‘গোল মাল’ আছে? জমজমাট নি‌ষিদ্ধ কচ্ছ‌পের হাট

ভোর কিংবা ভর সন্ধ্যেবেলা বরগুনা শহরের জমজমাট বাজারে মাছের পসরা সাজিয়ে বসেন খোকন দা। ট্যাংরা, লইটকা, পোয়া আর গলদার রুপালি স্তূপে মাথা উঁচু করে আছে বিশাল এক বঁটি। ক্রেতাদের ভিড়ে নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই তাঁর। সমানে চলছে দরদাম, কেনাকাটা আর কাটাকুটি। এর মধ্যেই একটু ফাঁক বুঝে, খোকনদার কাছে গিয়ে নিচু স্বরে, অনেকটা যেন অবৈধ জিনিস কেনার মতো সতর্কতা নিয়ে, আলতো করে জিজ্ঞেস করতে হবে, ‘গোল মাল’ আছে?

ভাবছেন, গোল মাল কী? বৈজ্ঞানিক ভাষায় এই ‘গোল মালের’ নাম লিসেমিস পাংটাটা পাংটাটা। প্রথমবার শুনলে আপনার কাছে ধাঁধা মনে হবে? না, এত জটিল ধাঁধা নয়। সহজ ভাষায়, কচ্ছপ। গ্রামে যার পরিচিতি ‘ধুর’ হিসেবে। সবাই এ নামেই চেনেন। এ নামে খোকনদা বিব্রতবোধ করেন। নিষিদ্ধের কারনে এখন বিক্রেতার নতুন সাংকেতিক ভাষায় ‘গোল মাল’। মাছের আড়ালে এদের পসরা নিয়ে বরগুনা মাছ বাজারে জমিয়ে ব্যবসা করছেন খোকনদা।

কচ্ছপ যেভাবে বিক্রি হয়
প্রাথমিকভাবে দরদাম নিয়ে প্রশ্ন করতে আপনাকে অবশ্য প্রথমে ভালো করে মেপে নেবেন খোকন। আপনি আবার পুলিশ, বন কর্মকর্তা কিংবা পরিবেশপ্রেমী সংগঠনের সদস্য নন তো। সেটা নিশ্চিত হয়ে তবেই মুখ খুলবেন ব্যবসা নিয়ে। প্রথমে হাসবেন খোকনদা। তার পর খোকনদা চোখের ইশারায় আপনাকে নিয়ে যাবে মাছে ভর্তি প্লাস্টিকের ঝুঁড়ির পেছন দিকে। ছোট ছোট প্লাস্টিকের ঝুঁড়ির মধ্যে দৌড়ে বেড়াচ্ছে ‘গোল মাল’-এর দল।

এবার পালা পছন্দ করে চূড়ান্ত দর-দস্তুর করার। সে পর্বটা মিটে গেলে, ওজন-যন্ত্র হয়ে সেই ‘গোল মাল’কে মাছের বঁটিতেই কাটবেন খোকনদা। তার আগে যত্ন করে খোলস ছাড়িয়ে, পরিষ্কার করে, মাপ-মতো টুকরো করে, প্যাকেটে বেঁধে তুলে দেবেন আপনার হাতে। ব্যস, এ ভাবেই দেদার বিকাচ্ছে ‘গোল মাল’। আগে থেকে একটা ফোন করে রাখলে ভালো, ‘মাল’ চলে আসবে চাহিদামতো। ফোন না-করলেও মাছ কেনার মতো করেই মিলতে পারে বাজারে গিয়ে, তবে তা নির্ভর করছে জোগানের ওপর।

কিন্তু এ রকম খোলা বাজারে, কিভাবে বিক্রি হচ্ছে কচ্ছপ? কিনছেনই বা কারা? এলাকায় কথা বলে জানা গেল, ওই বাজারে কচ্ছপের চাহিদা ভালোই। আশপাশের অঞ্চল থেকে তো বটেই, বহু দূর থেকেও মানুষ কচ্ছপ কিনতে আসেন সেখানে। কচ্ছপের মাংস সুস্বাদু বলেই পরিচিত। তাই বিক্রিও চলছে সমানেই। হোক সে বিপন্ন প্রজাতির, হোক তা বিক্রি নিষিদ্ধ। মানুষের লালসা আর চাহিদার কাছে এগুলো কোনো বাধাই নয়। আর সেই চাহিদা বুঝেই আসতে থাকে জোগান।

ক্রেতা সেজে বাজারে
বরগুনা শহরের ভাড়ানী খালের প্রবেশদ্বর আর খাকদোন নদীর তীরেই মাছের সবচেয়ে বাজার। সেই বাজারে জনৈক খোকনদার কাছে ৮ অক্টোবর প্রথম দিন গিয়ে কচ্ছপের কথা জিজ্ঞেস করতেই প্রশ্ন এলো, ‘কতটা লাগবে’? উত্তর দেওয়ার পর ফোন ঘোরালেন তিনি। ‘গোল মাল হবে নাকি? ..আচ্ছা, ছোট? ঠিক আছে, খান তিনেক পাঠাতে হবে’। বিক্রেতাই জানালেন, পাথরঘাটা আর তালতলী থেকে মোটরসাইকেলে করে নিয়ে আসা হয় প্রাণীগুলোকে। চাহিদা বেশি হলে কখনও কখনও নৌকায় করেও আসে এলাকায়।

১২ অক্টোবর সকালে কালের কণ্ঠের এ প্রতিবেদক বরগুনার এক সংবাকর্মীকে খোকনের মাছের আড়ৎ এ পাঠান। তিনি গিয়েও দোকানের পেছনে রাখা প্লাস্টিকের ঝুড়িতে ৮টি কচ্ছপ দেখতে পান। তার উপস্থিতিতেই এক ক্রেতা ৫০০ টাকা কেজি দরে দুটো কচ্ছপ কিনে নেন। তখন মাছের বাজারজুড়ে শতশত ক্রেতার ভিড় ছিল। ‘কচ্ছপ বিক্রি নিষিদ্ধ সেটা জানেন’? এই প্রশ্নের পরে আমতা আমতা করে খোকন দাবি করলেন, ‘আমি খুব একটা বিক্রি করি না। কিন্তু কচ্ছপের জন্য অনেকেই বলে রাখেন। কয়েকটি জেলেরা পেয়েছিল। তা আমার কাছে রেখে গেছে’।

মাছ বাজারের অনেক ব্যবসায়ী খোকনের এই অবৈধ কারবারের কথা জানেন। তার পাশের মাছের আড়তদার দেলোয়ার হোসেন প্রায়ই গোপনে কচ্ছপ বিক্রি করেন। তবে তিনি প্রকাশ্যে নন, যারা বিত্তশালী তাদের সঙ্গে ফোনে গোপন রফা করার পরেই ‘মাল’ পৌঁছে দেন চাহিদামতো। দেদার বিক্রি, ঢালাও লাভ! তবে দেলোয়ার হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, আমি নিষিদ্ধ কচ্ছপ বিক্রি করি না। একটি পক্ষ আমাকের হেনস্তা করতেই মিথ্যা তথ্য দিয়ে সাংবাদিকদের বিব্রত করছে।

সংশ্লিষ্টরা যা বললেন
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) বরগুনা অঞ্চলিক শাখার সাধারণ সম্পাদক মুশফিক আরিফ বলেন, পেটের পীড়া দেখা দিলে ছোট ছোট কচ্ছপ খাবার রেওয়াজ আছে। কিন্তু তাই বলে নিষিদ্ধ কচ্ছপ বরগুনার জেলা শহরের বাজারে বিক্রি হচ্ছে এটা মেনে নেওয়া যায় না। এ ব্যাপারে প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে বিলুপ্তপ্রায় কচ্ছপ রক্ষার জন্য পরিবেশ আন্দোলন মাঠে নামতে বাধ্য হবে।

বরগুনা মাছের বাজারে কচ্ছপ বিক্রির কথা জানানোর পরেই বরগুনা সদরের ভারপ্রাপ্ত বন কর্মকর্তা মতিয়ার রহমান বললেন, আমাদের কাছে তো কোনো খবর নেই! আমি নিয়মিত এলাকার বাজারগুলোয় টহল দিই। কিন্তু তার পরেও বন বিভাগের নাকের ডগায় কি করে চলছে এমন কাজ? তার উত্তর, খবর পেলাম, যত দ্রুত সম্ভব পদক্ষেপ নেব।

বরগুনা শহরে কচ্ছপ বিক্রির খবর তার কাছে কখনও আসেনি বলে জানালেন সদর থানা ওসি কে এম তারিকুল ইসলাম। সাধারণত এই ধরনের ক্ষেত্রে উদ্ধার কাজের সময় স্থানীয় পুলিশের সহায়তা নেয় বন বিভাগ। কিন্তু খবর পেলে আমরাও তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ গ্রহণ করি। ধরপাকড় করি। এ ক্ষেত্রেও ব্যবস্থা নিতে দেরি করব না।

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ