চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে ভারত পণ্য নিচ্ছে তাদের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে

চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে ভারত তাদের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যে পণ্য পরিবহন শুরু করছে। কলকাতা সমুদ্রবন্দর থেকে রওনা দিয়ে আজ সোমবার প্রথম পরীক্ষামূলক চালানটি বন্দরের বহির্নোঙরে পৌঁছবে। বন্দর জেটিতে জাহাজ থেকে নামিয়ে সড়কপথে সেটি আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে ভারতের আগরতলা পৌঁছবে। কলকাতা থেকে আগরতলা পণ্য পৌঁছাতে ১৬ শ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়; মূলত বিপুল পণ্য পরিবহন ব্যয় কমাতেই ভারত চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করতে চাইছে। কিন্তু দেশের ব্যবসায়ী, বন্দর ব্যবহারকারীসহ সবার প্রশ্ন ভারতকে পণ্য পরিবহনের সুযোগ দিলে বাংলাদেশ কতটা লাভবান হবে?

জেনারেল অ্যাগ্রিমেন্ট অব ট্যারিফ অ্যান্ড ট্রেড (গ্যাট) চুক্তি অনুযায়ী, ট্রানজিট বা ট্রান্সশিপমেন্ট পণ্য পরিবহনে সরাসরি শুল্ক আরোপের সুযোগ নেই। তবে দেশের অবকাঠামো ব্যবহার, নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ পণ্য পরিবহন সেবা দিয়ে বিভিন্ন মাসুল আরোপের সুযোগ আছে। বন্দর ও কাস্টমস ব্যবহার করতে দিয়ে সরকার সেই মাসুলই আরোপ করবে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড গত ১৩ জুলাই এক আদেশে ভারতীয় ট্রানজিট বা ট্রান্সশিপমেন্টের ‘পরীক্ষামূলক পণ্য চালানের’ জন্য মাসুল নির্ধারণ করে দিয়েছে। এই সাতটি মাসুল হলো প্রতি চালানের প্রসেসিং ফি ৩০ টাকা, প্রতি টনের জন্য ট্রান্সশিপমেন্ট ফি ৩০ টাকা, নিরাপত্তা মাসুল ১০০ টাকা প্রতি টন, এসকর্ট মাসুল প্রতি টন ৫০ টাকা এবং অন্যান্য প্রশাসনিক মাসুল প্রতি টন ১০০ টাকা। এ ছাড়া স্ক্যানিং ফি (প্রতি কনটেইনার) ২৫৪ টাকা এবং বিধি অনুযায়ী ইলেকট্রিক সিলের মাসুল প্রযোজ্য হবে। এই নির্ধারিত সাতটি মাসুল অনুযায়ী একটি কনটেইনার থেকে শুধু চট্টগ্রাম কাস্টমস রাজস্ব আয় করবে সাত হাজার ৩৪ টাকা। এর বাইরে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ পণ্য উঠানামা মাসুল, রিভার ডিউজ, পোর্ট ডিউজ আদায় করবে।

ট্রানজিট পণ্য পরিবহনের প্রধান সমন্বয়ক ও চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনার মোহাম্মদ ফখরুল আলম  বলেন, ‘গ্যাট চুক্তি অনুযায়ী ট্রানজিট বা ট্রান্সশিপমেন্ট পণ্যে শুল্ক আরোপের সুযোগ নেই। তবে রাজস্ব বোর্ডের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা মাসুল আদায় করব। পণ্য পৌঁছার আগেই বলা যাচ্ছে না; প্রতি চালানে বা কনটেইনারে কত শুল্ক আদায় হবে।’

পণ্য পরিবহনের প্রস্তুতির বিষয়ে তিনি বলেন, নির্বিঘ্ন সেবা দিতে কাস্টম হাউসে সার্বিক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। আর চট্টগ্রাম থেকে আখাউড়া পৌঁছতে তিনটি কাস্টমস অতিক্রম করতে হবে এ জন্য তাদেরও প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

দুই দেশের পণ্য পরিবহনের চুক্তির পর চার কনটেইনার ট্রান্সশিপমেন্ট পণ্য নিয়ে সেঁজুতি জাহাজটি বন্দরের বহির্নোঙরে পৌঁছবে ২০ জুলাই। বন্দর ও কাস্টমসের যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে সেই জাহাজ ভিড়বে বন্দর জেটিতে।

ট্রানজিট পণ্য পরিবহনকারী ‘সেঁজুতি’ জাহাজের শিপিং এজেন্ট ম্যাঙ্গো লাইন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইয়াকুব সুজন ভুঁইয়া  বলেন, মাসুল নির্ধারণ করা থাকলেও কাস্টমসে বা বন্দরে কত খরচ পড়বে তার হিসাব আগেই বলা যাবে না। চালানটির কাস্টমস এবং বন্দরের যাবতীয় প্রক্রিয়া শেষে পণ্য ছাড়ের পর খরচের সঠিক হিসাবটা পাব।

এই দুই সরকারি প্রতিষ্ঠান ছাড়াও ট্রানজিট পণ্য বাংলাদেশের সড়কপথ ব্যবহারের জন্য সরকার নির্ধারিত টোল ও মাসুল আদায় করবে সরকারি আরেক প্রতিষ্ঠান সড়ক বিভাগ। যদিও পরীক্ষামূলক চালানের ক্ষেত্রে সড়ক ব্যবহারের টোল আদায় বহাল রাখলেও অন্য মাসুল সাময়িকভাবে মওকুফ করে দিয়েছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর।

ওই তিন সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাসুল ছাড়াও চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্যের চালানটি সড়কপথে আখাউড়া স্থলবন্দর পর্যন্ত পৌঁছাতে বাংলাদেশি ট্রাক-ট্রেইলর ব্যবহার করবে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে এক কনটেইনার পণ্য আখাউড়া হয়ে ভারতের আগরতলা পৌঁছতে ট্রেইলর ভাড়া হবে ৩৫ হাজার টাকা; পুরোটাই বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা পাবেন। সেই সঙ্গে পণ্য চালান কাস্টমস, বন্দরে ছাড়ের প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকবেন বাংলাদেশি সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান। চট্টগ্রাম বন্দর আগে থেকেই বলে আসছে ট্রানজিট বা ট্রান্সশিপমেন্ট পণ্য পরিবহনে তাঁরা প্রস্তুত। বন্দরের কী লাভ জানতে চাইলে বন্দর পরিচালক (পরিবহন) এনামুল করিম কালের কণ্ঠকে বলেন, বিশ্বের সব বন্দরেই ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্টের জন্য পৃথক কোনো ট্যারিফ রাখে না। সাধারণ সব ট্যারিফই প্রযোজ্য। ফলে বন্দরে কোনো মাসুল ছাড় নেই। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আগে যখন মিয়ানমার ও নেপালে ট্রান্সশিপমেন্ট পণ্য পরিবহন করেছি তখনো ট্যারিফ একই ছিল। তবে ওই জাহাজ বন্দরে অগ্রাধিকার (ডেডিকেটেড নয়) বার্থিং পাবে। আর নিয়মানুযায়ী ১৪ দিন পর্যন্ত ট্রানজিট পণ্য বন্দরে বিনা মাসুলে রাখা যায়। তবে রাজস্ব বোর্ড যেহেতু বলেছে সাত দিনের মধ্যে সেই পণ্য ছাড় নিতে হবে।

বিদেশি জাহাজ পরিচালনাকারী জিবিএক্স লজিস্টিকস লিমিটেডের অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট মুনতাসির রুবাইয়াত বলছেন, ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্টে আসা কনটেইনার থেকে বন্দর কোনো বাড়তি মাসুল না পেলেও দেশের অর্থনীতির স্বার্থে বন্দরের বহুমুখী যোগাযোগ বাড়ার স্বার্থে সুযোগটা দেওয়া উচিত। কারণ বাড়তি একটি কনটেইনার দেশে আসা মানে বন্দরের বাড়তি আয়, জাহাজের বাড়তি আয়, কনটেইনার লাইনগুলোর বাড়তি আয়, কাস্টমসের আয়। সব টাকা কিন্তু যোগ হয়ে দেশের অর্থনীতিতেই অবদান রাখছে।

 

সুত্রঃ কালের কণ্ঠ