ঘাটে ঘাটে নতুন প্রবেশ ফি কার্যকর যে কোনোদিন

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

 

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) নতুন শুল্কহার অনুমোদন করেছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। এ শুল্কহার কার্যকর করতে সংস্থাটিকে সোমবার চিঠি দেয়া হয়েছে। ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে যে কোনোদিন নতুন ফি কার্যকর করার ঘোষণা হতে পারে। এর আগে সংস্থাটি ফি পুনর্নির্ধারণ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠায়।

জানা গেছে, নতুন ফি কার্যকর হলে দেশের প্রত্যেকটি ঘাটে প্রবেশে বাড়তি টাকা গুনতে হবে যাত্রীদের। ঢাকা নদীবন্দর (সদরঘাট), বরিশাল, চাঁদপুর, খুলনা ও ভোলাসহ কয়েকটি বড় লঞ্চ বন্দরে যাত্রীদের প্রতিবার প্রবেশে ৫ টাকার পরিবর্তে ১০ টাকা দিতে হবে।

অন্যান্য লঞ্চঘাটেও যাত্রী প্রবেশ ফি বাড়বে। এছাড়া শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ী এবং পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে গাড়ি প্রবেশ করাতে বাড়তি ফি গুনতে হবে। প্রবেশ ফি ছাড়াও বন্দর, নৌপথ ইকোপার্ক ব্যবহারসহ বিভিন্ন উপখাতে শুল্কহার বাড়বে। নৌপরিবহন ও বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিআইডব্লিউটিএর বন্দর বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, নতুন অর্থবছরে এ ফি কার্যকর হলে লাভবান হবেন ইজারাদাররা। কারণ তারা বিদ্যমান প্রবেশ ফি ধরেই ইজারা নিয়েছেন। নতুন ফি কার্যকরের পরই তারা যাত্রীদের কাছ থেকে বাড়তি ফি আদায় শুরু করবেন।

বাড়তি আদায় করা এসব টাকা বিআইডব্লিউটিএ পাবে কিনা- তা দেখার বিষয়। তাদের শঙ্কা, ঈদের আগে নতুন ফি কার্যকর হলে ঘাটে ঘাটে অস্থিরতা সৃষ্টি এবং ঘরমুখো সাধারণ মানুষের মধ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে।

নতুন ফি কার্যকরের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আবদুস সামাদ বলেন, বিআইডব্লিউটিএর শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব পর্যালোচনা করে মন্ত্রণালয়ের একটি কমিটি প্রতিবেদন দিয়েছে। আমরা নতুন ফি অনুমোদন দিয়ে কার্যকর করতে বলেছি।

যেহারে ফি বাড়ছে তাতে তেমন একটা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে না। কারণ মানুষের আয় বেড়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নতুন ফি কার্যকর করতে গিয়ে ইজারাদাররা যাতে যাত্রী হয়রানি করতে না পারে সেদিকে নজর রাখা হবে।

বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ ২০০৫ সালে সংস্থাটির শুল্কহার বাড়ানো হয়। দীর্ঘ বিরতির পর আবার বাড়ানো হচ্ছে। এতে আয় বাড়বে। যদিও সংস্থার উন্নয়ন কার্যক্রমে ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। আরও জানা গেছে, গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বন্দর রাজস্ব খাত থেকে প্রায় ১৬০ কোটি টাকা আয় হয়েছে।

বর্তমানে সারা দেশে ৩৮৩টি ঘাট বা পয়েন্ট ইজারার আওতায় রয়েছে। এর মধ্যে ২৬৩টি লঞ্চঘাট, ৯২টি লেবার হ্যান্ডলিং/শুল্ক আদায় পয়েন্ট, ৯টি ল্যান্ডিং স্টেশন, ১৫টি ফেরিঘাট ও উপকূলীয় টার্মিনাল জেটিঘাট। এছাড়া বেশ কিছু ঘাট ও পয়েন্টে সংস্থাটির কর্মচারীদের মাধ্যমে শুল্ক আদায় করা হয়।

তবে কবে থেকে নতুন ফি কার্যকর করা হবে সে বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি সংস্থাটি। যদিও নৌ মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে পহেলা জুলাই থেকে নতুন ফি আদায়ের কথা বলা হয়েছে। এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমোডর এম মাহবুব-উল ইসলাম বলেন, পহেলা জুলাই থেকে নতুন ফি কার্যকর করতে বলা হয়েছে। আমরা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত দ্রুত বাস্তবায়ন করব।

এমনকি ঈদের আগেও নতুন ফি কার্যকর হতে পারে। সেই প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। নতুন অর্থবছরের প্রায় এক মাস অতিবাহিত হওয়ার পর নতুন ফি কার্যকরের বিষয়ে তিনি বলেন, ইজারাদারদের কাছ থেকে কীভাবে বাড়তি টাকা আদায় করা যায় তা পর্যালোচনা করে একটি পথ বের করা হবে। তবে যাত্রী হয়রানির বিষয়ে কঠোর অবস্থান নেয়া হবে।

নতুন ফি আরোপের আগে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী। তিনি বলেন, ঘাটগুলোতে লুটপাটের মহোৎসব চলছে।

বিভিন্ন বন্দরে যাত্রীদের কাছ থেকে প্রবেশ ফির নামে যে টাকা আদায় তার বড় অংশ আদায়কারী ও ভিআইপি আপ্যায়নের নামে খরচ করা হয়। ঘাটে ঘাটে যাত্রীদের নাজেহাল করে ইজারাদাররা। নতুন ফি কার্যকরের আগে যাত্রী হয়রানি বন্ধ ও সেবার মান বাড়াতে হবে।

জানা গেছে, নতুন ফি কার্যকর হলে ঢাকার সদরঘাট, নারায়ণগঞ্জ, বরিশাল, চাঁদপুর, খুলনা, নরসিংদী, পটুয়াখালী, বরগুনা ও ভোলার টার্মিনাল ভবনে প্রবেশ ফি ৫ থেকে বেড়ে ১০ টাকা আদায় করা হবে।

ভবন নেই বা আধাপাকা টিনশেড আছে এমন টার্মিনাল যেমন- আরিচা, শিমুলিয়া, আশুগঞ্জ, ভৈরববাজার, দৌলতদিয়া, নগরবাড়ী, টঙ্গী , কক্সবাজার, চরজানাজাত, মেঘনাঘাটসহ অন্যান্য ঘাটের ফি ৪ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫ টাকা এবং ওয়েসাইড লঞ্চ স্টেশন, টার্মিনাল, জেটিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে ৩ থেকে বাড়িয়ে ৫ টাকা হবে।

ফেরিঘাটে গাড়ি প্রবেশের ফি বাড়বে ২০ থেকে ৩৩ শতাংশ পর্যন্ত। ফেরি টার্মিনালে বাস, ট্রাক, মিনিট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, ট্রেলার ও ট্যাঙ্ক-লরি প্রবেশে বিআইডব্লিউটিএর ফি ৬০ থেকে বাড়িয়ে ৭৫ টাকা, মাইক্রোবাস, পিকআপ ভ্যান ও স্টেশন ওয়াগন প্রবেশে ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৪০ টাকা এবং টেম্পোসহ তিন চাকার যানবাহনে ২৫ থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হবে। এছাড়া সব নদীবন্দরে বিআইডব্লিউটিএর সড়ক ব্যবহারের ফিও বেড়েছে। বন্দর এলাকায় বোঝাই বাস-ট্রাক প্রবেশে ৫০ থেকে বাড়িয়ে ৭৫ টাকা করা হবে।

নতুন ফি অনুযায়ী নৌযান মালিকদের ওপর বেশি ফি আরোপ হচ্ছে। নৌপথ সংরক্ষণ যেমন ড্রেজিং, সিগন্যাল বাতি স্থাপনসহ অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালনায় নৌযান থেকে কঞ্জারভেন্সি চার্জ আদায় করে বিআইডব্লিউটিএ।

এ খাতের ফি দিতে হয় নৌযান মালিকদের। কঞ্জারভেন্সি ফি লঞ্চ ও জাহাজ থেকে যাত্রীপ্রতি বছরে ১০০ থেকে বাড়িয়ে ১১৫ টাকা, স্পিডবোটে যাত্রীপ্রতি ৪১৪ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০০ টাকা এবং সব পণ্যবাহী জাহাজ ও ফিশিং ট্রলার থেকে প্রতি গ্রস টনে ৪৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০ টাকা করা হচ্ছে।

আর বিদেশি পতাকাবাহী মালবাহী জাহাজের ফি ১৭২.৫০ থেকে বাড়িয়ে ২১০ টাকা হবে। তবে নৌ-প্রটোকলের অধীনে থাকা জাহাজের আওতায় আসবে না। নৌপথে জাহাজ সঠিক পথে চলার দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকে বিআইডব্লিউটিএর পাইলটরা। প্রতি আট ঘণ্টার (প্রতি বিট) জন্য পাইলটেজ ফি ১০০ টাকা বাড়িয়ে ৫০০ টাকা সুপারিশ করা হয়েছে।

নদীর তীরভূমি ব্যবহারের ফিও বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। বর্তমানে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মিরকাদিম, টঙ্গী, মেঘনাঘাট ও ঘোড়াশাল এলাকায় প্রতি শতাংশ বার্ষিক ৩ হাজার ৪৫০ টাকা ও অন্যান্য এলাকায় ১ হাজার ৭২৫ টাকা ফি নির্ধারিত রয়েছে।

নতুন ফি বাস্তবায়ন হলে প্রতি মাসে শতাংশপ্রতি ২৮৯ টাকা ও অন্যান্য এলাকায় ১৪৪ টাকা হারে দিতে হবে। নদীর তলদেশ বা তীরভূমি খনন ফি ৭ হাজার ৫০০ থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা করা হচ্ছে। এছাড়া সংস্থাটির বিভিন্ন স্থাপনা, ইকোপার্ক, জাহাজ ও অবকাঠামো ব্যবহারের ফিও বাড়ানো হচ্ছে।

নতুন যেসব উপখাতে ফি আরোপ : অন্তত ২৫টির বেশি উপখাতে নতুন ফি আরোপ করার কথা বলা হয়েছে। এর বেশির ভাগই পণ্যবাহী নৌযান সংশ্লিষ্ট। সুপারিশে বন্দরে অলস বসে থাকলে নৌযানকে ফি দেয়ার নতুন নিয়মে পড়তে হবে।

এক্ষেত্রে ঢাকা, বরিশাল, চাঁদপুরসহ অন্যান্য বন্দরে যাত্রীবাহী লঞ্চকে ৭ টাকা হারে, ৫০ টন পর্যন্ত মালবাহী জাহাজের ক্ষেত্রে ৬২ টাকা এবং এর বেশি পণ্য পরিবহনকারী জাহাজকে নির্দিষ্ট হারে মুরিং চার্জ দিতে হবে। বন্দর এলাকায় মাল ওঠানামার জন্য ল্যান্ডিং অ্যান্ড শিপিং চার্জ প্রতি টনে ৩৪.৫০ টাকা, ফেরি টার্মিনালে কার ও জিপপ্রতি ৩৫ টাকা, মোটরসাইকেলে ২০ টাকা ধরা হয়েছে।

বিআইডব্লিউটিএর উন্নয়নকৃত জমিতে বিদেশি সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করলে প্রতি ১৫ হাজার টাকা ফি দিতে হবে। নদীর উপরিভাগে নিজস্ব ভূমিতে শিল্প-কারখানা বা স্থাপনা নির্মাণের আগে অনাপত্তি নিতে ১০ হাজার টাকা ফি দিতে হবে।

যেসব নৌপথ খনন করে নাব্য ধরে রাখা হয় এমন রুটে শুল্ক আরোপ করা হচ্ছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম নৌপথে পণ্যবাহী জাহাজের প্রতি গ্রস টনে ৮ টাকা, গোয়ালন্দ-রূপপুর ৫ টাকা, ঢাকা-বরিশাল ৫ টাকা, ঢাকা-আশুগঞ্জ-ছাতক ৫ টাকা, খুলনা-গোপালগঞ্জ ৫ টাকা, কক্সবাজার-মহেশখালী ৫ টাকা এবং সাভার-মিরপুর রুটে ৫ টাকা হারে ফি দিতে হবে। একইভাবে আরও কয়েকটি উপখাতে নতুন ফি আরোপ করতে যাচ্ছে বিআইডব্লিউটিএ।