চার টোকেনে রাজশাহীতে ট্রাক থেকে মাসে কোটি টাকা চাঁদাবাজি, ভাগ যাচ্ছে বিভিন্ন দপ্তরে

নিজস্ব প্রতিবেদক:

চারটি টোকেনের মাধ্যমে প্রতিটি ট্রাক, ট্যাংকলরি, কাভার্ড ভ্যান ও ট্রাক্টর থেকে ১০০ টাকা করে চাঁদা উঠানো হচ্ছে রাজশাহী নগরীর নওদাপাড়া এলাকায়। প্রতিদিন এখান থেকে চার থেকে সাড়ে চার হাজার যানবাহন দাঁড় করিয়ে মাসে অন্তত কোটি টাকা চাঁদা উত্তোলন করা হচ্ছে। দুটি স্থানে কয়েকজন লাঠিয়াল বাহিনী ঢাকা-চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহাসড়ক ও রাজশাহী নওগাঁ মহাসড়কে পণ্যবাহী যানবাহন দাঁড় করিয়ে এ চাঁদা উত্তোলন করছেন। গত প্রায় ছয়মাস ধরে এইভাবে তিনটি সংগঠন আর একজন ঠিকাদারের নামে নগরীর নওদাপাড়া এলাকায় এ চাঁদা উঠানো হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই এ কাজটি করা হচ্ছে।

এতে করে ট্রাক চালক ও মালিকদের মাঝে ব্যাপক ক্ষোভ দেখা দিলেও এর কোনো সমাধান হয়নি। অথচ রাস্তায় সকল ধরনের চাঁদাবাজি বন্ধে পুলিশের পক্ষ থেকে কড়া হুশিয়ারি দেওয়া আছে। সে অনুযায়ী বছর তিনেক আগে এই চাঁদাবাজি রাজশাহীতে বন্ধ হয়ে গেছিল। কিন্তু গত প্রায় ৬ মাস ধরে আবারও চাঁদাবাজি শুরু হয়েছে। এর ফলে প্রতিদিন চাঁদাবাজির সাড়ে ৩ থেকে চার লাখ টাকা আদায় হচ্ছে। সেই হিসেবে মাসে আদায়কৃত অন্তত কোটি টাকা যাচ্ছে ঠিকাদার একজন যুবলীগ নেতা এবং বাস ও ট্রাক মালিক-শ্রমিকদের তিনটি সংগঠনের নেতাদের পকেটে। আর একটি ভাগ যাচ্ছে প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে।

গতকাল শনিবার সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, নগরীর নওদাপাড়া এলাকায় ট্রাক টার্মিনালের সামনে ঢাকা-চাঁপাইনাববগঞ্জ মহাসড়কের পাশে লাঠি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ৪-৫ জন ব্যক্তি। ট্রাক টার্মিনালের সামনে আসামাত্র ট্রাকগুলো লাঠি হাতে নিয়ে ইশারা করে দাঁড় করাচ্ছেন তাঁরা। এর পর সেই ট্রাক থেকে চারটি স্লিপ ধরিয়ে দিয়ে আদায় করা হচ্ছে ১০০ টাকা করে। এর মধ্যে ৩০ টাকার একটি স্লিপ ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে রাজশাহী ট্রাক টার্মিনালের ঠিকাদারের নামে, ৩০ টাকার আরেকটি স্লিপ ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে রাজশাহী জেলা ট্রাক, ট্যাংকলরি, কাভার্ডভ্যান ও ট্রাক্টর শ্রমিক ইউনিয়নের নামে, ৩০ টাকার অপর একটি সিল্প ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে রাজশাহী জেলা ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির নামে এবং ১০ টাকার একটি স্লিপ ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে রাজশাহী জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়ন পরিচালিত হাসপাতালের উন্নয়ন ব্যায়ের নামে। একইভাবে নগরীর বিআরটিএ ভবনের সামনেও ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও ট্যাংকলরি দাঁড় করিয়ে চাঁদা তোলা হচ্ছে। রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়ক হয়ে যেসব পন্যবাহী যানবাহন ঢাকার দিকে যাচ্ছে সেসব যানবাহন থেকে এখানে চাঁদা তোলা হচ্ছে।

চাঁদা প্রদানকারী একজন ট্রাক চালক লালন উদ্দিন বলেন, ‘আমার কাছ থেকে গাড়ী দাঁড় করে ১০০ টাকা নিলো। পাথর বোঝাই ট্রাক হঠাৎ দাঁড় করাতে গিয়ে সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। তার পরেও লাঠি হাতে দাঁিড়য়ে থাকা শ্রমিকরা কয়েকটা রশিদ হাতে ধরে দিয়ে টাকা নিল। দিতে না চাইলে গাড়ী যেতে দিবে না তারা। তাই বাধ্য হয়ে চাঁদা দিতে হয়। এ যে চাঁদা উঠাচ্ছে, এই টাকার মুখ সাধারণ শ্রমকিরা কখনোই দেখতে পাই না। এই টাকা ভাগ হয় শ্রমিক এবং মালিক সমিতির নেতাদের মাঝে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ট্রাক ট্রামিনালের নামে চলন্ত ট্রাক থেকে চাঁদাবাজির কোনো এখতিয়ার নাই। তার পরেও জোর করে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে আমাদের কাছ থেকে। তার পরেও প্রশাসন এসব দেখতে পাই না। ট্রাফিক পুলিশও এই চাঁদার ভাগ পাই বলেই এভাবে প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি হচ্ছে। ’

আরকে ট্রাক চালক আসগর আলী বলেন, ‘প্রায় তিন বছর এখানে চাঁদাবাজি বন্ধ ছিল। হঠাৎ করে গত প্রায় ছয় মাস ধরে আবার শুরু হয়েছে। নিশ্চয় প্রশাসন আর নেতাদের ম্যানেজ করে এটি করা হচ্ছে। আমরা এই চাঁদাবাজি বন্ধের দাবি জানাচ্ছি। এখানে টাকা দিয়ে কোনো উপকার নাই। বরং ট্রাক থামাতে গিয়ে ঝুঁিকর মধ্যে পড়তে হয় আমাদের। প্রতিদিন সাড়ে চার থেকে সাড়ে হাজার ট্রাকসহ বিভিন্ন পণ্যবাহী যানবাহন চলাচল করে। প্রতিটি পণ্যবাহী যানবাহন থেকেই তারা চারটি টোকেন ধরিয়ে দিয়ে ১০০ টাকা করে চাঁদা তুলছে। কিন্তু এ টাকার হদিশ পাই না আমরা শ্রমিকরা।’

জানতে চাইলে রাজশাহী জেলা ট্রাক, ট্যাংকলরি, কাভার্ডভ্যান ও ট্রাক্টর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নূরুল ইসলাম নূরু বলেন, ‘রাস্তায় দাঁড় করিয়ে ট্রাক থেকে চাঁদাবাজির নিয়ম নাই। তার পরেও সংগঠন চালানোর জন্য করতে হচ্ছে। টার্মিনালের নামে যেহেতু চাঁদা তোলা হচ্ছে, তাই আমরাও তুলছি। আমাদের টাকা শ্রমিকদের উন্নয়নের জন্য ব্যয় হয়।’

তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি সাবেক পুলিশ কমিশনার এবং সরকার দলীয় নেতাদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে আবার নতুন করে চালু করা হচ্ছে চাঁদা আদায়। মাঝে অনেকদিন বন্ধ ছিল।’ তিনি আরও জানান, ঢাকা-চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়ক দিয়ে প্রতিদিন চার থেকে সাড়ে হাজার যানবাহন চলাচল করে।

জানতে চাইলে রাজশাহী জেলা ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো: মুকুল বলেন, ‘অন্যারা টাকা তুলছে আমরাও তুলছি। আমাদের মালিক সমিতি চালাতে খরচ হয়।’

ট্রাক টার্মিনালের নামে চাঁদাবাজি প্রসঙ্গে নগরীর ১৭ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি সারোয়ার হোসেন বলেন, ট্রাক টার্মিনাল লিজের টাকা তো তুলতে হবে। তাই রাস্তায় ট্রাক দাঁড় করিয়ে চাঁদা তোলা হচ্ছে। এই টাকার ভাগ আরও অনেকেই পাই।’

নগরীর মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মাহতাব উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালের ট্রাক শ্রমিকদেরও বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়া হয়। তাই ট্রাক থেকেও ১০ টাকা করে চাঁদা নেওয়া হচ্ছে।’

এদিকে নগর পুলিশের মুখপাত্র রফিকুল আলম বলেন, ট্রাক থেকে ট্রাফিক পুলিশের নামে চাঁদাবাজি হলে আমরা ব্যবস্থা নিব। তবে কিভাবে সেখানে ট্রাক দাঁড় করিয়ে চাঁদা তোলা হচ্ছে, সেটি খোঁজ নেওয়া হবে।’’

স/আর