই সাংবাদিকদ্বয়ের উপর পুলিশের নির্মম নির্যাতনের বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মাননীয় মন্ত্রী বলেছেন, “পুলিশ কখনো সাংবাদিকদের নির্যাতন করে না, কখনো কখনো দায়িত্ব পালনের সময় ধাক্কাধাক্কি লেগে যায়”। মন্ত্রী মহোদয়ের এমন মন্তব্য পুলিশের নির্যাতনের হাতকে আরো বেশী শক্তিশালী করবে। কারণ পুলিশও মানুষ। তাই তাঁদের যে ভুল হবে না এমন ভাবা উচিত নয়। সেকারণে আমরা প্রশ্নই করতে পারি যে, মন্ত্রী মহোদয়ের উল্লেখিত সেই ‘ধাক্কাধাক্কি’ এমনি এমনিতেই হয়েছে না কি পুলিশ সাংবাদিকদের নির্যাতনের বাসনায় তা করেছে? অন্যদিকে, পুলিশ ওই সাংবাদিকদের ধরে নিয়ে লাঠিপেটা করেছে নাকি সাংবাদিকরা কোন চোরাবালির ঘূর্নিঝড়ে/বালিয়াড়িতে পড়ে পুলিশের পায়ের নিচে, বন্দুকের ডগায়, লাঠির নিচে পতিত হয়েছে? দেশের সচেতন জনগণ এসব প্রশ্নের বিচার বিশ্লষণ করবেন। আর মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় ভাববেন যে, আপনি আজকে ওই পুলিশের মালিক কিভাবে হলেন? এর পেছনে দেশের সাধারণ জননগণ ও সাংবাদিকদের কোন ভূমিকা আছে কিনা? অন্যথায় আপনার বক্তব্য ঘৃনাভারে প্রত্যাখ্যান করছি।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে নাগরিকের অধিকার ও সরকারী কর্মচারিদের কর্তব্য অনুচ্ছেদ ২১ (১) তে বলা হয়েছে, “সংবিধান ও আইন মান্যকরা, শৃঙ্খলা রক্ষা করা, নাগরিকদায়িত্ব পালন করা এবং এবং জাতীয় সম্পত্তি রক্ষা করা প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য।” এ ধারার সারমর্ম থেকে বুঝা যায় যেহেতু দেশের সাধারণ জনগণের একাংশ দেশের জাতীয় সম্পদ সুন্দরবন রক্ষার স্বার্থে সুশৃৃঙ্খল আন্দোলন করে যাচ্ছেন তাই সাংবাদিক ভাইয়েরা সে কাজের সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। এটি তাঁদের সম্পূর্ণ বৈধ অধিকার। আর অন্যায়ভাবে পুলিশ যখন কোন নাগরিককে তুলে নিয়ে যেতে চাই সেখানে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সাংবাদিক কর্তৃক ওই বিশৃঙ্খল পরিবেশের ছবি ধারণ করাও তাঁদের পবিত্র কর্তব্যের শামিল। এমন শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সাংবাদিকদের উপর পুলিশের ওই হামলা সম্পূর্ণ বে-আইনি। এছাড়া সংবিধানের উপর্যুক্ত অনুচ্ছেদের উপধারা-(২) তে বলা হয়েছে,  “সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য।” অতএব ২৬ জানুয়ারি, ২০১৭ তারিখে শাহবাগের মোড়ে দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তাবৃন্দ যদি সংবিধানের এই অনুচ্ছেদের প্রতি সামন্য শ্রদ্ধা দেখাতো তবে নিরহ ওই সাংবাদিকদের প্রতি এমন হামলা হতে পারতো না। সাংবাদিকদের কোন ভুল হলেও পুলিশ তাদের সেবার মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসা দরকার ছিল।

 

তাতেই প্রতিষ্ঠিত হতো পরম শান্তি। কিন্তু তা তাঁরা করেন নি। অথচ ওই অপরাধিদের বাঁচাতে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয় সাফাই গাইছেন। অপরাধি যেই হোক তার কর্মের জন্য শাস্তি দেয়া না হলে আরো অপরাধের জন্ম হবে। শুধু দু’একজনকে সাময়িক বরখাস্ত করে বসে থাকলেই চলবে না। আইনসিদ্ধ সব শাস্তিই আপরাধিদেরকে দিতে হবে। শাস্তি দেয়ার পথ উন্মুক্ত করতে হবে। সেজন্য আমি দেশের সকল নির্যাতিত সাংবাদিক ও জনগণের পক্ষে দোষি পুলিশ কর্মকর্তাদের জন্য যথোপযুক্ত শাস্তির দাবি করছি।
দেশের সাধারণ জনগণের প্রতি পুলিশের এসমস্ত পৈশাচিক হামলা এখনই বন্ধ করতে হবে। কারণ হিসেবে এখানে পূর্বঘটিত কিছু বিষয় আমি উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরছি। যে ঘটনাগুলো পুলিশ সদস্যদের হাতে আমরা ঘটতে দেখেছি। যেমন আমরা জানি পুলিশের দায়িত্ব জনগণের জান-মাল রক্ষা করা। কিন্তু বাস্তবে তা তাঁরা কতটুকু করতে পেরেছেন তা আলোচনার বিষয়। কিছুদিন আগে ঢাকার সাভারে গার্মেন্টস শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য মুজুরি আদায়ের জন্য আন্দোলন ও মিছিল মিটিং করে যাচ্ছিলো। এমতবস্থায় পরেরদিন সকালে তারা দেখতে পায় কর্মস্থলের সকল ফ্যাক্টরির প্রধান ফটকে তালা ঝুলানো। আর পুলিশ এসব প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা প্রদানে কাজ করছেন। পুলিশের এমন কাজের জন্য তাঁরা বাহ্বা পেতে পারেন। আমরা তা দিচ্ছি। কিন্তু কাজের জন্য যখন শ্রমিকরা তাদের নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের দিকে এগিয়ে আসতে থাকলো তখন একবারে তুচ্ছ কারণে মহূর্তের মধ্যে ওই কর্মীদের উপর শুরু হলো পুলিশের অমানবিক নির্যাতন। এখানে প্রশ্ন হলো পুলিশের কাজ রাষ্ট্রের জনগণের মাল ও একই সাথে তাদের জান রক্ষা করা। কিন্তু একতরফাভাবে কারো মাল রক্ষা করতে গিয়ে অন্যের জান কেড়ে নেওয়া কতটা যৌক্তিক? এটি দেশের প্রচলিত কোন আইনে আছে কী? শুধু এ ঘটনায় নয়, দিনাজপুরে সাঁওতালদের উপর হামলাসহ সারাদেশে নানাপ্রান্তে সাধারণ মানুষকে নির্যাতন পুলিশের দায়িত্ববোধ ও কর্তব্য নিষ্ঠাকে ভাবিয়ে তুলেছে।
সংবিধান মতে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তারা জনগণের সেবা দেবার শপথ নিয়ে চাকুরিতে নিযুক্ত হন। এর সুবাদে যিনি চাকুরি করেন তিনি বসেন নামি-দামি গদির চেয়ারে। আর তাঁদের মালিক সাধারণ জনগণ বসেন সদ্য মাটিতে। অথবা তাদের কারো জায়গায় হয় না। দুনিয়াতে এমন বৈষম্য আর কতদিন চলবে তা আমরা বলতে পারছি না। রাষ্ট্রীয় এ নীতিটি নিঃসন্দেহে লজ্জার এবং তা পরিবর্তিত হওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি।

 

একজন বঙ্গবন্ধু, সাকিব, মুস্তাফিজ, মিরাজ, , রবিন্দ্রনাথ, নজরুল, হুমায়ন আহমেদ, রুনা লায়লা, নিসাত মুজুমদার , মুহিত তাঁরা ওই নামি-দামি গদিতে না বসে আপন শক্তিতে পৃথিবীর বুকে সৃজনশীলতার যে পরিচয় দিয়েছেন, বাংলাদেশকে পৃথিবীর বুকে যে উচ্চতায় তুলে ধরেছেন, একজন গাড়ি বাড়িতে আধুণিক জীবন যাপন করা বাবুরা তাঁদের জীবদ্দশায় দেশের জন্য কী এমন বড় অর্জন দেখাতে পারবেন? আমার মনে হয় তা দেখানো খুব কঠিন! আমার দেশের একজন সাধারণ মানুষ ভালো ব্যবহার পেলে অন্য মানুষের জন্য প্রাণ দিতে পারে! যা পৃথিবীর অন্য দেশে বিরল। আমাদের পুলিশ বাহিনীকে কাজের মাধ্যমে সেই অবস্থায় পৌছতে হবে। মানুষকে ভালোবেসে বুকে আগলে নিতে হবে। মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়ে মাল রক্ষা করবার দরকার তাদের নেই। সেই আধিকারও তাদের দেয়া হয় নি।তাদেরকে জনগণের জান ও মাল এই দুয়েরই রক্ষক হতে হবে। অন্যথায় একটি দেশে শান্তি স্থাপন সম্ভব হবে না।। মনে রাখতে হবে প্রজাতন্ত্রের সাধারণ জনগণের করের অর্থে বড় সাহেবদের বেতন হয়। আর তা থেকে ব্যয় করে তাঁরা দেশ-বিদেশে বিলাশীতা করে বেড়াচ্ছেন! সব সময় একটি কথা হৃদয়ে যপে যাওয়া উচিত যে, হে প্রিয় বাংলাদেশ যতদিন তোমাতে অতিবাহিত করছি তোমাতে আমাদের ঋণের বোঝা বেড়েই চলেছে। আমরা যেন আমাদের শ্রম নিষ্ঠা সততা ও কাজের বিনিময়ে সেই ঋণ শোধ করতে পারি। রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভখ্যাত সংবাদপত্র বা এর কর্মীদের প্রতি সকল রকমের জুলুম অত্যাচার নিপিড়ন বন্ধ করা হোক। গঠিত হোক ন্যায়ভিত্তিক সুষম সমাজ। শান্তির সোনার বাংলাদেশ।

 

 

লেখক: মো. আবদুল কুদ্দুস
প্রভাষক, বিজনেস স্টাডিজ বিভাগ

সহকারী প্রক্টর
নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, রাজশাহী
ইমেইল: shyamoluits@gmail.com
মোবাইল: ০১৭১৭৮৫৪১০৪