গোদাগাড়ীতে পুকুরলীজের সীমাহীন দুর্নীতি থামছেই না

গোদাগাড়ী প্রতিনিধিঃ
রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী উপজেলা সরকারি খাস পুকুর থেকে রাজস্ব আদায়ের একটি অন্যতম উৎস। শুধু মাত্র এই খাত হতেই সরকারের রাষ্ট্রীয় কোষাগারে কোটি কোটি টাকা জমা হয়। সরকার এই খাত হতে বড় অংকের রাজস্ব পেলেও বছরের পর বছর পুকুর লীজ নিয়ে সীমাহীন দুর্নীতি অপ্রতিরোধ হয়ে পড়েছে। এবারের ১৪২৫ বাংলা সনে পুকুর টেন্ডারের দরপত্র আহবান করা হলে দীর্ঘদিন যাচাই বছাইয়ের পর গত ১৫ মে বুধবার চুড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হয়। এই তালিকা প্রকাশের পরই নজরে আসে পুকুরের সর্বোচ্চ সীমাহীন দূর্নিতীর চিত্র। আর তাতেই ক্ষোভে ফেটে পড়েন পুকুরের লীজে অংশগ্রহণকারিরা।

১০২৫ বাংলা সনের পুকুরলীজের দরপত্র আহবান করে সদ্য বিদায়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ জাহিদ নেওয়াজ। জলমহাল নীতিমালায় সর্বোচ্চ দুটি পুকুর মৎস্যাজীবি অথবা মৎস্যচাষী পাওয়ার কথা বলা থাকলেও গোদাগাড়ী উপজেলায় বেকারদের আয়ের উৎস্য, সরকারি কোষাগারে টাকা জামা এবং উপজেলায় মৎস্যজীবি বা মৎস্যাচাষী সমিতির তুলনায় অধীক পুকুর থাকায় একটি সমিতি হতে ৮ টি পুকুরলীজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। চুড়ান্ত তালিকা প্রকাশের আগেই তৎকালীন দায়িত্বে নিয়োজিত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ জাহিদ নেওয়াজ বদলি হয়ে যায়। নতুন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ শিমুল আকাতার যোগদানের প্রায় দেড়মাস পর সবকিছু যাচাই বাছাই করে পুকুরলীজ কমিটির সদস্য সচিব ও সহকারি কমিশনার (ভূমি) মোঃ সানওয়ার হোসেনের স্বাক্ষরিত চুড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করে গত ১৫ মে।

তালিকা প্রকাশের পর দেখা যায়, একটি সমিতি হতে ৮টির বেশী সিডিউল না কাটা ও পুকুর না পাওয়ার নিয়ম থাকলেও নিয়ম বর্হিরভূত ভাবে কোন কোন সমিতিকে ১৩ টি , ১৫টি, ১৭টি, ১১ টি ,১০ টি পুকুর সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে প্রথম করা হয়েছে। আবার এসব সমিতির গুলোর মধ্যে হতেই দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, ৫ ম দরদাতা হিসেবে তাদের তালিকা প্রকাশ করা হয়।

তালিকা দেখে অসংখ্যা লীজে অংশগ্রহণকারিরা ক্ষোভে ফেটে পড়ে। সেদিন উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নিকট এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করলে গত ১৯ মে রবিবার পূর্বের তালিকার সাথে সমন্বয় করে সংশোধনী তালিকা প্রকাশ করে। এতেও অনিয়মের চিত্র ফুটে উঠে। প্রশ্ন উঠেছে আগের তালিকা কি তাহলে না দেখেই তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে যে আবারও নতুন তালিকা প্রকাশ করা হলো।

দ্বিতীয় তালিকা প্রকাশ করার পর পূর্বের তালিকার সাথে অনেক গড়মিল দেখা যায়। এতেই আরো ক্ষোভ চরমে পৌচেছে। আগের সর্বোচ্চ দরদাতাদের বাদ দিয়ে নতুন করে সর্বোচ্চ দরদাতা প্রকাশ করা হয়। এতে করে পূর্বের গুলো পুরোটায় বাদ পড়ে যায়। আবার কোন কোন সমিতিকে ত্রুটিপূর্ণ সিডিউল বলে বাদ দেওয়া হয়েছে।

ত্রুটিপূর্ণ সিডিউল বলতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ শিমুল আকতার জানান , সিডিউল কাটার সিরিয়াল নং এর সাথে দরপত্র আহবানের সময় সেটি ঠিকা না থাকাকে বোঝানো হয়েছে। তবে প্রশ্ন উঠেছে প্রথম তালিকায় তাহলে কেন ত্রুটিপূর্ণ চিহিৃত করা হলো না ? ।

গুরুতর অভিযোগ উঠেছে গোদাগাড়ী উপজেলাতে দীর্ঘদিন হতে পুকুর লীজে একটি জালিয়াতি সিন্ডিকেট কাজ করে। এরাই উপজেলা নির্বাহী অফিসের কর্মকর্তা কর্মচারীরা তাদের সাথে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে জালিয়াতি করে আসছে। ফলে প্রকৃত মৎস্য চাষীরা পুকুর লীজ না পেয়ে তারাই পেয়ে আসছে।

বসন্ত পুরের মোঃ টিয়া জানান, গত ১৫ মের তালিকায় সমতা মৎস্যচাষী সমবায় সমিতির নামে ১৩টিতেই প্রথম দরদাতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। সেই সমিতি হতে সর্বোচ্চ ২৫টি সিডিউল কেটে টেন্ডারে অংশ গ্রহণ করেছে। বাকি গুলোতে দ্বিতীয়,তৃতীয়, চতুর্থ দরাদাতা হিসেবে সেই সমিতিকেউ দেওয়া হয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সমতা মৎস্যচাষী সমবায় সমিতির মূল হোতা হিসেবে কাজ করছে দীর্ঘদিন হতে পুকুর সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত ও জালিয়াতির অন্যতম গডফাদার সুলতানগঞ্জ এলকার শরিফুল ইসলাম বিষু। তার সাথে উপজেলা নির্বাহী অফিসের সকলের সাথে দহরম মহরম সম্পর্ক আছে। অনেক সময় দেখা যায় অফিস সময়ের পরের গভীর রাত পর্যন্ত উপজেলা নির্বাহী অফিসের কর্মচারীদের সাথে কাজ করছে। তার বিরুদ্ধে এক বিচারকের রায় জালিয়াতি করে রায় নেওয়ারও অভিযোগ আছে। এলাকায় প্রচার আছে যে এই শরিফুল ইসলাম বিষু এভাবে জালিয়াতি করে বেশীর ভাগ পুকুরই তার দখলে আছে। অভিযোগ আছে এই বিষু জামায়াতের সমর্থক হওয়া সত্বেও বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের একাধিক নেতার সাথে সমন্বয় কাজ করে এসব জালিয়াতি করে আসছে । আর তার তাদের দাপটেই সে অবাধ চলাফেরা করছে। তবে গত ৫ দিন হতে পুকুরের তালিকায় ত্রুটি ধরা পড়ায় শরিফুল্ ইসলাম বিষু আর গোদাগাড়ী উপজেলা চত্ত্বরে আসছে না।

শুধু সমতা মৎস্যচাষী সমিতি নয় এমনি ভাবে একাধিক পুকুর পাওয়া ও সিডিউল দিয়ে লীগে অংশ গ্রহণ করেছে জয়রামপুর পশ্চিমপাড়া মৎস্যচাষী সমবায় সমিতি। এই সমিতি থেকে ১১ টি পুকুরের প্রথম স্থান দরদাতা, ৩ টিতে দ্বিতীয় এছাড়াও একটি করে তৃতীয়, চতুর্থ হওয়ার তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। একই ভাবে দ্বিগ্রাম সমন্বিত মৎস্যচাষী সমবায় সমিতি ১০ টি প্রথম দরদাতা হিসেব তালিকায় নাম এসেছে।

মেডিকেল মোড়ের কামরুল জানান, আমি ডাইংপাড়া মৎস্যচাষী সমিতির নামে ৮ টির বেশী সিডিউল কাটিনি তবে কে বা কারা আরো ৭ টি সিডিইল দিয়ে টেন্ডারে অংশ গ্রহণ করেছে এটা আমি তালিকা প্রকাশের পর উপজেলা নির্বাহী অফিস হতে জানতে পেরেছি বলে দাবি করেন।

উপজেলা নির্বাহী অফিস হতে জানাগেছে একটি সমিতি হতে ৮ টির অধিক সিডিউল না কাটতে পারা ও টেন্ডারে অংশ গ্রহণ না করতে পারার নিয়ম থাকলেও এমনি ভাবে ২৫ টি সমিতি ৮ টির অধিক সিডিউল দিয়ে টেন্ডারে অংশ গ্রহণ করেছে। তবে সিডিইল বিক্রয়ের দয়িত্বে নিয়োজিত গোদাগাড়ী ভূমি অফিসের মোঃ শহিদুল ইসলাম জানান আমার কাছ হতে কোন সমিতিকেই ৮টির বেশী সিডিউল দেয়নি।

তবে উপজেলা নির্বাহী অফিসার শিমুল আকাতর বলছেন, এসব কাগজ পত্র ও সই সিগনেচার চুরি করে এমনটি করা হয়েছে।

সোমবার পুকুর টেন্ডারের অংশগ্রহণ কারিরা উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নিকট গিয়ে দাবি তুলেন, আগে হতেই পুকুর টেন্ডারের ব্যাপক অনিয়ম হয়ে আসছে তবে এবার অনিয়ম পূর্বের গুলোকে ছড়িয়ে গেছে। পুকুর জালিয়াতির সাথে উপজেলা নির্বাহী অফিসের একাধিক কর্মচারী ও বাইরের চক্র কাজ করে আসছে তাদের চিহিৃত করে দ্রুত শাস্তির আওতায় আনার জোর দাবি জানানো হয়।

তবে বাইরে সমালোচনার ঝড় বইছে, উপজেলা নির্বাহী অফিসের সামনে বড় করে ব্যানারে ‘‘আমি ও আমার অফিস দুর্নীতি মুক্ত’’ লেখা থাকলেও এই অফিসটিই দুর্নীতির আখড়া বলে মন্তব্য করছেন।

সার্বিক বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ শিমুল আকতার সিল্কসিটি নিউজকে বলেন, আমি এই উপজেলায় নতুন এসেছি সবকিছু বুঝতে চেষ্টা করছি। তবে যেসব নিয়ম হয়েছে তার নিরসনের জন্য চেষ্টা করছি । সব সমস্যার সমাধানের জন্য তিনি সকলের সহযোগিতাও চান।

স/শ