চিনে নিন আরেক হিটলারকে!

সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক: তার নাম পল পট। একজন কট্টরপন্থী কমিউনিস্ট নেতা। প্রশংসাকারীদের কথায়, বিপ্লবী। তবে নিন্দুকেরা বলেন, পল একনায়ক, যিনি ভীষ নিষ্ঠুর। নৃশংসতায় বিশ্বব্যাপী ঘৃণিত সেই হিটলারের চেয়ে কোনও অংশে কম নন তিনি। চার বছর একটি দেশের সর্বময় কর্তা ছিলেন। ওই চার বছরে দেশের এক চতুর্থাংশ মানুষ মারা গিয়েছিল, যার অধিকাংশকেই হত্যা করা হয়েছিল তার নির্দেশে।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ছোট্ট দেশ কম্বোডিয়া। এক সময়ের হিন্দুরাষ্ট্র। নাম ছিল কম্বোজদেশা। তা থেকেই কম্পুচিয়া হয়ে নাম হয় কম্বোডিয়া। পল পটের নেতৃত্বাধীন সরকার ওই দেশের লাখ লাখ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করেছিল। ওই সময়েই আরও ২০ লাখ কম্বোডিয়ানের মৃত্যু হয়েছিল না খেতে পেয়ে, হাড়ভাঙা পরিশ্রম কিংবা মাত্রাতিরিক্তি ক্লান্তিতে।

১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯। চার বছর কম্বোডিয়া শাসন করেছিল পলের নেতৃত্বাধীন সরকার ‘খামের রুজ’। ওই চার বছরে কম্বোডিয়ায় প্রায় ২৫ থেকে ৩০ লাখ মানুষ মারা যান। ২০০৯ সালে কম্বোডিয়ার সরকারি তথ্য কেন্দ্র ‘ডকুমেন্টেশন সেন্টার অব কম্বোডিয়া’ জানিয়েছিল সে সময়ের প্রায় ২৩ হাজার ৭৪৫টি গণকবর খুঁড়ে অন্তত ১৩ লাখ মানুষের দেহাবশেষ পাওয়া গেছে। তদের নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল পলের খামের রুজ সরকার।

হিটলারের ১২ বছরের একনায়কত্বে গণহত্যার শিকার হয়েছিলন ৬০ লাখ মানুষ। পলের চার বছরে ৩০ লাখ হত্যা শতাংশের হিসেবে অনেকটাই বেশি। যদিও পল নাকি সমাজ সংস্কার করতে চেয়েছিলেন। মার্ক্স-লেনিনীয় কমিউনিস্ট ধারার পন্থী ছিলেন। কৃষিভিত্তিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করাই নাকি লক্ষ্য ছিল তার।

কৃষিভিত্তিক সমাজতন্ত্র সরলভাবে বাঁচার কথা বলে। এই সমাজে জমিই উৎপাদনের ভিত্তি। কৃষিকাজ বাঁচার উপায়। এই ব্যবস্থায় সবাই নিজের প্রয়োজন মতো উৎপাদন করবে এবং জীবনধারণের প্রয়োজন অনুযায়ী পণ্য গ্রহণ করবে। জমি কারও মালিকানাধীন থাকবে না। ফলে কারও জোরও থাকবে না।

পল নাকি এমনই সমাজ চেয়েছিলেন। তাহলে সমস্যা বাধল কোথায়?পলের নীতির প্রশংসাকারীরা বলেন, তিনি ছিলেন একজন আপাদমস্তক বিপ্লবী। তারা বলতেন, পল যখন জেগে থাকেন তখন প্রতি মুহূর্ত তিনি বিপ্লবের কথা ভাবেন। যখন ঘুমান তখনও স্বপ্ন দেখেন বিপ্লবেরই। কিন্তু সাম্যবাদের পক্ষে বিপ্লব একনায়কত্বে পরিণত হল কীভাবে?

শোনা যায়, পলের নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। তার বক্তৃতা শুনে মুহূর্তে উদ্বুদ্ধ হতেন তার অনুগামীরা। সেই সময় কম্বোডিয়ার বহু শিক্ষিত এবং বোদ্ধা পলের নীতির অনুসারী হয়েছিলেন। কৃষিভিত্তিক সমাজতন্ত্র গড়ার লক্ষ্যে শুরু করেছিলেন সংস্কারের কাজ। কিন্তু সেই প্রক্রিয়ায় যারাই তাদের সঙ্গ দিতে পারেননি তাদের হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয়েছে। হত্যার শিকার হতে হয়েছে তাদেরও যাদের ভয় পেয়েছিল খামের রুজ সরকার।

অতিশিক্ষিতদের ভয় পেত পলের সরকার। যুক্তি ছিল, তাদের সমাজ সংস্কারের পথে তারা বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেন। মানুষকে ‘ভুল’ বোঝাতে পারেন। এমনকি তাদের পাল্টা বিপ্লবে উদ্বুদ্ধও করতে পারেন।একই যুক্তিতে যারা কম্বোডিয়ার পূর্বতন সরকারের ঘনিষ্ঠ ছিলেন, পূর্বতন সরকারের সমর্থক ছিলেন, তাদেরও গ্রেফতার করা হত। একাধিক ভাষা বলতে পারাকেও বিপদ ভাবা হত। এমনকি কেউ চশমা পরলেও তাকে বুদ্ধিজীবী তকমা দিয়ে কারাগারে বন্দি করত পলের সেনারা।

এই সেনাদের চরমপন্থী মনোভাব দেখানোর নির্দেশ ছিল সরকারের পক্ষ থেকে। গ্রেফতার হওয়া ‘সম্ভাব্য বিপদ’দের তারা হত্যা করেই দম নিতেন। কারাগারের কাছের একটি মাঠের নামই হয়ে গিয়েছিল কিলিং ফিল্ড বা হত্যা ময়দান। সেখানে গণহত্যা করা হত বন্দিদের।

তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম কম্বোডিয়া। আর্থিক সহায়তা বিদেশ থেকেও আসত বলে জানা গেছে। তবে বন্দি হত্যায় অযথা গুলোর অপচয় করত না পলের সেনাবাহিনী। ইতিহাসবিদরা জানিয়েছেন, বন্দিদের নৃশংসভাবে কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে গণকবর দিত তারা।

পল পট নামটি বেশ অদ্ভুত। কম্বোডিয়ান ভাষায় এর অর্থ ‘সাচ্চা কম্বোডিয়ান’। পল নিজেকে তা-ই মনে করতেন। নিজের নাম নিজেই রেখেছিলেন তিনি। তার আসল নাম ছিল সালোথ জার। এক কৃষি পরিবারে জন্মেছিলেন পল। ১৯২৫ সালের ১৯ মে কম্বোডিয়ার রাজধানী শহরে জন্ম পলের। রাজপরিবারের ঘনিষ্ঠ ছিল তার পরিবার।

পরে কম্বোডিয়া যখন ফরাসিদের উপনিবেশ হল, তখনও পল ফরাসিদের তৈরি ও অনুগামীদের স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। পড়াশোনায় কোনওদিনই ভাল ছিলেন না। কলেজে ভর্তি হলেও ডিগ্রি পাননি। মাঝপথে পড়া ছেড়ে কাঠের কাজ শিখতে যান। সেখানেই কম্বোডিয়ার এক কমিউনিস্টপন্থী বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে তার পরিচয়। যিনি পরে পলের সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে অভিষিক্ত হন।

রাজ পরিবারের অন্দরমহলে যাতায়াত ছিল পলের। অল্প বয়সেই রাজার রক্ষিতাদের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন বলে তার জীবনিকারেরাই এ কথা লিখেছেন বিভিন্ন বইয়ে। পরে অবশ্য কাঠের কাজ নিয়ে পড়াশোনার পর স্কলারশিপ পেয়ে প্যারিসে যান উচ্চশিক্ষার জন্য। সেখানেই মার্ক্স-লেনিনীয় কমিউনিজম নিয়ে আগ্রহী হয়ে পড়েন।

পল যখন দেশে ফেরেন তখন কম্বোডিয়ায় রাজনৈতিক টালমাটাল চলছে। দেশের অবস্থা দেখেই সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার ভাবনা মাথায় আসে পলের। সেখান থেকেই শুরু পলের বিপ্লব। এর পর ১৯৭৫ সালে কম্বোডিয়ায় গৃহযুদ্ধের পর দেশের ক্ষমতা দখল করে সর্বময় প্রধান হয়ে বসেন পল। শুরু হয় তার শাসন।

যদিও চার বছরের মধ্যেই সেই শাসনে ইতি পড়ে। ভিয়েতনামের সেনাবাহিনী পলের সরকারকে সরিয়ে মুক্ত করে কম্বোডিয়াকে। বন্দি করা হয় পলকে। ১৯৯৮ সালে বন্দি অবস্থাতেই ঘুমের মধ্যে মারা যান পল।

সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন