`চোর থেকে কোটিপতি’

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

শুরুটা গাড়ির যন্ত্রণাংশ চুরি দিয়ে। এরপর গাড়ি চুরি থেকে শুরু করে ডাকাতিতে জড়িয়ে পড়ে সে। আর এই চুরি-ডাকাতির মাধ্যমে একসময় সে হয়ে ওঠে কোটিপতি বলে জানান পুলিশ কর্মকর্তারা। গাড়ি চোর থেকে ডাকাত হয়ে ওঠা এই কোটিপতির নাম বিল্লাল হোসেন (৪৫)। পুলিশের দাবি, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় রয়েছে তার আন্তঃজেলা ডাকাত বাহিনী রয়েছে। বিভিন্ন মামলায় অন্তত ১৮ বার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়েছে এই ডাকাত  সর্দার। তবে বেশিদিন তাকে জেলে থাকতে হয়নি।

জামিন নিয়ে প্রতিবারই বেরিয়ে এসে আবারও চুরি-ডাকাতি শুরু। কিন্তু  এবার আর শেষ রক্ষা হলো না তার। খিলগাঁও থানার একটি ডাকাতি মামলায় গ্রেফতারের পর বৃহস্পতিবার (২৩ নভেম্বর) দিবাগত রাতে সে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে বলে দাবি করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা।

কে এই বিল্লাল হোসেন

বিল্লাল হোসেনের গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের সখীপুরের নলুয়া গ্রামে। তার বাবার নাম সৈয়দ আলী। গ্রামের বাড়িতে তার টিনসেড সেমিপাকা বাড়ি। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে বিল্লাল তৃতীয়। বিল্লালের ছোট ভাই দেলোয়ারকে কয়েক বছর আগে জেএমবির সঙ্গে জড়িত সন্দেহে গ্রেফতার করা হয়েছিল।

যেভাবে বিল্লাল গাড়ি ও গাড়ির যন্ত্রাংশ চুরির সঙ্গে জড়ায়

মূলত একটি আস্তগাড়ি চুরি করা ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় গাড়ির যন্ত্রাংশ চুরি করা সহজ। তাই বিল্লাল তার দলবল নিয়ে দামি গাড়ির যান্ত্রাংশ চুরি করতো। এসব যন্ত্রাংশ বিভিন্ন গ্যারেজে ও খুচরা বাজারে বিক্রি করতো। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিবি) ও খিলগাঁও থানা পুলিশ জানিয়েছে, এলাকায় বিল্লালরা একসময় খুবই দরিদ্র ছিল। বিল্লাল নলুয়ায়র পাহাড় কাঞ্চনপুর বিমানবাহিনী ঘাঁটিতে বয় হিসাবে কাজ করে। এরপর এলাকায় চুরির ঘটনার সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা পেলে গ্রাম্য সালিসে তাকে মারধর করে গ্রামছাড়া করা হয়। এরপর বিল্লাল ও তার ভাই মোস্তফা ঢাকায় চলে আসে। ঢাকায় এসে তারা সেই চুরি পেশার সঙ্গেই আবারও জড়িয়ে পড়ে। তারা মূলত গাড়ির যন্ত্রাংশ চুরি করেই বিক্রি করতো। গ্রামে গিয়ে বলতো, তারা ব্যবসা করে।

১৫ মিনিটে দামি গাড়ির যন্ত্রাংশ চুরি

পুলিশ জানিয়েছে, পুরনো মডেলের কোনও কমদামি গাড়িতে তারা হাত দিতো না। তাদের টার্গেট সব দামি গাড়ি। মূলত দামিগাড়ির যন্ত্রাংশ তারা চুরি করতো। দামি গাড়ির ডেকোরেশন যন্ত্রাংশ, বাতি, ড্যাশবোর্ডের অংশ—এ সবই শুধু তারা চুরি করতো। টয়োটা, মিতসুবিশি, নিশানসহ জাপানি ব্র্যান্ডের যেকোনও গাড়ির যন্ত্রাংশ খুলতে দু’জনের সময় লাগে ১৫ মিনিট।

গাড়ির যন্ত্রাংশ চুরি করে বিল্লাল কোটিপতি

২০১০ সালের এপ্রিলে একবার রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থেকে বিল্লাল হোসেনকে গ্রেফতার করেছিল ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তখন জানা যায় তার সম্পত্তির পাহাড়ের কথা। এ সময় নরসিংদী, টাঙ্গাইল ও ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে গাড়ির চুরি করা খুচরা যন্ত্রাংশ ও আস্ত গাড়ি উদ্ধার করে ডিবি। পরবর্তী সময়ে কয়েকমাস জেল খেটে সে জামিনে বের হয়ে আসে। ঢাকার আশুলিয়ায় তার বাড়ি রয়েছে, গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের সখীপুরে রয়েছে বাগানবাড়িসহ আরও কিছু সম্পত্তি। নিজের গাড়ি রয়েছে গাড়ি, ট্রাক, পিকআপ। একযুগেরও বেশি সময় ধরে চুরি করে তারা প্রায় দশকোটি টাকার মালিক হয়েছে।

পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিল্লালের বিরুদ্ধে অনেক মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে।

২০১০ সালের ২৯ ডিসেম্বর রাতের ঘটনা। গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের চট্টগ্রাম নগরের নন্দনকাননের বাড়ির গ্যারেজে থাকা একটি গাড়ির যন্ত্রাংশ চুরি করে একদল চোর। তারা বাড়ির একটি ফ্ল্যাট থেকে সাতটি মুঠোফোনও চুরি করে। এরপর ওই মোবাইল ফোনের সূত্রধরে গ্রেফতার করা হয় বিল্লাল হোসেন, তার গাড়ি চালাক জাকারিয়া ইসলাম ওরফে মাসুদ ও সুমনকে।

গ্রেফতারের পর যেভাবে বন্দুকযুদ্ধে মারা যায় বিল্লাল হোসেন

গত অক্টোবরে খিলগাঁওয় থানা এলাকার একটি বাসায় ডাকাতির ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় ২২ অক্টোবর খিলগাঁও থানায় ডাকাতির মামলা দায়ের করা হয়। মামলা নম্বর ৪৮। এই মামলায় প্রথমে দু’জনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে নাম আসে বিল্লালের। এরপর গতকাল সন্ধ্যায় ডেমরা এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় বিল্লালকে। ডিএমপির মতিঝিল বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘তাকে গ্রেফতারের পর অভিযানে যায় পুলিশ। খিলগাঁওয়ের মোস্তফা মাঝিরঘাট এলাকায় যাওয়ার পর তার সহযোগীরা পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে গুলি ছোড়ে। পুলিশও পাল্টা গুলি করে। এ সময় বিল্লাল গুলিবিদ্ধ হয়। তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠালে সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ঘটনাস্থল থেকে একটি শর্টগান ও পাঁচ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করে পুলিশ।’

পুলিশের ধারণা উদ্ধারকৃত অস্ত্রটি হয়তো সে কোথাও থেকে চুরি বা ডাকাতি করে নিয়ে এসেছে।

গ্রেফতারের পর বন্দুকযুদ্ধে আসামির মৃত্যুর বিষয়ে পুলিশের বক্তব্য

নিহত বিল্লালের বিরুদ্ধে ডিএমপি ছাড়াও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বর্তমানে দশটি মামলার তথ্য পেয়েছে পুলিশ। রাজধানীর মোহাম্মদপুর, মিরপুর, কাফরুল থানায় পৃথক ডাকাতির মামলা রয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রামের পাহাড়তলী ও কুমিল্লায় তার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। ২০০৯ সাল থেকে তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা চলছে। এসব মামলার কোনটিতে অভিযোগপত্র আসামি সে, কোনটির তদন্ত চলছে। কিছু মামলায় জামিনে থাকলেও কয়েকটি মামলায় তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে।

ডিসি আনোয়ার হোসেন বলেন,  ‘আমরা আরও খোঁজ নিয়ে দেখছি, দেশের অন্য কোথাও মামলা আছে কিনা।’ তিনি বলেন, ‘আমরা আসামিকে নিয়ে যখন অভিযানে যাই, তখন যথেষ্ট নিরাপত্তা নেওয়া হয়। এবারও তাই হয়েছিল। কিন্তু তার সহযোগিরা পুলিশকে লক্ষ করে গুলি করে, এতে আমাদের তিন জন পুলিশ সদস্য আহত হয়। নিহত বিল্লালের কাদের গুলিতে মৃত্যু হয়েছে, তা ময়নাতদন্তের পর জানা যাবে।’ বাংলা ট্বিবিউন