গাছ লাগাতে লাগাতে আমি ‘বৃক্ষপ্রেমিক কার্তিক পরামানিক’

কামাল হোসেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ:
পশু-পাখি পাবে আশ্রয়স্থল আর মানুষ পাবে হিমশীতল পরিবেশ এই আশা নিয়ে আমি মাত্র ১০ বছর বয়স থেকেই গাছ লাগানো শুরু করি। আজ ৭৫ বছর বয়সে এসেও গাছ লাগিয়ে যাচ্ছি এবং যতদিন বাঁচব গাছ লাগিয়েই যাব।
এখন পর্যন্ত লক্ষাধিক গাছ লাগানো হয়েছে এবং ভবিষ্যৎপ্রজন্মও যেন গাছ লাগিয়ে যেতে পারে এ জন্য গড়ে তুলেছি নিজস্ব নার্সারি। যারা গাছ লাগাতে চায় সেখান থেকে বিনামূল্যে দিয়ে থাকি গাছের চারা। এটাই আমার শান্তি যে এখন সবুজ পরিবেশ গড়ে উঠছে। বট-পাকুড়, আম, জাম, কাঁঠাল, মেহগনি, শিশু, হরীতকী-বহেড়া গাছ লাগাতে লাগাতে কখন যে বৃক্ষপ্রেমিক হয়ে গেছি তা ভাবলে মনে পড়ে যায় সেদিনগুলোর কথা।
পৈতৃক নিবাস ছিল তত্কালীন ভারতের মালদহ জেলার নবাবগঞ্জ মহকুমার (বর্তমান বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা) শিবগঞ্জ থানার রাধাকান্তপুর গ্রামে। সে সময় আত্মীয়স্বজন ভারত পাড়ি জমালে মাত্র ১০ বছর বয়সে আমার পিতা সুরেন চন্দ্র পরামানিক রাধাকান্তপুর ছেড়ে মানকষা ইউনিয়নের সাহাপাড়া তারাপুর গ্রামে আমাদের নিয়ে চলে আসেন। কিন্তু গ্রামের চারদিকে শুধু বালুচর, কোথাও নেই গাছপালা, চারদিক যেন রৌদ্র খাঁ-খাঁ পরিবেশ। নতুন জায়গায় এসে কিছুই ভালো লাগে না।
সেই ছোট্ট বয়সে বাজার-হাট করতে ১০ থেকে ১২ মাইল রাস্তা পায়ে হেঁটে মনাকষা আসতে হয়। স্যান্ডেলের অভাবে খালি পা আর মাথায় ছাতা ছাড়া ওই পথ পাড়ি দেওয়া যে কত কষ্টকর তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। ধু-ধু বালুচর হেঁটে বাজার করতে আসার ফলে পায়ে ফোসকা পড়ার মতো হলে মাথার গামছা পায়ে দিয়ে একটু আরাম পাওয়ার চেষ্টা করতাম। আর বাবাকে কেঁদে কেঁদে বলতাম এই কষ্টের কথা। তখন বাবা সান্ত্বনা দিয়ে বলতেন দেখিস একদিন কেউ এই এলাকায় ঠিক গাছ-পালা লাগাবে আর এখানে ফিরে আসবে হিমশীতল পরিবেশ। একদিন এই এলাকা গাছ-পালায় ভরে যাবেই। বাবার ওই কথায়ই আমার জীবন পাল্টে যায়। আমি ভাবি গয়া-কাশি গিয়ে যে পুণ্য অর্জন করা যায়। আমি গাছ লাগিয়েই সেই পুণ্য অর্জন করব। ব্যস যেই ভাবা সেই কাজ। একদিন মা আমাকে নিয়ে কাকার বাড়িতে বেড়াতে নিয়ে যান। সেখানে দেখি এক পাকুড় গাছের তলায় বীজ পড়ে গাছ গজিয়েছে। আমি সেই চারা নিয়ে আসি এবং শ্যামপুর গ্রামের তিন মাথার রাস্তার মোড়ে তা লাগাই। সেই ১০ বছর বয়স থেকেই আমার গাছ লাগানো শুরু। আর আমার প্রথম লাগানো গাছটিই এখন এলাকার একটি বড় পাকুড় গাছ। অনেক কষ্ট করে গাছটিকে বাঁচিয়ে রেখেছি। যার বয়স এখন প্রায় ৬৫ বছর। ওই গাছ লাগানোর পর শুরু হয় জীবন যুদ্ধ।
একদিকে নরসুন্দরের পেশা অন্যদিকে কাজের ফাঁকে রাস্তার দুই ধারে, খোলা জায়গায়, বিভিন্ন বাড়িতে, বিডিআর (বর্তমান বিজিবি) ফাঁড়িতে গাছ লাগানো আমার নেশায় পরিণত হয়। সেসময় অনেকেই আমাকে পাগল বলেছে, আবার অনেকেই বলেছে গরিবের ঘোড়া রোগ ধরেছে। আবার অনেকেই আমার লাগানো ছোট গাছগুলো কেটে ফেলেছে। কিন্তু আমি দমে যায়নি। সেই কেটে ফেলা গাছের স্থলে আবারও লাগিয়েছি নতুন গাছ। সামান্য রোজগারের অর্থ বাঁচিয়ে কিনেছি বাঁশ ও দড়ি। সেগুলো দিয়ে করেছি গাছের পরিচর্যা। মানুষের সব তাচ্ছিল্য তুচ্ছ মনে করে আমি আমার লক্ষ্যে অবিচল থেকে গাছ লাগিয়েই চলেছি। এলাকার ১০ কিলোমিটার জায়গা আজ গাছে গাছে ছেয়ে গেছে। বেড়েছে পাখ-পাখালির আনাগোনা। এলাকার হিমশীতল পরিবেশ এখন সবাই ভোগ করছে, এটা ভেবেও আমি শান্তি পাচ্ছি।
আর গাছ লাগানোর স্বীকৃতির কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় ২০০৩ সালের কথা। ওই বছরের ৪ কি ৫ ডিসেম্বর তত্কালীন বিডিআরের ৬ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল শহীদ উদ্দিন খান পিএসসি আমার গাছ লাগানোর ইতিহাস শুনে তিনি আমাকে মনাকষা বিওপিতে ডেকে পুরস্কার প্রদান করেন। সেই খবর পেপার-পত্রিকায় প্রকাশ পাওয়ার পর আমার কথা দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ে। আর আমাকে নিয়ে মাতামাতি শুরু হয়। তার পর থেকেই আমি হয়ে গেছি ‘বৃক্ষপ্রেমিক কার্তিক পরামানিক’।
বর্তমানে আমি অনেক পুরস্কার লাভ করেছি। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, প্রথম আলো বন্ধুসভা পুরস্কার (২০০৩), রাজশাহী সিটি করপোরেশন পুরস্কার (২০০৩), বনবিভাগ ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের বৃক্ষমেলা পদক (২০০৭), বৃক্ষরোপণে প্রধান উপদেষ্টার জাতীয় পুরস্কার (২০০৬), গণস্বাস্থ্য পদক (২০০৭), চার্চ অব বাংলাদেশ সোসাল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম রজতজয়ন্তী পুরস্কার (২০০৭), চ্যানেল আই কৃষি পদক (২০০৭), চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শিক্ষক সমিতির পুরস্কার (২০১২), মার্কেন্টাইল ব্যাংক সম্মাননা পদক (২০১৩) এবং স্টান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংক পদক (২০১৪)।
এ ছাড়া ২০১২ সালে অষ্টম শ্রেণির ইংরেজি বইয়ে আমাকে পাঠ্য তালিকায় নিয়ে আসা হয়েছে। এটিও আমার কাছে বড় পাওয়া।
আজ একটি কথা মনে পড়ছে, তা হলো ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আনোয়ারুল ইকবাল আমার চাওয়া পাওয়া কি জানতে চাইলে, আমি বলি ব্যক্তিগতভাবে আমার চাওয়ার কিছু নেই। তবে এলাকার মানুষের বড় অভাব হচ্ছে রাস্তার। সেসময় তিনি আমাকে ৮ কি. মিটার রাস্তা ও দুটি সাঁকো নির্মাণের আশ্বাস দেন। ওই সময় আমার চোখে জল চলে আসে। পরবর্তীতে এলাকাবাসী রাস্তা ও সাঁকো পেয়েছে। আজ আর পায়ে হেঁটে মনাকষা বা শিবগঞ্জ আসতে হয় না। আমি গাছ লাগানোর পর ফল পাব আমার মৃত্যুর পর এবং গাছে আশ্রয় পেয়ে পশুপাখি আমার জন্য দোয়া করবে এটি মনে মনে ভাবতাম। কিন্তু আমি বেঁচে থাকতেই এর ফল ভোগ করছি। চারদিকে মানুষ এখন আমার সুনাম করেন, এটাই আমার বড় পাওয়া বলে আমি মনে করি।
তবে বাকি জীবনে যতদিন বাঁচব ততদিন গাছ লাগিয়েই যাব এই দৃঢ়তা নিয়ে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় অন্যের এক বিঘা জমি লিজ নিয়ে আমি গড়ে তুলেছি একটি নার্সারি। সেখানে ফলদ, বনজ ও ঔষধি গাছের চারা রয়েছে। সেই চারাগুলো থেকে আমি জেলার বাবুডাইংসহ বিভিন্ন স্থানে লাগিয়েছি। আর যদি কারও ইচ্ছা থাকলেও অর্থভাবে গাছ না লাগাতে পারে তবে তাদেরকেও আমার নার্সারি থেকে গাছের চারা বিনামূল্যে দিয়ে থাকি।
পরিশেষে বলতে হয়, ব্যক্তিগত জীবনে আমি চার ছেলে ও তিন মেয়ের জনক। এদের মধ্যে তিন মেয়ে ও দুই ছেলের বিয়ে দিয়েছি। বাকি দুই ছেলে লেখাপড়া করছে।
স/অ