গোয়েন্দা নজরদারিতে চবি, ভর্তি পরীক্ষা ঘিরে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ২০২০-২০২১ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষা শুরু হচ্ছে আগামী ২৭ অক্টোবর। বিভিন্ন ইউনিটের এ পরীক্ষা চলবে ৫ নভেম্বর পর্যন্ত। আসন্ন এ পরীক্ষা ঘিরে ক্যাম্পাসজুড়ে নেওয়া হয়েছে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা। চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে গোটা ক্যাম্পাসকে আনা হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারির আওতায়। ছাত্রলীগসহ বিবাদমান বিভিন্ন সংগঠনগুলোর ওপর রাখা হচ্ছে বিশেষ নজরদারি। সংঘর্ষ, র্যাগিংসহ অপ্রীতিকর যে কোনো পরিস্থিতি এড়াতে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডি।

ক্যাম্পাসে কোনো সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে লিফলেট কিংবা প্রচারপত্র বিলি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সংঘর্ষের আশঙ্কা থেকে নতুন বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। চট্টগ্রাম জেলা ও মেট্রোপলিটন পুলিশের পাশাপাশি নিরাপত্তা নিশ্চিতে দায়িত্ব পালন করবে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।

বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা এলেই ছাত্রলীগের বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে উত্তেজনা কিংবা সংঘর্ষের আশঙ্কা দেখা দেয়। যদিও বিগত ভর্তি পরীক্ষার সময় কোনো সংঘর্ষ হয়নি। কিন্তু ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি না হওয়ায় গত ক’মাসে কয়েক দফা সংঘর্ষসহ উত্তেজনা বিরাজ করছে। আধিপত্য দেখাতে বিভিন্ন উপগ্রুপ পৃথকভাবে শোডাউনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলেও জানা গেছে। এর মধ্যে ছাত্রলীগ সভাপতি রেজাউল হক রুবেলের গ্রুপের সঙ্গে ‘এক হয়ে’ ভর্তিচ্ছুদের শুভেচ্ছা জানানোর আয়োজনে থাকার ‘সম্ভাবনা কম’ সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মোহাম্মদ ইলিয়াসের গ্রুপ বিজয়ের।

২০১৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর রেজাউল হক রুবেলের গ্রুপ সিএফসি ইলিয়াসের ওপর হামলা চালায়। এসময় সভাপতি রুবেল সাবেক সাংগঠনিক ইলিয়াসকে জঙ্গি সংগঠন হিজবুত তাহরীরের সদস্য আখ্যা দেন।

এর আগে অছাত্র, অযোগ্য আখ্যা দিয়ে ক্যাম্পাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০৬-২০০৭ সেশনের শিক্ষার্থী রেজাউল হক রুবেলের বিরুদ্ধে একই বছরের ২৩ জানুয়ারি আলাওল ও এফ রহমান হল থেকে ঝাড়ু মিছিল বের করে ইলিয়াসের নেতৃত্বাধীন বিজয় গ্রুপের নেতাকর্মীরা। এসব কারণে গত দুই বছরে সভাপতি রুবেলের অনুসারী সিএফসি গ্রুপ ও ইলিয়াসের বিজয় গ্রুপের মধ্যে তেমন রাজনৈতিক সমঝোতা দেখা যায়নি। আসন্ন ভর্তি পরীক্ষা ঘিরে এ দুগ্রুপের কোন্দল সংঘর্ষে রূপ নেয় কি না, তা ভাবাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টদের। ফরে এ দুগ্রুপের শীর্ষ নেতাদের ‘আলাদা’ করেই সতর্ক করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

এ বিষয়ে মোহাম্মদ ইলিয়াস বলেন, আমরা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ ঘোষিত প্রোগ্রাম নিজেরাই বাস্তবায়ন করি। কিছুদিন আগে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধেও আমরা বিক্ষোভ করেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিটি থাকলেও এসব প্রোগ্রাম তারা বাস্তবায়ন করেনি। এছাড়া গত ভর্তি পরীক্ষায়ও আমরা আলাদাভাবেই প্রোগ্রাম করেছি। এবারও আমরা স্বতন্ত্রভাবে ভর্তিচ্ছুদের পাশে দাঁড়াবো।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি রেজাউল হক রুবেল বলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যেহেতু দুটি ধারার রাজনীতির চর্চা হয়, সেক্ষেত্রে আমরা একসঙ্গেও প্রোগ্রাম করতে পারি আবার পৃথকভাবেও করতে পারি। এখনো আমরা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যদি ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে সংগঠন পরিপন্থি কোনো অপ্রীতিকর বা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়, তবে এর দায় সংগঠন নেবে না। আমরা তাদের বিরুদ্ধে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিতে প্রশাসনের প্রতি জোর দাবি জানিয়েছি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (হাটহাজারী সার্কেল) শাহাদাত হোসেন বলেন, ভর্তি পরীক্ষা উপলক্ষে এরইমধ্যে ক্যাম্পাসে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। পরীক্ষার দিন ক্যাম্পাস ও আশেপাশের এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন হবে। পাশাপাশি সাদা পোশাকে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একাধিক টিম কাজ করবে। সড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক রাখতে শহর এলাকায় নগর পুলিশের ট্রাফিক ইউনিট এবং আমান বাজার থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত জেলা পুলিশের ট্রাফিক ইউনিট কাজ করবে। এছাড়া হাটহাজারী ও নাজিরহাট সড়কে ট্রাফিক পুলিশের অতিরিক্ত ফোর্স কাজ করবে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সড়ক ও ক্যাম্পাসের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট সিসিটিভির আওতায় থাকবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. রবিউল হাসান ভূঁইয়া বলেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণের মধ্যে প্রথমবারের মতো ক্যাম্পাসে ভর্তি পরীক্ষা আয়োজন করা হচ্ছে। তাই স্বাস্থ্যবিধির বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হবে। মাস্ক ছাড়া কোনো শিক্ষার্থীকে হলে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। কোনো শিক্ষার্থী মাস্ক না নিয়ে এলে কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে সরবরাহ করা হবে। এছাড়া ভর্তি পরীক্ষা উপলক্ষে ক্যাম্পাসের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট সিসিটিভির আওতায় আনা হয়েছে। কোথাও কোথাও লাগানো হয়েছে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ক্যামেরা। এছাড়া নিরাপত্তার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন দায়িত্বশীল গোয়েন্দা সংস্থা কাজ করবে। সব মিলিয়ে ভর্তি পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে যাবতীয় প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের সুবিধার্থে পরীক্ষাকালীন প্রতিদিন এগারো বার করে মোট বাইশ বার বটতলী রেলস্টেশন থেকে শাটল ট্রেন ক্যাম্পাসে যাতায়াত করবে।

ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন টিপু বলেন, ছাত্রলীগ ঐক্যবদ্ধ হয়েই ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াবে। আমরা প্রশাসনকে সহযোগিতা করতে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি।

বিশ্ববিদ্যালয় আইসিটি সেল সূত্রে জানা গেছে, এবার অনলাইনে মোট আবেদন জমা পড়েছে এক লাখ ৮৩ হাজার ৮৬৩টি। বিশ্ববিদ্যালয়ে চারটি ইউনিট ও দুটি উপ-ইউনিট মিলে আসন রয়েছে চার হাজার ৯২৬টি। সে হিসাবে প্রতি আসনের বিপরীতে লড়বেন ৩৭ জন শিক্ষার্থী।

‘এ’ ইউনিটে এক হাজার ২১২টি আসনের বিপরীতে আবদেন জমা পড়েছে ৬৮ হাজার ১০৬টি। এই ইউনিটে প্রতি আসনের বিপরীতে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫৬ জন। ‘বি’ ইউনিটে এক হাজার ২২১টি আসনের বিপরীতে আবদেন জমা পড়ে ৪২ হাজার ৬৬৮টি। এ ইউনিটে প্রতি আসনের বিপরীতে ভর্তির জন্য লড়বেন ৩৫ জন। ‘সি’ ইউনিটে ৪৪১টি আসনের বিপরীতে আবেদন জমা পড়ে ১৩ হাজার ৯১৮টি। এ ইউনিটে প্রতি আসনে ভর্তির জন্য লড়বেন ৩২ জন। ‘ডি’ ইউনিটে এক হাজার ১৬০টি আসনের বিপরীতে আবেদন জমা পড়ে ৫৪ হাজার ২৪৯টি। সম্মিলিত এ ইউনিটে প্রতি আসনের বিপরীতে লড়বেন ৪৭ জন।

এছাড়াও দুটি উপ-ইউনিটের মধ্যে ‘বি১’ ইউনিটে ১২৫টি আসনের বিপরীতে আবেদন পড়েছে দুই হাজার ২০টি। এ উপ-ইউনিটে প্রতি আসনের বিপরীতে ভর্তির জন্য লড়বেন ১৬ জন। এছাড়া ‘ডি১’ উপ-ইউনিটে ৩০টি আসনের বিপরীতে আবেদন জমা পড়ে দুই হাজার ৯০২ টি। এ উপ-ইউনিটে আসন প্রতি লড়বেন ৯৭ জন শিক্ষার্থী।

চবিতে ভর্তি পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিল ২২ জুন। আর শেষ হওয়ার কথা ছিল ১ জুলাই। করোনা পরিস্থিতিতে তা পিছিয়ে আগস্ট মাসে আনা হয়। সবশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ২৭ ও ২৮ অক্টোবর ‘বি’ ইউনিট, ২৯ অক্টোবর ‘সি’ ইউনিট, ৩০ ও ৩১ অক্টোবর ‘ডি’ ইউনিট এবং ১ ও ২ নভেম্বর ‘এ’ ইউনিটের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া ৫ নভেম্বর উপ-ইউনিট ‘বি-১’ ও ‘ডি-১’ এর ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।

এ বছরও চবিতে ভর্তি পরীক্ষা হবে ১২০ নম্বরে। এর মধ্যে ১০০ নম্বর লিখিত পরীক্ষা (বহুনির্বাচনী) ও বাকি ২০ নম্বর এসএসসি ও এইচএসসির জিপিএ অনুযায়ী যুক্ত হবে। বহুনির্বাচনী পদ্ধতির এ ভর্তি পরীক্ষায় প্রতিটি ভুল উত্তরের জন্য শূণ্য দশমিক ২৫ নম্বর কাটা যাবে। পরীক্ষায় ন্যূনতম পাস নম্বর হবে ৪০।

 

সূত্রঃ জাগো নিউজ