গোদাগাড়ীতে হেরোইন আত্মসাতে পাঁচ পুলিশ হত্যা করে রফিকুলকে

নিজস্ব প্রতিবেদক:

হেরোইন আত্মসাতের জন্য রাজশাহীর গোদাগাড়ী থানার পাঁচ পুলিশের বিরুদ্ধে এক ব্যক্তিকে হত্যার অভিযোগ উঠেছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার পোলাডাঙ্গা গ্রামের রফিকুল ইসলাম (৩২) হত্যা মামলায়  গ্রেপ্তারকৃত আসামি ইসাহাক আলী ওরফে ইসা (২৯) শুক্রবার রাজশাহীর সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট উজ্জ্বল মাহমুদের সামনে ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দীতে পাঁচ পুলিশের হাতে রফিকুল নিহত হবার কথা স্বীকার করে জবানবন্দী দেন বলে আদালত সূত্র নিশ্চিত করেছে।

বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর এ নিয়ে রাজশাহী জেলা পুলিশের ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। ইসার দেওয়া জবানবন্দীতে যেসব পুলিশদের নাম রফিকুল হত্যাকাণ্ডে এসেছে তারা ঘটনার সময় গোদাগাড়ী থানায় কর্মরত ছিলেন।

আসামি ইসাহাক আলী ইসার স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দীতে রফিকুল হত্যাকাণ্ডে জড়িত যাদের নাম উঠে এসেছে তারা হলেন,  গোদাগাড়ী থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মিজানুর রহমান, এসআই আবদুল মান্নান, এসআই রেজাউল ইসলাম, কনস্টেবল শাহাদাত হোসেন ও কনস্টেবল শফিকুল ইসলাম।

 

জবানবন্দী প্রদানকারী ইসাহাক আলী ইসা গোদাগাড়ী পৌর এলাকার মাদারপুর গ্রামের রেজাউল ইসলামের পুত্র। ইসাহাক একজন মাদক ব্যবসায়ী বলে জানা গেছে।

জানা গেছে, গত ২২ মার্চ গোদাগাড়ীর দেওয়ানপাড়া পদ্মার চর থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার পোলাডাঙ্গা গাইনপাড়া গ্রামের ফজলুর রহমানের পুত্র রফিকুল ইসলামের লাশ পাওয়া যায়। লাশ উদ্ধারের পর থানা পুলিশ ওই ব্যক্তি বজ্রপাতে মারা গেছেন বলে একটি অপমৃত্যুর মামলা করেন।

তবে নিহতের স্ত্রী রুমিসা খাতুন (২৬) গত ১৭ জুন বাদী হয়ে  চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার আবদুল মালেকের ছেলে শরিফুল ইসলাম (৩২) এবং একই এলাকার আজাদ আলীর ছেলে জামাল উদ্দিনকে (৩২) আসামি করে গোদাগাড়ী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলাটি গত জুনে রাজশাহী পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেষ্টিগেশান বা পিবিআইতে স্থানান্তর হয়।

আদালত সূত্র  থেকে জানা গেছে,  ২২ মার্চ  রফিকুল ইসলামের লাশ উদ্ধার হয়। তবে ২১ মার্চ রাতে গোদাগাড়ী থানার অভিযুক্ত পাঁচ পুলিশ উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে বা থানায় কোন জিডি রেকর্ড না করেই  একই এলাকায় মাদক উদ্ধার অভিযানে যায়। পুলিশের দলটি ২১ মার্চ রাতে একই এলাকা থেকে আজাদ আলীর ছেলে মাদক ব্যবসায়ী জামাল উদ্দিককে (৩২) ১০০ গ্রাম হেরোইনসহ আটক করেন। থানায় ফিরে ওই রাতেই পুলিশ জামাল উদ্দিনকে গ্রেপ্তার ও নিহত রফিকুলকে পলাতক আসামি করে মাদক আইনে একটি মামলা রেকর্ড করেন। তবে রাত শেষেই ২২ মার্চ সকালে পুলিশের দায়ের করা মামলার পলাতক আসামি রফিকুল ইসলামের লাশ পদ্মার চরে পাওয়া যায়। 

পুলিশ রফিকুল ইসলামের লাশ উদ্ধার করে ময়না তদন্তের জন্য রামেক মর্গে পাঠালেও নিজেরা বজ্রপাতে নিহত হওয়ার কথা বলে থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা করেন।

আদালত সূত্র  ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, ২১ মার্চ রাতে ১০০ গ্রাম হেরোইনসহ গ্রেপ্তার জামাল উদ্দিনকে গোদাগাড়ী থানার ওসি তদন্ত নিত্যপদ দাস মামলার তদন্তভার পান। তিনি আদালতের মাধ্যমে দুই দিনের রিমাণ্ডে নেন। পরে জামাল আদালতে বিচারিক হামিকের সামনে ১৬৪ ধারার জবানবন্দী দেন। জবানবন্দীতে জামাল উদ্দিন ওই সময় বলেন, রফিকুল ও তিনি টাকার বিনিময়ে হেরোইন পারাপার করেন। ২১ মার্চ রাতে সে ও রফিকুল হেরোইনসহ পদ্মার চর পার হওয়ার  সময় বজ্রপাত হলে রফিকুল মারা যায়।  তবে সে  পুলিশের হাতে ১০০ গ্রাম হেরোইনসহ ধরা পড়েন।

খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, ১৭ জুন রফিকুলের স্ত্রীর দায়ের করা হত্যা মামলাটি আদালত গত ২৩ জুন পিবিআইকে হস্তান্তরের আদেশ দেন। ৭ জুলাই মামলার  নথিপত্র পিবিআই গোদাাগাড়ী থানা থেকে বুঝে পান। এরপর তিনি রফিকুল হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনে মাঠে নামেন। রাজশাহী পিবিআই-এর এসআই জামাল উদ্দিন মামলাটি তদন্কত করছেন।

এদিকে সেই রহস্য সূত্রকে অনুসরণ করেন তদন্ত কর্মকর্তা এসআই জামাল উদ্দিন। গত ২৮ অক্টোবর গোদাগাড়ীর মাদারপুর গ্রামের  রেজাউল ইসলামের ছেলে ইসাহাক আলী ইসা, একই গ্রামের আজিজুল ইসলামের ছেলে ফরিদুল ইসলাম (২৫) ও আজাদ আলীর ছেলে মাহাবুব আলীকে গ্রেপ্তার করেন। রাজশাহী পিবিআই কার্যালয়ে নিয়ে রাতভর তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন। গ্রেপ্তার তিনজনের মধ্যে ইসাহাক আলী ইসা তদন্ত কর্মকর্তাকে রফিকুল হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে সবকিছু খুলে বলেন। পরদিন ৩০ অক্টোবর ইসাহাক আলী ইসা আদালতে স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দী দেন।

আদালত সূত্রে জানা গেছে, ইসা তার জবানবন্দীতে বলেছেন, ঘটনার কিছুদিন আগে হেরোইন পাঠানোর জন্য তিনি ভারতের মুর্শিদাবাদের কাশেম নামে এক ব্যক্তিকে দুই লাখ টাকা দেন। কাশেম প্রথমে তাকে নকল হেরোইন পাঠায়। কাশেমের পাঠানো হেরোইন তিনি  হেরোইনসেবীকে দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে নিশ্চিত হন যে সেগুলি নকল।

এরপর কাশেমের কাছে টাকা ফেরত চাইলে কাশেম তাকে আসল হেরোইন পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দেন।  তবে ১০০ গ্রামের বদলে তিনি কাশেমের কাছ থেকে বাকিতে আরও ৪০০ গ্রামসহ মোট ৫০০ গ্রাম হেরোইন দাবি করেন। মাল আসার দিনক্ষণ ঠিক হরে ইসা কাশেমকে ঠকানোর জন্য গোদাগাড়ী থানা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। যে মাল আসবে তা তিনি ধরিয়ে দেবেন তবে তাকে নগদ দুই লাখ টাকা দিতে হবে। বাকি মাল পুলিশ বিক্রি করলে ১৫ লাখ টাকা  পাবেন। আসল হেরোইন কেড়ে নিয়ে নকল হেরোইন দিয়ে দুই বাহককে চালান দিলেই ঝামেলা শেষ হয়ে যাবে।  সেই পরিকল্পনা  অনুযায়ী ২১ মার্চ রাতে রফিকুল ও জামাল উদ্দিন ভারতীয় মাদক ব্যবসায়ী কাশেমের দেওয়া ৫০০ গ্রাম হেরোইন নিয়ে পদ্মা নদীতে নৌকা থেকে নেমে ঘাটের দিকে যাচ্ছিলেন।

এদিকে ইসা পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ওই রাতে সাড়ে ৯টার দিকে গোদাগাড়ী থানার এসআই মিজানুর রহমান, এসআই মান্নান, এসআই রেজাউল ইসাম ও কনষ্টেবল শাহাদাৎ এবং শফিকুলকে নিয়ে  দেওয়ানপাড়ার পদ্মার সিড়িঘাটে ঘাপটি মেরে ছিলেন। ঘাটের দিকে যাওয়ার সময় পুলিশ রফিকুল ও জামালকে ধরে ফেলেন। রফিকুলের কাছে থাকা হেরোইন কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে পুলিশ। এ সময় অভিযানে থাকা সকল পুলিশ মিলে রফিকুলকে বেদম মারধর করেন। কিছুক্ষণ পর রফিকুল হাত পা ছেড়ে দিয়ে বালুর ওপর পড়ে যান। পুলিশরা তাকে লাথি মেরে ও হাত দিয়ে নড়িয়ে চড়িয়ে দেখেন। সাড়া না পেয়ে তারা নাকে হাত দিয়ে পরীক্ষা করেন রফিকুল বেঁচে আছেন কিনা। শেষে পুলিশের দলটি  নিশ্চিত হয়, রফিকুল মারা গেছেন।

ইসা তার জবানবন্দীতে আরও বলেন, এরপরই পুলিশ কর্মকর্তারা ঘাবড়ে যায়। তার সকলে মিলে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেন, জামালকে নকল হেরোইনের মামলা দিয়ে রফিকুলকে পলাতক দেখানো হবে। ঘটনা কাউকে জানতে দেওয়া যাবে না। এরপর প্রচণ্ড বৃষ্টি আসে। পুলিশ চরের মধ্যে রফিকুলের লাশ ফেলে দিয়ে জামালকে নিয়ে থানায় ফেরেন।

ইসা আদালতে আরও বলেন, রফিকুল মারা গেছেন দেখে তিনি দ্রুত ঘটনাস্থল থেকেপালিয়ে যান। পুলিশ কথা অনুযায়ী তাকে টাকাও দেননি এবং তিনি তাদের সঙ্গে আর যোগাযোগও করেননি। পুলিশও তার সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। পরে তিনি জানতে পারেন রফিকুল বিজলি পড়ে মারা গেছেন বলে থানার কাগজপত্রে লেখা হয়েছে।

এদিকে রাজশাহী পিবিআই এর একজন কর্মকর্তা জানান, তারা রফিকুলের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে দেখতে পান গুরুতর আঘাতজনিত কারনে মৃত্যু হয়েছে।  এছাড়া জামালের নামে দায়ের করা মাদক মামলাটিতে রফিকুলকে পলাতক আসামি করার ঘটনাটি এই চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। যে রাতেই তার মাদকের পলাতক মামলা হচ্ছে পরের দিন সকালেই তার লাশ মিলেছে-বিষয়টি ছিল খুবই রহস্যজনক এবং এখানে পুলিশের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি আরও জোরালো করে। এরই মধ্যে ৩০ অক্টোবর ইসা সব ঘটনা জানিয়ে আদালতে জবানবন্দী দিয়ে রফিকুল হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন হয়ে যায়। তদন্ত কর্মকর্তা এসআই জামাল উদ্দিন আরও জানান, এই মামলায় রফিকুলের সঙ্গী জামালকেও গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। তবে এজাহারভুক্ত আসামি শরিফুল এখনো পলাতক রয়েছে। আদালতের কাগজপত্র হাতে পাওয়ার পর পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।  

ঘটনার বিষয়ে গোদাগাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খাইরুল ইসলাম বলেন, তিনি গোদাগাড়ীতে যোগ দেয়ার কয়দিন পরই পদ্মার চরে রফিকুলের লাশটি পাওয়া যায়। তিনি বজ্রপাতে মারা গেছেন বলে প্রথমে শোনেন। এরপর হত্যা মামলা হলে জামালকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। এর কয়দিন পরই মামলাটি পিবিআইতে চলে যায়। ওই হত্যাকাণ্ডে কোন পুলিশ জড়িত কিনা সে ব্যাপারে তিনি এখনো কিছু জানেন না।

ওসি আরও জানান, প্রায় দুই বছর ধরে এসআই মিজানুর রহমান গোদাগাড়ী থানায় কর্মরত আছেন।  আর মাস দুয়েক আগে এসআই মান্নান, এসআই রেজাউল ও কনস্টেবল শাহাদাতকে অন্যত্র বদলি করা হয়। তবে কনস্টেবল শফিকুল এখনও গোদাগাড়ী থানায় আছেন। এসআই রেজাউল ইশ্বরদী থানায় তবে মান্নান ও কনস্টেবল শাহাদাত এখন কোথায় আছেন ওসি তা জানাতে পারেননি।

স/অ