চীনে ঘরোয়া শরীরচর্চার প্রসার ও একজন লিউ ক্যংহুং

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্কঃ

আমার ছেলে বেইজিংয়ের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীর (গ্রেড) ছাত্র। বাসা থেকে তার স্কুল মিনিট পাঁচেকের হাঁটাপথ। চীন আন্তর্জাতিক বেতারে যেসব বিদেশি কাজ করেন, তাদের অনেকের বাচ্চাই এই স্কুলে পড়ে বা পড়েছে। স্কুলে আমার ছেলেকে—অন্য চীনা ও বিদেশি বাচ্চাদের মতোই—গণিত, বিজ্ঞান, ইংরেজি ভাষা, ও চীনা ভাষা শিখতে হয়। পাশাপাশি, তাদেরকে নিয়মিত নৈতিকতা, কায়িক শ্রম, ও খেলাধুলার ক্লাসেও অংশগ্রহণ করতে হয়।

বিষয় হিসেবে নৈতিকতা ও খেলাধুলা প্রথম শ্রেণী থেকেই ছিল। তৃতীয় শ্রেণীতে এসে যুক্ত হয়েছে ‘কায়িক শ্রম’। আমার ছেলের ভাষায় ‘লেবার ক্লাস’। শুনেছি, আগে একসময় চীনের বিদ্যালয়গুলোতে কায়িক শ্রমের ক্লাস ছিল বাধ্যতামূলক। তখন শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভিন্ন ধরনের কাজ শেখানো হতো। এসব কাজের মধ্যে নিজের কাপড়-চোপড় গোছানো থেকে শুরু করে কৃষিকাজ পর্যন্ত প্রায় সবকিছুই অন্তর্ভুক্ত ছিল। মাঝখানে একটা লম্বা সময় পাঠ্যসূচি থেকে ‘কায়িক শ্রম’ বিষয়টি তুলে দেওয়া হয়।

 চীনের প্রতিটি বিদ্যালয়ের নিজস্ব খেলার মাঠ আছে। স্পোর্টসের ক্লাসগুলো মূলত মাঠেই হয়। কিন্তু যতদিন মহামারীর প্রভাব পুরোপুরি না-কাটছে, যতদিন শিক্ষার্থীরা অফলাইনে ক্লাস করার সুযোগ না-পাচ্ছে, ততদিন এই মাঠগুলো বিরান পড়ে থাকবে। মাঝখানের এই সময়টা শিক্ষার্থীরা অনলাইনে ক্লাস করবে এবং লিউ ক্যংহুং-য়ের মতো ফ্রি ট্রেনারদের ভিডিও-ক্লিপ দেখে দেখে ঘরোয়া শরীরচর্চা চালিয়ে যাবে

আগামী সেপ্টেম্বর থেকে চীনের বিদ্যালয়গুলোতে আবারও নতুন করে পাঠ্যসূচিতে ‘কায়িক শ্রম’ বিষয়টি যুক্ত হতে যাচ্ছে। ধারণা করছি, আমার ছেলের স্কুলের পাঠ্যসূচিতে একটু আগেভাগেই পরীক্ষামূলকভাবে বিষয়টি যুক্ত করা হয়েছে। এখানে একটি কথা জানিয়ে রাখি, চীনে সাধারণত হুট করে কোনো নতুন সিদ্ধান্ত বা নীতি জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় না। সরকার নতুন কোনো সিদ্ধান্ত বা নীতি গ্রহণের আগে, সে-সম্পর্কে বিভিন্ন মাধ্যমে জনগণের মতামত সংগ্রহ করে এবং সেসব মতামতের ভিত্তিতেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়।

জরুরি পরিস্থিতির কথা অবশ্য আলাদা। তখন দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হয় এবং সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতামতকেই প্রাধান্য দিতে হয়। ঘটা করে জনগণের মতামত সংগ্রহ করার সময় ও সুযোগ কোনোটাই তখন আর থাকে না। যেমন, ২০১৯ সালের শেষ দিকে যখন উহানে প্রথম মহামারী দেখা দিল, তখন তা মোকাবিলায় করণীয় ঠিক করতে চীনা সরকার সম্পূর্ণ নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতামতের ওপর। অবশ্য, চিকিত্সা-বিজ্ঞানীদের পরামর্শ নেওয়ার আগে সরকারকে একটি মূলনীতি গ্রহণ করতে হয়েছিল। আর সেই মূলনীতিটি ছিল: ‘যে-কোনো মুল্যে মানুষের জীবন বাঁচাতে হবে।’ সরকারের মূলনীতি এবং সে-অনুসারে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ বাস্তবায়নের ইতিবাচক ফল বিশ্ব দেখেছে ও দেখছে।

বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ বাস্তবায়নের ফলে জনগণের স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হয়নি, তা নয়; হয়েছে ও হচ্ছে। উহান থেকে শাংহাই হয়ে এখন খোদ রাজধানী বেইজিংয়ের জন্যও এ কথা প্রযোজ্য। আমাদেরকে এখন বাসা থেকে অফিস করতে হচ্ছে; ঘন ঘন কোভিড টেস্ট করাতে হচ্ছে। অমিক্রনের প্রকোপ দেখা দেওয়ার পর, বিগত এক মাস ধরে বেইজিংয়ের স্কুলগুলোও বন্ধ।

আমার ছেলের মতো হাজার হাজার শিক্ষার্থী অনলাইনে ক্লাস করছে। শিশু-শিক্ষার্থীদের অনলাইন ক্লাস মানে অভিভাবকদের জন্য অতিরিক্ত কাজ। পাহারা দিতে হয়। খেয়াল রাখতে হয়, ছেলে শিক্ষকের কথা শুনছে, নাকি সহপাঠীদের সঙ্গে চ্যাট করছে! তো, ছেলের অনলাইন ক্লাসের ওপর নজর রাখতে গিয়েই লিউ ক্যংহুং-এর নাম আবারও শুনি আমি।

jagonews24

আমার ছেলে স্পোর্টসের বিষয় হিসেবে স্কুলে রোলার স্কেটিং শেখে। বাসায় বসে অনলাইনে রোলার স্কেটিং করা সম্ভব নয়। তাই, অনলাইন স্পোর্টস ক্লাসে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক মূলত ঘরোয়া টাইপের শরীরচর্চার ওপর জোর দেন। একদিন দেখি ছেলের ল্যাপটপে একটি ভিডিও ক্লিপ রান করছে। ভিডিও ক্লিপে মাঝবয়সী এক লোক অ্যারোবিক এক্সারসাইজ বা খালি হাতে শরীরচর্চা করছেন। আমার ছেলেও তাকে অনুকরণ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমি জানতে চাইলাম: ‘ইনি কি তোমাদের স্পোর্টস টিচার?’ ছেলে বলল, ‘না, তাঁর নাম লিউ ক্যংহুং।’

লিউ ক্যংহুং চীনের জনপ্রিয় গায়ক। বয়স ৪৯। টিকটকের চীনা সংস্করণ তৌইন-এ স্বাভাবিকভাবেই তাঁর ফলোয়ারের সংখ্যা অনেক। তবে, সম্প্রতি এ সংখ্যা রকেটের গতিতে বেড়ে সাড়ে ৫ কোটি ছাড়িয়েছে। আর এর মূল কারণ হচ্ছে সেসব ভিডিও ক্লিপ, যেগুলোর একটা আমি দেখেছি ছেলের ল্যাপটপে, অনলাইন ক্লাস চলাকালে।

লিউ নিজের বাসায় বন্ধু জে চৌ-এর দ্রুতলয়ের গানের তালে তালে খালি হাতে শরীরচর্চার বিভিন্ন কৌশল রেকর্ড করেন এবং সেগুলো তৌইন-এ পোস্ট করেন। তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল, মহামারী পরিস্থিতিতে ঘরে বসেই, খালি হাতে শরীরচর্চা করে, শারীরিক ও মানসিকভাবে ফিট থাকতে নিজের ফলোয়ারদের উদ্বুদ্ধ করা। দৃশ্যত, তাঁর উদ্দেশ্য সফল হয়েছে।

কোটি কোটি ফলোয়ার তাকে গ্রহণ করেছেন একজন ‘ট্রেনার’ হিসেবে। শানতুং নর্মল বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েই ফাং তাদের অন্যতম। তিনি লিউ-কে অনুসরণ করে মাত্র এক সপ্তাহে সাড়ে তিন কেজি ওজন কমিয়েছেন বলে জানান চায়না ডেইলিকে। তিনি মজা করে বলেন: ‘একজন স্টারকে নিজের ব্যক্তিগত ট্রেনার হিসেবে নেওয়ার এ সুযোগ আমি হাত ছাড়া করি কীভাবে!?’

মহামারির কারণে চীনের বিভিন্ন জিম ও ফিটনেস সেন্টারে মানুষের আনাগোনা সীমিত হয়ে গেছে। তা ছাড়া, কোনো কোনো এলাকায় লকডাউনের কারণে লোকজনকে অধিকাংশ সময় বাসাতেই কাটাতে হয়। এ অবস্থায় তাদের অধিকাংশের সামনে ঘরোয়া শরীরচর্চার মাধ্যমে শারীরিক ও মানসিকভাবে ফিট থাকার কোনো বিকল্প নেই। এটা সত্য যে, আজকাল স্বচ্ছল চীনাদের মাঝে নিজেদের বাড়িতে মিনি জিম গড়ে তোলার প্রবণতা বেড়েছে। তবে, তাদের সংখ্যা এখনও তুলনামূলকভাবে অনেক কম।

আসলে, মহামারির আগেও চীনের বিভিন্ন চ্যানেলে প্রচারিত অ্যারোবিক এক্সারসাইজ প্রোগ্রামগুলো যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিল। এখন বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যমের কল্যাণে ঘরোয়া শরীরচর্চার শর্ট ভিডিও এন্তার। লিউ ক্যংহুং-এর মতো অনেক স্টারও এ ধরনের শর্ট ভিডিও তৈরি করে পোস্ট করছেন। আধুনিক জিমে যেতে নগদ টাকা গুনতে হয়। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যমের শর্ট ভিডিওগুলো ফ্রি।

এ ধরনের ভিডিও-নির্মাতা ও ভিডিওর সংখ্যাও দ্রুত বাড়ছে। একমাত্র তৌইন প্লাটফর্মেই ২০২১ সালে ফিটনেট ভিডিওর সংখ্যা ১৩৪ শতাংশ বেড়েছে এবং লিউ-র মতো ফিটনেস ট্রেনারদের অনুসারীর সংখ্যা বেড়েছে ২০৮ শতাংশ। তা ছাড়া, মহামারী দেখা দেওয়ার পর চীনে ফিটনেস অ্যাপ ডাউনলোডের সংখ্যাও ব্যাপকভাবে বেড়েছে।

সবাই যে শুধু ফ্রি ভিডিও দেখে দেখে ঘরোয়া শরীরচর্চা করছেন, তা নয়; অনেকেই অনলাইনে রীতিমতো পয়সা খরচ করে ফিটনেস কোর্সও করছেন। গত এপ্রিলে চীনের অলিম্পিক স্প্রিন্টার সু পিংথিয়ান একটি অনলাইন ফিটনেস কোর্স চালু করেন। যতদূর জানি, তিনি ভালোই সাড়া পাচ্ছেন। এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই বিদেশিরাও। লাইফস্টাইল প্লাটফর্ম চিয়াওহুংশু-তে জার্মান ফিটনেস মডেল পামেলা রেইফের অনুসারীর সংখ্যা ইতোমধ্যেই ৮৩ লাখ ছাড়িয়েছে।

jagonews24

চীনে ঘরোয়া শরীরচর্চাকারীর সংখ্যা বাড়ায়, বেড়েছে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পণ্যের বিক্রিবাট্টাও। সম্প্রতি চিনতুং ইন্সটিটিউট অব কনসুমার অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। রিপোর্ট অনুসারে, ঘরোয়া শরীরচর্চার জন্য প্রচলিত জুতা ও ব্যাগের বিক্রি যথাক্রমে ৮১৬ শতাংশ ও ১০৪ শতাংশ বেড়েছে। এদিকে, চীনা সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ গত ২৮ এপ্রিল কিছু অনলাইন গেমস বাজারে ছেড়েছে। এসব অনলাইন গেমসের লক্ষ্য লোকজনকে শারীরিক ফিটনেসের প্রতি আগ্রহী করে তোলা।

চীনা সরকার ইদানিং চীনাদের শারীরিক ফিটনেসের ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে। ধারণা করি, সেপ্টেম্বর থেকে বিভিন্ন স্তরের বিদ্যালয়ে ‘কায়িক শ্রম’-এর ক্লাস বাধ্যতামূলক করার একটা মূল কারণ ফিটনেস। তা ছাড়া, বিদ্যালয় পর্যায়ে খেলাধুলার ওপরও আগের তুলনায় অধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের জন্য খেলাধুলার সময় বাড়াতে বাড়ির কাজের চাপ ইতোমধ্যেই যথেষ্ট কমানো হয়েছে। আগে স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষার গ্রেডিংয়ের ওপর স্পোর্টসের কোনো প্রভাব ছিল না।

আমার ছেলের কথাই ধরি। এখন পর্যন্ত গণিত, ইংরেজি, ও চীনা ভাষার পরীক্ষার ফলাফলের ওপরই তার ক্লাসের শিক্ষার্থীদের গ্রেডিং নির্ভর করে। কিন্তু চতুর্থ শ্রেণীতে ওঠার পর এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে বলে আমাদেরকে স্কুল থেকে জানানো হয়েছে। এর মানে, তখন স্পোর্টস বিষয়ের ফলাফলের সরাসরি প্রভাব পড়বে গ্রেডিংয়ের ওপর। নতুন এই নিয়মও করা হয়েছে শিক্ষার্থীদের খেলাধুলায় বেশি সম্পৃক্ত করতে। আর এর চূড়ান্ত লক্ষ্য শারীরিক ও মানসিক ফিটনেস।

চীনের প্রতিটি বিদ্যালয়ের নিজস্ব খেলার মাঠ আছে। স্পোর্টসের ক্লাসগুলো মূলত মাঠেই হয়। কিন্তু যতদিন মহামারীর প্রভাব পুরোপুরি না-কাটছে, যতদিন শিক্ষার্থীরা অফলাইনে ক্লাস করার সুযোগ না-পাচ্ছে, ততদিন এই মাঠগুলো বিরান পড়ে থাকবে।

মাঝখানের এই সময়টা শিক্ষার্থীরা অনলাইনে ক্লাস করবে এবং লিউ ক্যংহুং-য়ের মতো ফ্রি ট্রেনারদের ভিডিও-ক্লিপ দেখে দেখে ঘরোয়া শরীরচর্চা চালিয়ে যাবে। আমার মতো অভিভাবকদেরও রেহাই নেই; নজরদারি চালিয়ে যেতে হবে সন্তানের অনলাইন অ্যাক্টিভিটির ওপর।

লেখক : বার্তাসম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি), বেইজিং।
alimulh@yahoo.com

 

সুত্রঃ জাগো নিউজ