চাঁপাইনবাবগঞ্জে এমপি ওদুদের জামায়াতপ্রীতি

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পর চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল ওদুদ বিশ্বাসসহ জামায়াত-বিএনপির ক্যাডাররা এলাকায় তাণ্ডব চালিয়েছিল। সে সময় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর ভয়ংকর নির্যাতনের কথা শুনলে আজও শিউরে ওঠে মানুষ।

 

সেই নির্যাতন থেকে বাদ যায়নি দলের সমর্থকসহ এলাকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষজনও। একের পর এক মিথ্যা মামলা ও হামলায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা অনেকেই মাসের পর মাস এলাকাছাড়া ছিল। কিন্তু ২০০৮ সালের পর ক্ষমতায় আসে স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি আওয়ামী লীগ। আর সরকারপ্রধান বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু এখনো চাঁপাই-নবাবগঞ্জের আওয়ামী লীগের নেতাদের মুখে হাসি ফোটেনি।

 

বিএনপির আমলে যিনি ছিলেন জেলার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা সেই বিএনপি নেতা ওদুদ বিশ্বাস ও তাঁর লোকজন এখনো আছে সেই প্রভাব-প্রতিপত্তি নিয়েই। সেই ওদুদ বিশ্বাস ও তাঁর লোকজনের কাছে এখনো অসহায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। মিথ্যা মামলা আর নির্যাতনের শিকার হয়ে অনেকেই কোণঠাসা হয়ে দলীয়

 

কার্যক্রম থেকেই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। কারণ সেই আব্দুল ওদুদ বিশ্বাসই এখন আওয়ামী লীগদলীয় সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। আর বিএনপির আমলে তাঁর সহযোগীরাই এখন আওয়ামী লীগের ঝাণ্ডা হাতে সেই একই ভূমিকায়।

 

২০০৫ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে ওদুদ বিশ্বাস ধীরে ধীরে হয়ে যান চাঁপাইনবাবগঞ্জ আওয়ামী লীগের হর্তাকর্তা। নীরবে চলে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী অপসারণ আর বিএনপি-জামায়াত পুনর্বাসন। চাঁপাইনবাবগঞ্জে দুই দিন ধরে সরেজমিন ঘুরে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও সমর্থকদের সঙ্গে কথা বলে এমনই চিত্র পাওয়া গেছে।

 

সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বঙ্গবন্ধু, তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা আর দলকে ভালোবেসে যাঁরা আওয়ামী লীগ করেছিলেন, বিএনপি-জামায়াত জোটের অপশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন, সেসব ত্যাগী নেতারা এখন আছেন দুর্দিনে। তাঁরা এখন কোণঠাসা, দলে পদ-পদবিও পাচ্ছেন না। চরম হতাশা নিয়ে নীরবে দল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন অনেকেই। আর যারা জামায়াত-বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, যারা ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের সময় আগুন সন্ত্রাস আর চাঁপাইনবাবগঞ্জে তাণ্ডব চালিয়েছিল সেই তারাই সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছে। আওয়ামী লীগের দলীয় বড় বড় পদে আসীন এখন তারাই। ক্ষমতা আর নিজের আখের গোছাতেই সেসব জামায়াত-বিএনপির নেতা ভোল পাল্টে দল পাল্টে এখন আওয়ামী লীগার সেজেছে, তারাই এখন এমপির কাছের লোক।

 

এমপি ওদুদ বিএনপি আর জামায়াত নেতাদের দলে ভেড়াচ্ছেন আর তাদের নিয়ে সব সুযোগ-সুবিধা লুটে নিচ্ছেন। যারাই প্রতিবাদ করছে তারা নির্যাতন আর জুলুমের শিকার হচ্ছে। শুধু নির্যাতনই নয়, দলের ত্যাগী নেতাদের উপজেলা কিংবা জেলা কমিটি থেকেও বিতাড়িত করে জামায়াত-বিএনপির লোকদের কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, এমপির বাড়ির কাজের লোকরাও এখন জেলা কমিটির বড় বড় পদ পাচ্ছে। এমপির কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুললেই এখনো হামলা আর নির্যাতনের শিকার হতে হয় তাদের।

 

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০০৮ সালের পর সারা দেশের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মুখে হাসি ফুটলেও চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদরের পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। এখানে হাসছে অগ্নিকাণ্ড আর তাণ্ডবের হোতা সেই জামায়াত-বিএনপির নেতাকর্মীরা, আওয়ামী লীগে যোগদান করে এমপি ওদুদের মদদ পেয়ে সেই শিবিরের ভয়ংকর ক্যাডাররা, যাদের বিরুদ্ধে ছিল অসংখ্য সহিংসতার মামলা, সেই তারাই হয়ে উঠছে আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণকারী-সুবিধাভোগী। জমি দখল থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজে নিয়োগ, টেন্ডারবাজি, স্থানীয় নির্বাচনে ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বার দলীয় মনোনয়নসহ বিভিন্নভাবে ওদুদ বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের সুবিধা দিয়ে যাচ্ছেন। আর বিনিময়ে হাতিয়ে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা।

 

সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি ও নারায়ণপুর ইউনিয়নের সফল চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন হুদাকে দলের সমর্থন না দিয়ে দিয়েছেন বিএনপির নেতা আলমগীর কবির কামালকে, যাঁর বাবা ছিলেন একাত্তরের ভয়ংকর রাজাকার হুমায়ুন আহাম্মেদ ওরফে হুমায়ন দারোগা। তাঁর বাবার সেই নির্যাতনের কথা শুনলে এখনো এলাকার বৃদ্ধরা আঁতকে ওঠেন। শত শত মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের বাড়িঘর আগুনে পুড়িয়ে, হত্যা, ধর্ষণসহ তাণ্ডব চালিয়ে সেই রাজাকার হুমায়ন দারোগা ইতিহাসে কুখ্যাতি পেয়েছিলেন। সেই হুমায়নের ছেলেকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থন দিয়েছিলেন এমপি ওদুদ। কারণ মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে তাঁরই ঘরানার লোকদের দলীয় সমর্থন দেন ওদুদ। এমনকি দলের ত্যাগীরা দলে ঠাঁই না পেলেও রাজাকারপুত্রই হয়েছেন উপজেলা-জেলা কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক।

 

কামাল উদ্দিন হুদা বলেন, ‘আমাকে মনোনয়ন না দিয়ে রাজাকারের পুত্রকে নৌকার মনোনয়ন দেওয়া হয়, যার বাবা এলাকায় কুখ্যাত রাজাকার ছিলেন। কিন্তু জনগণ আমাকেই বিপুল ভোটে নির্বাচিত করে। ’ আর সদর উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতা টিপু। এলাকার জনপ্রিয় চেয়ারম্যান হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে দলের মনোনয়ন না দিয়ে এমপির ক্যাডার হিসেবে পরিচিত বিএনপির নেতা জসিম উদ্দিনকে মনোনয়ন দেওয়া হয়।

 

একইভাবে যুবদল ক্যাডার এজাবুল হক বুলি পেয়েছেন থানা কমিটির পদ। এ ছাড়া টুটুল ছিল এমপির বাড়ির কাজের লোক। সেই টুটুল পেয়েছে জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ সদস্য পদ। জেলা জাতীয় পার্টির নেতা অ্যাডভোকেট রবিউল ইসলাম হন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। আর বাবু মণ্ডল আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে কোনো দিন ছিলেন না, বরং ছাত্রমৈত্রীর নেতা ছিলেন। অথচ তাঁকে দেওয়া হয়েছে জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের মতো বড় পদ। আর মোস্তাকুল ইসলাম পিন্টু, জীবনে কোনো দিন কোনো দলই করেননি। সেই পিন্টু এমপির ভায়রা হওয়ার সুবাদে জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য পদ পেয়েছেন।

 

আর ১৯৯০ সালে জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন গোলাম শাহনেওয়াজ অপু। পরে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি এবং শহর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকও ছিলেন। দলের জন্য জেল খেটেছেন, নির্যাতন সহ্য করেছেন, আন্দোলন করেছেন। সেই ত্যাগী নেতাকে কোনো পদে রাখা হয়নি। একইভাবে সাবেক জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ফাইজার রহমান কনকও দলীয় কোনো পদ পাননি।

 

আর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও দপ্তর সম্পাদক ছিলেন এমরান ফারুক মাসুম। বিএনপি-জামায়াতের নির্যাতনের শিকার হয়ে জেল খেটেছিলেন, সেই তাঁকে কোনো পদে রাখা হয়নি। কারণ এমপি ও তাঁর ক্যাডারদের অন্যায় আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলায় পদবঞ্চিত থাকতে হচ্ছে তাঁকে। এ প্রসঙ্গে এমরান ফারুক মাসুম বলেন, ‘দলের দুঃসময়ে ছিলাম এখন সুসময়ে পদে নেই। যারা এখন আছে দলের বিপদে কোথায় যায়, সেটা সময়ই বলে দিবে। ’

 

গোলাম শাহনেওয়াজ অপু বলেন, ‘ছাত্রলীগ থেকে আওয়ামী লীগ, ৩০ বছর ধরে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত আমি। কিন্তু এবার আমাকে কোনো পদে রাখা হয়নি। কেন রাখা হয়নি, সেটা জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বলতে পারবেন। ’ দুইবারের নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান ও মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট আব্দুস সামাদকেও কোনো পদে রাখা হয়নি। পদে রাখা হয়নি আওয়ামী লীগ নেতা আশরাফ আলীকেও।

 

মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সামাদ বলেন, ‘দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি, কিন্তু আমরা মুক্তিযোদ্ধা দলে ঠাঁই পাই না। এখন তো জামায়াত-বিএনপির নেতাদের নিয়েই দল চলছে। আলবদর নেতাকে ফুলের মালা দিয়ে দলে বরণ করে নিয়েছেন এমপি। ’

 

পদবঞ্চিত নেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, এমপি ওদুদ বিশ্বাসের বিএনপি-জামায়াতপ্রীতি যায়নি। বিএনপির আমলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর জুলুম করেছেন। দলে যোগ দিয়ে এমপি হয়েছেন বিএনপি নেতা ওদুদ বিশ্বাস, তিনি এখন জামায়াতের পক্ষে কাজ করছেন, আওয়ামী লীগকে দূরে সরিয়ে রাখছেন। এমপির মামা, ভায়রা, কাজের লোকসহ জামায়াত-বিএনপির নেতারা দলে পদ পাচ্ছেন। আর প্রকৃত আওয়ামী লীগের লোকজন পদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

 

আর এমপি ওদুদ বিশ্বাসের অবিচারের ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে অ্যাডভোকেট শামসুল ইসলামের মতো প্রবীণ নেতাকে উপেক্ষা ও অপমানের মধ্য দিয়ে। শামসুল ইসলাম ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তৃণমূল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কাছে ছিলেন খুবই জনপ্রিয়। দলের দুঃসময়ে কর্মীদের পাশে ছিলেন, বিনা পয়সায় মামলায় লড়েছেন। জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে শামসুল ইসলামকে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা সভাপতি হিসেবে দেখতে চাইলেও জোরপূর্বক তাঁকে সভাপতি হতে দেননি এমপি ওদুদ বিশ্বাস।

 

তাঁকে সভাপতি না বানিয়ে প্রভাব খাটিয়ে মঈন উদ্দিন মণ্ডলকে সভাপতি পদটি ‘উপহার’ দেওয়া হয়। আর প্রবীণ নেতা শামসুল ইসলামকে দেওয়া হয়েছিল জেলার ৫ নম্বর সহসভাপতির পদটি। ওই পরিস্থিতিতে শোকে আর দুঃখে শেষ পর্যন্ত মারাই যান তিনি। এ বিষয়ে তাঁর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে কেউ এমপি ওদুদের বিষয়ে কথা বলতে চায়নি। তবে জেলার কয়েকজন সাবেক নেতা ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, শামসুল ইসলাম ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের প্রাণ। সেই তাঁকে সভাপতি হিসেবে দেখতে চেয়েছিল দলের সবাই। কিন্তু এমপি ওদুদ জোর করে ক্ষমতা খাটিয়ে শামসুল ইসলামকে সভাপতি হতে দেননি।

 

শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহঙ্গীর কলেজের অধ্যক্ষকে জোর করে বের করে দিয়ে ওদুদের ডান হাত বলে পরিচিত একসময়ের যুবদল ক্যাডার এজাবুল হক বুলি অধ্যক্ষ পদটি দখল করে নেন। বুলির বিরুদ্ধে জেলা ঠিকাদার সমিতি কার্যালয় দখল করে নেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। তিনি নিজেই এখন সমিতির আহ্বায়ক। জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি জিয়াউর রহমান তোতা ছিলেন সদর উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান। এবার উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে দলীয় সমর্থন দেওয়া হয়নি তাঁকে। শুধু তাই নয়, এমপির ঘনিষ্ঠ একসময়ের যুবদলের ক্যাডার বুলির মিথ্যা মামলায় জেল খেটে বের হন সম্প্রতি।

 

যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। সদর পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মিজানুর রহমান এমপি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি এলাকার তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।

 

আওয়ামী লীগে পুনর্বাসন হচ্ছে জামায়াত-শিবির ও বিএনপির :

২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে ১২টির বেশি নাশকতার মামলার আসামি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জামায়াতের রুকন ও হেফাজতের আমির ভাইস চেয়ারম্যান সোহরাব হোসেনসহ অন্তত তিন শতাধিক বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মী গত ১ অক্টোবর আওয়ামী লীগে যোগ দেয়। ওই দিন আব্দুল ওদুদ বিশ্বাসের হাতে ফুল দিয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেয় তারা। সোহরাব হোসেনের নেতৃত্বেই চাঁপাইনবাবগঞ্জজুড়ে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বানচাল ও সরকারবিরোধী আন্দোলনে নজিরবিহীন নাশকতা করেছিল জামায়াত-বিএনপি ও শিবিরের ক্যাডাররা।

 

ওই সময় দলের নেতাকর্মীদের ওপর চোরাগুপ্তা বা প্রকাশ্য হামলার কারণে ক্ষমতায় থেকেও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ছিল কোণঠাসা। সন্ত্রাসের কারণে পালিয়ে থাকতে হয়েছিল অনেককেই। এই সন্ত্রাস ও নাশকতার হোতা জামায়াত নেতা সোহরাব আলী। তাঁর বিরুদ্ধে রয়েছে অন্তত ১২টি নাশকতার মামলা। এসব মামলায় গ্রেপ্তার এড়াতে সোহরাব হোসেন দীর্ঘদিন পলাতক ছিলেন। কিন্তু সম্প্রতি স্থানীয় এমপি আব্দুল ওদুদ বিশ্বাসের হাত ধরে এলাকায় ফেরেন এবং তাঁর ক্যাডার জামায়াতের সহযোগী সংগঠন শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা আফরোজ জুলমাত, বিএনপি নেতা মসিদুল হক মাসুদসহ দলবল নিয়ে যোগ দেন আওয়ামী লীগে।

 

গত ২৫ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগে যোগ দেন একাধিক নাশকতা মামলার আসামি জামায়াত নেতা ও বারঘরিয়া ইউপি চেয়ারম্যান আবুল খায়ের। একই দিন যোগ দেন বিএনপি নেতা ও জেলা পরিষদের ১১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবুল বাসার, বারঘরিয়া ইউপি সদস্য সেমাজুল ইসলাম ও জিয়াউর রহমানসহ দুই শতাধিক বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মী আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছে। গত ১২ সেপ্টেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জে বিএনপি-জামায়াতের ৩ শতাধিক নেতাকর্মীও আওয়ামী লীগে যোগদান করেছে। এভাবে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের ঠাঁই হচ্ছে এমপি ওদুদ বদান্যতায়।

 

এমপির এসব কর্মকাণ্ডে দলের তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে দেখা দেয় চরম ক্ষোভ আর হতাশা। কিন্তু ওদুদের দাপটে এখনো ভয়ে প্রকাশ্যে কেউ মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছে না। কারণ এমপি ওদুদ এখন জামায়াত-শিবির আর বিএনপি ক্যাডারদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে মাথায় তুলে রেখেছেন। ফলে এমপির বিরুদ্ধে কেউ কথা বললেই তাদের ওপর হামলা হতে পারে—এমন আশঙ্কা গোটা সদর ও জেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে।

 

জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের সদ্য নির্বাচিত চেয়ারম্যান মঈনউদ্দিন মণ্ডল বলেন, ‘যারা বিএনপি-জামায়াত থেকে দলে এসেছে তারা কালসাপ। এদের স্বার্থে যখনই আঘাত লাগবে তখনই পাল্টা ছোবল মারবে। এদের দ্বারা দলের উপকার হয় না, ক্ষতির আশঙ্কাই বেশি রয়েছে। ’ তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের অনেকের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই এসব লোককে দলে টানা হচ্ছে। আমি এসব পছন্দ করি না। তাই যোগদান অনুষ্ঠানে যাই না। বিএনপি-জামায়াতের দলে যোগদানের বিষয়গুলো কেন্দ্রেও জানানো হয়েছে। ’

 

এমপি আব্দুল ওদুদ বিশ্বাসের বক্তব্য : জামায়াত-শিবির নেতাদের আওয়ামী লীগে যোগদান প্রসঙ্গে এমপি ওদুদ বলেন, ‘জামায়াত নেতাদের মধ্যে কারো কারো কোয়ালিটি আছে। কিছু আছেন ভোট টানার মতো নেতা। কেউ আছে ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতি করে বা পা কাটা রগ কাটার রাজনীতি করে। আর কিছু আছে দলকে নিয়ন্ত্রণ করে। আমরা দেখেছি যাঁদের বিরুদ্ধে জ্বালাও-পোড়াওসহ ভয়ংকর কোনো মামলা নেই বা থাকলেও ছোটখাটো মামলা আছে তাঁদের দলে যোগদানের ব্যবস্থা করেছি। ’

 

যাঁরা আপনার হাতে ফুল দিয়ে যোগদান করেছেন তাঁদের কারো বিরুদ্ধে ১০টির বেশি মামলা আছে—এ বিষয়ে এমপি বলেন, ‘যারা এটা বলছে, সত্য কথা বলছে না। সাঈদীর ফাঁসির রায়ের দিনও আমার সদর উপজেলায় কোনো নাশকতা হয়নি। যা হয়েছে শিবগঞ্জে। তবে একজন ভাইস চেয়ারম্যান আছেন, তাঁকে বিশেষ কারণে দলে নেওয়া হয়েছে। যেহেতু উপজেলা চেয়ারম্যান বরখাস্ত হয়েছেন, ভাইস চেয়ারম্যানও পালিয়ে থাকেন, আর এলাকার উন্নয়ন থেকে মানুষ বঞ্চিত হচ্ছিল, ফলে বর্তমান উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যানকে বললাম, আপনি জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে আমাদের দলে যোগ দেন। তিনি তাই করলেন। জনগণের সুবিধার্থেই এটি করা হয়েছে। ’

 

যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আছে এমন লোকের ছেলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক পদ পাওয়া এবং চেয়ারম্যান মনোনয়ন দেওয়া প্রসঙ্গে এমপি ওদুদ বলেন, ‘২০০৫ সালে ধানমণ্ডিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতেই আমি আর আলমগীর কবির আওয়ামী লীগে যোগ দেই। আমি দলে যোগ দিয়ে এমপি এবং সংগঠনে জেলার সাধারণ সম্পাদক হয়েছি। তিনি তো তে এত বছর পর দলে একটা পদ পেতেই পারেন। আমি বিএনপি করতাম, আলমগীর কবির, তাঁর বাবাও আমার সঙ্গে বিএনপি করতেন। খয়ের চেয়ারম্যান নামে একজন যোগ দিয়েছেন কিন্তু তিনি জামায়াতের কমিটিতে নেই। তবে মনে মনে জামায়াত করতেন। ’

 

ত্যাগী নেতারা হামলা ও মামলাসহ নির্যাতনের শিকার হচ্ছে এবং দলের কমিটিতেও জায়গা পাচ্ছেন না। আর দলে জায়গা পাচ্ছে বিএনপি-জামায়াত থেকে আসা নেতাকর্মীরা—এ বিষয়ে এমপি ওদুদ বিশ্বাস বলেন, ‘শুধু পুরনো নেতারাই কমিটিতে থাকবেন, নতুনরা কি সুযোগ পাবেন না? আর আপনারা তো জানেন, দল করতে হলে গ্রুপ থাকে। যার যার গ্রুপ থেকে সে সে কমিটিতে নেতাকর্মীদের জায়গা দেয়। আর সেটা কাউন্সিলররা করে। আর আমার সঙ্গে ২০০৫ সালে বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন যাঁরা তাঁরা দলে পোস্ট পাবেন না কেন? ১০ বছরেও কি আওয়ামী লীগার হননি তাঁরা? আওয়ামী লীগের যাঁরা জনবিচ্ছিন্ন নেতা তাঁরাই দলে পদ পান না। নির্বাচন করলে তিনটিও ভোট পান না।

সূত্র: কালের কণ্ঠ