গৌরবের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

মো. সফিকুল ইসলাম


ড. কাজী আব্দুল লতিফ স্যার তখন ঢাকার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে প্রতিষ্ঠা তিনি করেন রসায়ন বিভাগ। ১৯৫৮ সালে যাত্রা করে এই বিভাগ। তিনি কুমিল্লার মানুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে সেই পঞ্চাশের দশকে সুদূর রাজশাহীতে চলা আসা এখন স্বপ্নের ভাবা যায় না। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার তীব্র প্রত্যয়ে তিনি এখানে ছুটে আসেন। এমন আরও বহু বিরল দেশপ্রেমিক শিক্ষকে ধন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। সূত্র: ডেউলী বাংলা
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আমাদের গৌরবের শেষ নেই। আমাদের জীবনকে আলোকিত করেছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়; মতিহারের এই সবুজ চত্ত্বর। এখানেই আমরা সত্যব্রতী হয়েছি। সত্য আর মিথ্যার প্রভেদ শিখেছি।
বিদ্যালয়-কলেজ ও পরিবারে আমাদের মূল্যবোধের সূচনা হয়েছে; উচ্চশিক্ষার আকাংখা তৈরি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যলয়ের উচ্চশিক্ষায় সেই মূল্যবোধ প্রগাঢ় হয়েছে। আলোয় আলোয় দীপ্ত করেছে আমাদের জীবন।
আমাদের মধ্যে সেই আলোকবর্তিকা জ্বালিয়ে দিয়েছে আমার স্যারেরা। আমার স্যার প্রফেসর ড. এ বি এম হোসেন স্যার। ‘বেঁচে থাকার জন্য বেঁচে থাকা নয়, জানবার জন্যেই জীবন’;—এই দীক্ষাই স্যার দিয়েছেন আমাদের। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ‘ইমেরিটাস প্রফেসর’। এখানে স্যারের শিক্ষকতা জীবন ষাট বছর। চল্লিশ বছর নিয়মিত শিক্ষক, কুড়ি বছর ইমেরিটাস প্রফেসর। স্যার চলে গেছেন চিরতরে, একবছর হয়নি এখনও।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স এখন ৬৮। দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয়। দীর্ঘদিন-ধরে উত্তরবঙ্গের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। রাজশাহীর প্রখ্যাত আইনজীবী মাদার বখ্শ এবং রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ ড. ইতরাত্ হুসেন জুবেরি যৌথ নেতৃত্বে চেষ্টায় অনেক আন্দোলন-সংগ্রামের পর ১৯৫৩ সালের ৩১ মার্চ প্রাদেশিক পরিষদে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হয়। ১৯৫৩ সালের ৬ জুলাই ড. ইতরাত্ হুসেন জুবেরিকে উপাচার্য নিযুক্ত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হয়। শুরুতেই ছয়টি বিভাগ খোলা হয় (বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস, আইন, দর্শন,অর্থনীতি) এবং শিক্ষার্থী ১৬১ জন।
সেই আটষট্টি বছর ধরে, বাংলাদেশে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে জ্ঞান অন্বেষণে শিক্ষার্থীরা মতিহারে ছুটে এসেছেন। এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে জ্ঞান অন্বেষণ করে তাঁরা তাঁদের জীবনকে পরিশুদ্ধ করেছেন। তাঁরা তাঁদের কর্মপ্রতিভা-প্রজ্ঞা দিয়ে সমাজ-সভ্যতার বিকাশ ঘটিয়েছেন। দেশ-উন্নয়নে কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীরা ‘মতিহারের দূত’ হয়ে দ্যূতি ছড়াচ্ছেন বিশ্বময়।

স্বনামখ্যাত প্রথিতযশা বহু পণ্ডিত শিক্ষক এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করেছেন, যাঁদের জ্ঞান-গরিমা পাণ্ডিত্যস্পর্শে সিক্ত হতো শিক্ষার্থীরা। এই গুণী-শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয়কে জ্ঞানের আধারে পরিণত করেছিলেন। পঠন-পাঠন, গবেষণা এবং গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞানসৃষ্টি ও বিতরণে এখনও অনেক শিক্ষক নিবেদিত আছেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ, হাবিবুর রহমান শেলী, ড. জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, ড. মমতাজউদ্দিন আহমেদ, মুস্তাফা নূর-উল ইসলাম, ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল, ড. মোশাররফ হোসেন, ড. আজিজুর রহমান মল্লিক, ড. বদরউদ্দিন উমর, ড. কাজী আবদুল মান্নান, ড. সফিউদ্দিন জোয়ার্দার, ইমেরিটাস প্রফেসর ড. এ বি এম হোসেন, ড. আহমদ হোসেন, ড. আব্দুল লতিফ, ড. শাহানারা হোসেন, ড. মনোয়ার হোসেন, ড. গোলাম মুরশিদ, ড. এফ আর খান, ড. আলী আসগর খান, ড. কাজী আব্দুল লতিফ, ড. আহমদ হোসেন, ড. আলী আনোয়ার, সনৎকুমার সাহা, ড. সোমনাথ ভট্টাচার্য্য, ড. দিলীপকুমার নাথ, ড. মফিজউদ্দিন আহমেদ, ড. সদরউদ্দিন আহমেদ, ড. গোলাম সাকলায়েন, ড. বদর উদ্দিন, ইমেরিটাস প্রফেসর ড. এ কে এম ইয়াকুব আলী, ড. এন্তাজুল এম হকের মতো বিশ্বমানের বহু পণ্ডিত।
সেই ধারার শিক্ষক প্রফেসর ইমেরিটাস ড. অরুণকুমার বসাক (পদার্থ বিজ্ঞান), যিনি আমৃত্যু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থাকবেন। এই আশি বছর বয়সেও স্যার সকাল নয়টায় ল্যাবে ঢুকেন। রাত ৮-৯টা পর্যন্ত ল্যাবে কাজ করেন। গভীর ধ্যানে তিনি গবেষণা করে চলেছেন।
প্রফেসর হাসান আজিজুল হক তাঁর সাহিত্যপ্রতিভা দিয়ে উপমহাদেশখ্যাত হয়েছেন। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবস্তম্ভ।
ড. ইৎরাত হোসেন জুবেরী, ড. মমতাজউদ্দিন আহমেদ, ড. খান সরোয়ার মুরশিদ, ড. আলী আহসান, ড. খান সরওয়ার মুরশিদ, ড. শামস-উল-হক, ড. মযহারুল ইসলাম, ড. এম আর সরকার, ড. এম এ রকীব, ড. আবদুল খালেক, ড. সাইদুর রহমান খান-এর মতো বিখ্যাত পণ্ডিত শিক্ষাবিদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। তাঁদের নাম উচ্চারণ করলে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে যায়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের জন্মপ্রভায় জড়িত থেকে এক রক্তস্নাত ইতিহাস গড়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. শহীদ শামসুজ্জোহা, যিনি রসায়নের শিক্ষক ছিলেন। ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি পাক-হানাদার বাহিনী তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে। ড. জোহার রক্তদান বিদ্যুৎগতিতে সকল বাংলার প্রান্তে প্রান্তে রণাঙ্গনে পৌঁছে যায়, মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করে। তরান্বিত হয় ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান।
শহীদ শিক্ষক ড. হবিবুর রহমান, শহীদ শিক্ষক সুখরঞ্জন সমাদ্দার, শহীদ শিক্ষক মীর আবদুল কাইয়ুমসহ বহু শিক্ষার্থী-কর্মচারীর রক্তে রক্তস্নাত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। জোহা হলে পাকসেনারা অস্থায়ী সেনানিবাস হিসেবে ব্যবহার করে একাত্তরে। জুবেরী ভবনকেও একই কাজে ব্যবহার করে। সমগ্র উত্তরজনপদের মুক্তিকামী বাঙালিদের ধরে জোহা হল ও জুবেরী ভবনে বন্দি করে নিষ্ঠুর নির্যাতনের পর হত্যা করে জোহা হলের পূর্বদিকে বিস্তীর্ণ খোলা মাঠে লাশ ফেলে দিতো। শতশত মা-বোন সম্ভ্রমহানি ঘটেছে জোহা হলে।
১৯৬২ সালের বিতর্কিত হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিল আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী-সহ সকল আন্দোলন সংগ্রামে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবময় অবদান রয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের প্রথম মিউজিয়ামও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৭৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ‘শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা’ নামের এই মিউজিয়াম যাত্র শুরু করে। যুদ্ধদিনের বহু নিদর্শন এখানে সংগ্রহ হয়েছে।
বাংলাদেশ বিষয়ক উচ্চ গবেষণার জন্য স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে দেশের প্রথম গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩ সালে, যার নাম- আইবিএস (ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ)। এখানে দেশি-বিদেশি ফেলোগণও গবেষণা করেন এবং গবেষণার স্বীকৃতি হিসেবে এমফিল ও পিএইচ-ডি ডিগ্রি প্রদান করা হয়। শুরুর দিকে বিদেশি পরিচালক ও শিক্ষক নিয়োজিত ছিলেন। আইবিএস-এর সুনাম বিশ্বজুড়ে।
বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতি-সাহিত্য ও ক্রীড়াঙ্গনের বহু নায়ক ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের। বরেণ্য শিল্পী এন্ড্রু কিশোর, রফিকুল আলম, আবিদা সুলতানা, ফরিদা পারভীন, কবি মহাদেব সাহা, ফাতেমাতুজ জোহরা, সাবিনা আক্তার রুনা, কবি মহাদেব সাহা, অভিনেত্রী লুৎফর নাহার লতা, সাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, নাট্যজন মলয় ভৌমিক, নাট্যজন মাসুম রেজার নাম সকলেই জানে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বরেণ্য দৌড়বিদ সাইদুর রহমান ডন। তিনি বাংলাদেশ থেকে অংশ নেয়া প্রথম অলিম্পিয়ান; জাতীয় পতাকা তিনিই বহনকারি। ১৯৮৪ সালে আমেরিকার লসএঞ্জেলেস-এ গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে তিনি অংশ নেন। সাইদুর রহমান ডন এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে কোনো পুরস্কার অর্জন করতে না পারলেও তাঁর মাধ্যমে অলিম্পিকের মত একটি বড় ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের অংশগ্রহণের সূচনা ঘটে। সাইদুর রহমান-সহ আর বহু খেলোয়াড় বিভিন্ন সময় সাফগেমস, এশিয়ান গেমস, বিভিন্ন জাতীয় স্পোর্টসে কৃতিত্বের অধিকারী হন।
আশির দশকের শেষ দিকের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষার্থী মোস্তাকিম ওয়াজেদ ভাইকে গভীর অনুরাগে স্মরণ করছি। তিনি তখন জাতীয় ফুটবল দলের নামী ফুটবলার। খেলতেন ট্রাইকিং পজিশনে। জাতীয় দলের হয়ে বহু গোল করেছেন। একবার তিনি আবাহনীর বিরুদ্ধে একাই দুই গোল করে ফাইনালে ঢাকা মোহামেডানকে লীগ চ্যাম্পিয়ন করান।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু গৌরবদীপ্ত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অনন্যসেরা ‘বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়াম’। বাংলার ইতিহাসচর্চার প্রধান পাদপীঠ দেশের প্রথম এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন এই মিউজিয়াম। পাঁচ হাজার বছর আগের সিন্ধুসভ্যতা-সহ প্রায় ১৭ হাজার প্রত্ননিদর্শন রয়েছে এখানে। এতো প্রাচীন প্রত্ননিদর্শন বাংলাদেশের আর কোনো মিউজিয়ামে নেই। ১৯১০ সালের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে অনানুষ্ঠানিকভাবে বরেন্দ্র-অনুসন্ধান সমিতি গঠিত হয়, আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠা একই বছরের প্রতিষ্ঠা ২৭ সেপ্টেম্বর। প্রতিষ্ঠাতা নাটোর দিঘাপতিয়ার রাজপরিবারের সন্তান দয়ারামপুরের রাজা কুমার শরৎকুমার রায়। বরেন্দ্র-অনুসন্ধান সমিতি পরে গড়ে তোলে বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়াম। ১৯৬৪ সালের ১০ই অক্টোবর থেকে সরকারি সিদ্ধান্তে এই মিউজিয়াম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠান।
বরেন্দ্র-অনুসন্ধান সমিতি ১৯১২ সালে ঐতিহাসিক রমাপ্রসাদ চন্দ প্রণীত ও ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় সম্পাদিত ‘গৌড়রাজমালা’। বিজ্ঞানসম্মত প্রণালীতে লিখিত গৌড়রাজমালা ‘বাংলার প্রথম লিখিত ইতিহাস’। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও আলোড়িত করে এই গ্রন্থ।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই গৌরব এখন বিপন্ন। বিশ্ববিদ্যালয়ে একাকি হাঁটলে মন অবনত হয়ে আসে; বিষাদে ভরে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য ‘সাবাশ বাংলাদেশ’ আর এখানকার ইট-কাঠ-কংক্রিট আর অনিন্দ্যসুন্দর প্যারিস রোডের গাছগুলোও যেন কেঁদে ওঠে আমাদের নেতিবাচক ক্রীড়া দেখে!
লেখক : উপ-রেজিস্ট্রার, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।