চার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে পদ্মায় হচ্ছে ওয়াসার পানি সোধানাগার

নিজস্ব প্রতিবেদক:

অবৈধ সংযোগ ও পানির কম দামের কারণে কুলিয়ে উঠতে পারছে না রাজশাহী ওয়াসা। ফলে অনেকটায় দেউলিয়ার পথে চলে গেছে প্রতিষ্ঠানটি। এর ওপর রয়েছে নানা অনিয়ম-দুর্নীতিরও বিস্তর অভিযোগ। বিশেষ করে অবৈধ সংযোগে কাবু হয়ে পড়েছে সরকারি এ প্রতিষ্ঠানটি। ফলে নগরবাসীর যেমন পানির চাহিদা মেটাতে পারছে না রাজশাহী ওয়াসা, তেমনি নিজেরাও গা মেলে উঠে দাঁড়াতে পারছে না।

নাগরিক সুবিধার কথা বিবেচনা করে সরকার গত চার বছরেই এই খাতে ভর্তুকি দিয়েছে ১০০ কোটির টাকারও বেশি। তার পরেও প্রতিদিন তিন কোটি ৬০ লাখ লিটার পানির চাহিদা পূরণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। বলা যায় খুড়িয়ে চলছে রাজশাহী ওয়াসা। এতে করে বছরকে বছর বিপুল টাকা ভর্তুকি টানতে হচ্ছে সরকারকে। এমন পরিস্থিতিতে মন্ত্রণালয় থেকে পানির দাম বৃদ্ধির পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সেই অনুযায়ী কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি।

তবে আসার আলো দেখা হচ্ছে একটি মেগা প্রকল্প। ৪ হাজার ৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে রাজশাহী নগরীসহ আশে-পাশের পৌর এলাকাগুলোতে পানি সমস্যা নিরসনে পদ্মায় পানি শোধনাগার নির্মাণ করতে যাচ্ছে চীনা প্রতিষ্ঠান। ভূ-উপরিস্থ পানি শোধন করে সরবরাহের জন্য রাজশাহী ওয়াসা ও হুনান কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেডের মধ্যে চুক্তিও হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে প্রতিদিন ২০ কোটি লিটার বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা হবে বলে জানিয়েছে ওয়াসা। তবে এই মেগাপ্রকল্পের জন্যেও পদ্মা নদীতে পানির যোগান নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু সুষ্ক মৌসুমে পদ্মায় যে পরিমাণ পানি থাকে, তাতে এই প্রকল্পও বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়তে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।

রাজশাহী ওয়াসা সূত্র মতে, রাজশাহী মহানগরীতে দৈনিক পানির চাহিদা ১১ কোটি ৩২ লাখ লিটার। এরমধ্যে ৮ কোটি ৬৫ লাখ লিটারই তোলা হয় ভূ-গর্ভস্থ হতে। আর মাত্র ৯০ লাখ লিটার ভূ-উপরিস্থ পানি শোধন করে নগরবাসীর মাঝে সরবরাহ করে ওয়াসা। প্রতি কিলো লিটার পানির উৎপাদনে ওয়াসার খরচ পড়ে ৪টাকা ৫৬পয়সা।

দেশের সবচে’ কম দামে পানি বিক্রি করে এ প্রতিষ্ঠানটি। তারা আবাসিক সংযোগে প্রতি কিলোলিটার পানির দাম নেয় হয় দু’ টাকা ২৭ পয়সা ও বাণিজ্যিকে ৪টাকা ৫৪ পয়সা। এমন পরিস্থিতিতে ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে পানির দাম বাড়ানোর নির্দেশ দেয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের পানি সরবরাহ অধিশাখা। কিন্তু সেটিও এখনো বাস্তবায়ন করতে পারেনি ওয়াসা। এর মধ্যে রয়েছে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ নিয়েও প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই।

তবে পানির দর বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেছেন ওয়াসার সচিব মুহাম্মদ আবদুল হালিম টলস্টয়। তিনি বলেন, ‘আমরা পানির দর বৃদ্ধি করতে কাজ করছে। দ্রুত এটি বাস্তবায়ন হবে। তবে এটি করতে আমাদের নানা দিক ভাবতে হচ্ছে। তার আগে গ্রাহকের পানির চাহিদা পূরণ করাটাও জরুরী। সেটি নিয়েও আমরা কাজ করছি।’

এদিকে নগরীর হেতেম খাঁ এলাকার বাসিন্দা আকবর আলী বলেন, ‘আমরা তো ঠিকমতো পানিই পাই না। তাহলে পানির দাম বাড়াবে কেন। আগে পানি ঠিকমতো সরবরাহ করুক, তার পরে দাম বৃদ্ধি করুক। পানি পর্যাপ্ত না দিয়ে দাম বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত গ্রাহক হিসেবে আমি কখনোই মানতে পারি না।’

রাজশাহী ওয়াসা সূত্র মতে, ওয়াসার ২০১৯-২০ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৫ কোটি ১৫ লাখ টাকা। কিন্তু তাও আদায় করতে পারেনি ওয়াসা। বর্তমান মাত্র ৪৫ হাজার গ্রাহকের নিকট থেকে পানি বিল আদায় করতে পারে ওয়াসা। আর হাজার হাজার গ্রাহ রয়েছে অবৈধ। যাদের বাড়িতে পানি যাচ্ছে অবৈধ সংযোগের মাধ্যমে। ফলে নগরবাসীকে পানি সরবরাহের জন্য প্রতি বছর গড়ে বিদ্যুৎ বিলখাতেই খরচ হচ্ছে ৯ কোটি টাকা। তবে নাগরিক সুবিধার কথা বিবেচনা করে সরকার গত চার বছরেই এই খাতে ভর্তুকি দিয়েছে ১০০ কোটির টাকারও বেশি।

অন্যদিকে রাজশাহী অঞ্চলে দিনকে দিন ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। এরই মধ্যে প্রতিদিন গড়ে ৮ কোটি লিটার ভ’-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন করছে রাজশাহী ওয়াসা। ফলে পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে। ভূ-গর্ভস্থ পানি রিজার্চ না হওয়ায় পানির মজুদ ধীরে ধীরে কমে আসছে। যা প্রাণ ও প্রকৃতির জন্য হুমকি। তবে পরিস্থিতি সামাল দিতে ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় চীনা প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় রাজশাহী নগরীসহ আশেপাশে কয়েকটি পৌর এলাকাতেও, পদ্মার পানি শোধন করে- সরবরাহের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

চুক্তি অনুয়াযী, রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার পদ্মা ও মহানন্দা নদীর মোহনায় পানি শোধনাগার নির্মাণ করা হবে। এ প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছে ৪ হাজার ৬২ কোটি টাকা। এর মধ্যে এক হাজার ৭৪৮ কোটি টাকা দেবে বাংলাদেশ সরকার। বাকি দু’হাজার ৩১৩ কোটি টাকা আড়াই থেকে তিন শতাংশ সুদে ঋণ দেবে হুনান কন্সট্রাকশন।

এর আগে প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে পদ্মায় পানির যোগান নিয়ে অন্তত ৩০বছরের পরিসংখ্যান পর্যবেক্ষণ করেছে আইডব্লিউএম। তবে এই মেগা প্রকল্পের দীর্ঘমেয়াদী সুফল পেতে পদ্মার উজানের দেশগুলোর কাছে পানির ন্যায্য প্রাপ্যতা নিশ্চিতের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এটি না করতে পারলে এই প্রকল্পের ভবিশ্যত নিয়েও শঙ্কা রয়েছে।

জানা গেছে, ২০১৫ সালে নগরীতে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহে মেগাপ্রকল্পটি হাতে নেয় ওয়াসা। গত ২১মার্চ ঢাকায় হুনান কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ কম্পানি লিমিটেড ও রাজশাহী ওয়াসার মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সময় ধরা হয়েছে ২০২১ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত।

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক সুলতান আবদুল হামিদ বলেন, ‘ওয়াসাকে ঢেলে সাজাতে মেগাপ্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। এছাড়াও পানির দরও বৃদ্ধি করতে হবে। তবে মেগা প্রকল্পটি বাস্তায়নের জন্য রাজশাহী সিটি করপোরেশনকেও এগিয়ে আসতে হবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে।’

তবে ডুবতে বসা ওয়াসাকে উদ্ধারে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন সিটি মেয়র। রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, ‘রাজশাহী নগরবাসীসহ আশে-পাশের পৌর এলাকাগুলোতে পানি সরবরাহের জন্য সরকার যে মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে সেটি বাস্তবায়ন জরুরী হয়ে পড়েছে। আমরা সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকেও প্রকল্পটি বাস্তবায়সে সার্বিক সহযোগিতা করে যাচ্ছি।’

স/আর