বৃহস্পতিবার , ১৮ জুন ২০২০ | ১৪ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
  1. অন্যান্য
  2. অপরাধ ও দুর্নীতি
  3. অর্থ ও বাণিজ্য
  4. আইন আদালত
  5. আন্তর্জাতিক
  6. কৃষি
  7. খেলা
  8. চাকরীর খবর
  9. ছবিঘর
  10. জাতীয়
  11. তথ্যপ্রযুক্তি
  12. দুর্ঘটনা
  13. ধর্ম
  14. নারী
  15. নির্বাচিত খবর

গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক এবং আমাদের ইউটিউব জেনারেশন

Paris
জুন ১৮, ২০২০ ৯:৫০ পূর্বাহ্ণ

মাহামুদুল হাসান, মো. হাফেজ

জাপানি একটি প্রবাদ আছে, “হাজার দিন গভীর অধ্যয়নের চেয়ে একদিন শিক্ষকের সাহচর্য উত্তম”। বাস্তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শুধু একটা অবকাঠামো ছাড়া কিছুই নয় যদি তাতে শিক্ষক না থাকে। একজন শিক্ষক নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। সভ্যতার শুরু থেকে এই পর্যন্ত চিন্তা চেতনা, দর্শন, উন্নয়ন সবকিছুতে শিক্ষকদের ছোঁয়া বিদ্যমান।

শিক্ষক শুধু জ্ঞান বিতরণ করেন এ কথা বলা ভুল হবে, শিক্ষক গড়ে দিতে পারেন শিক্ষার্থীদের মানসিকতা আর জাগ্রত করে দিতে পারেন বিবেক। গুণী শিক্ষকের দ্বারাই মানবসভ্যতা পেয়েছে জ্ঞানী মানুষ আর কর্মী। আর তাই আমরা দেখতে পাই সক্রেটিসের দর্শনে প্রভাবিত তার ছাত্র প্লেটোকে আবার প্লেটোর দ্বারা প্রভাবিত দার্শনিক এরিস্টেটলকে। এরিস্টটলের ছাত্র ছিলেন দিগ্বিজয়ী বীর আলেকজান্ডার দি গ্রেট।

জগতের বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের প্রায় সবাই কোনো না কোনোভাবে ছিলেন শিক্ষক আর সবাই মর্যাদা দিয়েছেন শিক্ষকদের। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, যারা শিশুদের শিক্ষাদানে ব্রতী তারা অভিভাবকদের থেকেও অধিক সম্মানীয়। পিতা-মাতা আমাদের জীবনদান করেন ঠিকই। শিক্ষকরা সেই জীবনকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে সাহায্য করেন। শিক্ষকতা কেবল চাকরি নয়, এটি একটি মহান পেশা। ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেনিন বলেছেন, “সমাজ পরিবর্তনের পূর্বশর্ত মানুষের পরিবর্তন”। সেই পরিবর্তনের অভিভাবকত্ব শিক্ষকদের পেশাগত দায়িত্ব।

আমাদের দেশের ইতিহাসে শিক্ষকদের আছে এক অসাধারণ অবস্থান। ইতিহাসের প্রতিটি বাঁক পরিবর্তনে শিক্ষকদের ছিল শক্তিশালী ভূমিকা। জ্ঞান বিতরণ, গবেষণা আর ছাত্রছাত্রীদের দেশ ও জাতির প্রয়োজনে তারা দিয়েছেন দিকনির্দেশনা। বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী সত্যেন বোস, ভাষাবিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান থেকে শুরু করে আরও কত শিক্ষকের জ্ঞান চর্চা আমাদের দেশ আর জাতিকে করেছে গর্বিত।

প্রয়াত ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর নামের সাথেও আমরা সম্যক পরিচিত যিনি শিক্ষামূলক কর্মজীবনের পাশাপাশি বাংলাদেশের ভৌত অবকাঠামোর বেশ কয়েকটি প্রকল্পে অবদান রাখেন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে তার অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করে। এ রকম আরও কত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবদান আছে আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক আর জাতীয় উন্নয়নে। তাঁদের চিন্তাধারা আর ব্যক্তিগত দর্শনের সাথে হয়তো অনেকের দ্বিমত থাকতে পারে, কিন্তু তাদের প্রচেষ্টা আর আত্মত্যাগকে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে ছোট করে দেখার কোন অবকাশ নেই।

সৈয়দ মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের দায়িত্ব পালনকালে ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণের মুখে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের রক্ষা করতে গিয়ে শহীদ হন। যে শিক্ষক সেদিন বলেছিলেন, ‘আমি বলছি গুলিবর্ষণ হবে না। আর যদি গুলি করা হয় তবে কোনো ছাত্রের গায়ে লাগার আগে তা আমার গায়ে লাগবে। ১৯৭১ সালে হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসররাও বেছে বেছে হত্যা করে এদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে।

অনেক সময় বলা হতে পারে বর্তমানের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা অতীতের শিক্ষকদের মতো না, আসলে এটা জ্ঞানের স্বল্পতা ছাড়া আর কিছুই না। হাতেগোনা অল্প কয়েকজন শিক্ষকের বিচ্ছিন্ন কিছু কার্যকলাপ আর বক্তব্যকে পুঁজি করে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমাজকে ছোট করার যে অপপ্রয়াস তা আসলেই নিন্দনীয়। অপ্রতুল গবেষণা সহযোগিতা থাকা সত্ত্বেও শুধু ব্যক্তিগত পরিশ্রম আর দায়িত্ববোধকে পুঁজি করে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ভাল মানের গবেষণা করছেন। শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধান করার জন্য আর তাদের ন্যায্য অধিকারের জন্য কাজ করছেন অনেক শিক্ষক। বড় দুঃখের বিষয় ভালো কাজগুলো আমাদের চোখ এড়িয়ে যায় অথবা আমরা তা জানতে আগ্রহী না। আমরা খারাপটাকে প্রচার আর প্রসারে অনেক আগ্রহের সাথে মনোনিবেশ করি।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের নিয়ে অতি সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি স্বনামধন্য প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দুটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। উক্ত ভিডিওতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যে ইমেজ তুলে ধরা হয়েছে তা সত্যি অনেক দুঃখজনক। পুরো ভিডিও বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় তাতে অনেক ‘ভালগার কন্টেন্ট’ প্রমোট করা হয়েছে। একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক অনলাইন এক্সাম নেয়ার জন্য চেষ্টা করছেন আর তার ছাত্রছাত্রীরা তাকে নিয়ে রসিকতা করছেন। শুধু শিক্ষককে না বরং এই ভিডিওতে ছোট করা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীদের।

ভিডিওতে দেখানো হয়, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ছাত্রীদের এক্সাম না নিয়েও মার্কস দিয়ে দেবেন। এছাড়া ছাত্রীরাও তার কাছ থেকে সুবিধা পাওয়ার জন্য বিভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছেন। একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ‘অ্যাডাল্ট কন্টেন্ট’ দেখেন এবং তা আবার ছাত্রছাত্রীদের কাছে বলেন। শিক্ষকের স্ত্রীকে উপস্থাপন করা হয়েছে অনেকটা ‘গেয়ো’ এবং ‘অশিক্ষিত’ মহিলা হিসেবে। সত্যি বড় দুঃখজনক। প্রায় তিন মিলিয়নের ও বেশি ভিউ হয়েছে এই ভিডিওটি। ‘NSUers are Awesome’ নামের একটি ইউটিউব চ্যানেল থেকে ভিডিওটি তৈরি এবং ভাইরাল করা হয়েছে।

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব রোধে গত ১৮ মার্চ থেকেই সারাদেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শিক্ষার্থীরা যাতে কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এবং তাদের শিক্ষা জীবন যেনো ব্যাহত না হয় সে জন্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মকে কাজে লাগানোর উদ্যোগ নেয়া হয়। ছুটি আরও বেশি দীর্ঘায়িত হলে প্রয়োজনে পরীক্ষা ও ভাইভাও অনলাইনের মাধ্যমে গ্রহণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নির্দেশনা দিয়েছে ইউজিসি।

করোনাকালীন এই সময়ে যখন দেশের শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা খুব চিন্তাভাবনা করছেন অনলাইন এডুকেশন নিয়ে তখন এ ধরনের ভিডিও বানানোর মানে কী? এ ধরনের ভিডিও ছাত্রছাত্রীদেরকে ডিজিটাল এডুকেশন নিয়ে চরম মাত্রায় ‘Demotivate’ করবে অথচ ডিজিটাল এডুকেশন এখন বিশ্বব্যাপী শিক্ষার একটি স্বীকৃত মাধ্যম। খুবই নোংরা এবং অপ্রাসঙ্গিকভাবে ভিডিওতে দেখানো হয়েছে শিক্ষক ছাত্রদের কাছ থেকে ‘তেলের’ বিনিময়ে অবৈধ সুবিধা দিয়ে থাকেন। এছাড়া উক্ত ভিডিও আমাদের সমাজের তথাকথিত ‘BF GF’ এর বিষয়টিকে প্রমোট করেছে। একটি ভিডিওতে এ সময়কার একজন জনপ্রিয় (!) অভিনেতাকে নিয়ে এসেছে যার অনেক নাটক আমাদের যুব সমাজের সামাজিক আর নৈতিক মূল্যবোধের জন্য অনেক ক্ষতিকর।

যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নামে উক্ত ইউটিউব চ্যানেলটি সেই বিশ্ববিদ্যালয় তো বেশ সতর্কতার সাথে যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দেন বলে আমরা জানতাম (বিদেশি ডিগ্রি ছাড়া নিয়োগ হয় না)। দুঃখজনক যে, উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও এই ‘অশ্লীল’ ক্যাটাগরির ভিডিওর ব্যাপারে কেন কিছু বলছেন না?

আমাদের ইউটিউব জেনারেশন শুধু মজা আর সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য অনেক ভিডিও বানান যার লাখ লাখ ভিউ হয়, তার মানে অনেক ভালো ব্যবসা হয়। তবে এখানে মনে রাখা লাগবে “Everything is not a fun’. যেই মজা সমাজ আর পরিবেশের জন্য সার্বিকভাবে ক্ষতিকর তা মজা নয়, তা একপ্রকার অপরাধ। হয়তো বলা হতে পারে আপনার ইচ্ছে হলে দেখবেন না হলে দেখবেন না, কিন্তু এ জাতীয় কথা এখানে একেবারেই অযৌক্তিক যার কারণ সামাজিক পরিবেশের জন্য খারাপ কোনো কিছু দেখলে কথা বলতেই হবে। সমাজের অংশীদার আমরাও।

ভিডিওতে একটা অ্যাপসের কথা বলা হয়েছে যেই অ্যাপসে করোনাকালীন অনেক প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া যেতে পারে। যদি পুরো ভিডিও এ রকম ভালো কোনো বিষয় নিয়ে বানানো হতো তাহলে হয়তো এত ভিউ আর ব্যবসা হতো না, কিন্তু মানুষের জন্য উপকারী হতো। প্রত্যাশা থাকবে আমাদের ছাত্রছাত্রীদের যারা ইউটিউবার তারা সমাজের জন্য পজিটিভ এবং প্রয়োজনীয় ভিডিও বানাবেন যা কাউকে ছোট করবে না বা মানসিকতার ক্ষতি করবে না বরং সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে সাহায্য করবে।

লেখকদ্বয় : সহকারী অধ্যাপক, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং আহছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। hasanmktpstu@gmail.com, hafez_du94@hotmail.com

 

সুত্রঃ জাগো নিউজ

সর্বশেষ - মতামত