গলার কাঁটা অটোরিকশা নিয়ে বিপাকে রাসিক

নিজস্ব প্রতিবেদক
রাজশাহী নগরীতে ব্যাটারি চালিত অটোরিকশার পরিমাণ এখন প্রায় ৮০ হাজার। ছোট্ট এই শহরটি অটোরিকশার চাপে যেন ধুঁকছে। ভোরের আলো পূর্বদিগন্তে ফোটার সঙ্গে সঙ্গে রাজশাহী নগরীর প্রধান-প্রধান সড়কগুলো থেকে শুরু করে অলি-গলির রাস্তাগুলোও চয়ে যাচ্ছে অটোরিকশার দখলে। পরিস্থিতি এমন-যেন যাত্রীর চেয়ে অটোরিকশার সংখ্যা বেশি।

নগরীর সাহেব বাজার, লক্ষীপুর, রেলগেট, বন্ধগেট, কাদিরগঞ্জ মোড়, বর্ণালীর মোড়, লোকনাথ স্কুল মার্কেট মোড়, রাজশাহী কলেজ গেট, সোনাদিঘীর মোড়, আলুপট্টির মোড়, কাজলা মোড়, বিনোদপুর বাজার, সালাবাগান বাজার, নওদাপাড়া বাজার ও কোর্ট বাজারগুলোতে যেন অটোরিকশার জট লেগেই থাকে। বিপুল পরিমাণ এই অটোরিকশার জট থামাতে হিমশিম খাচ্ছেন ট্রাফিক পুলিশরাও। আর নিয়ন্ত্রণহীন অটোরিকশার কারণে হরহামেশায় ঘটছে দুর্ঘটনা।

এমনকি প্রাণ হারাতেও হচ্ছে।
এদিকে অটোরিকশার নিয়ন্ত্রণে রাজশাহী সিটি করপোরেশন দুই রংয়ের অটোরিকশা দিনে দুইবার করে চালুর উদ্যোগ নিলেও সেটি এখনো বাস্তবায়ন করতে পারেনি। বার বার সময় বেধে দেওয়া হলেও অটোরিকশার লাগাম টানতে ব্যর্থ হচ্ছে রাসিক। অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণে গত জুলাই পর্যন্ত সময় বেধে দেওয়া হলেও এখনো সেটি কার্যকর হয়নি। আবার চালক ও অটোরিকশার নিবন্ধনের জন্য রাসিকের অনলাইনে আবেদন করতে বলা হলেও এখন পর্যন্ত মাত্র ২ হাজার ৯০০ আবেদন জমা পড়েছে। ফলে রাসিকের উদ্যোগও ভেস্তে যেতে বসেছে চালকদের অসহযোগিতার কারণে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ব্যাটারি চালিত তিন শ্রেণির অটোরিকশা চলে রাজশাহীতে। এর মধ্যে ৮ জন যাত্রীবাহী অটোরিকশা রয়েছে প্রায় ৩৫ হাজার এবং তিনজন ও দুইজন যাত্রীবাহী ছোট অটোরিকশা রয়েছে আরো প্রায় ৪৫ হাজার। সবমিলিয়ে অন্তত ৮০ হাজার অটোরিকশা চলাচল করছে ছোট্ট এই নগরীতে। তবে এগুলোর মধ্যে মাত্র ১৪ হাজার ২৬২টি অটোরিকশার নিবন্ধন দেয়া হয়েছিল ২০১১-১৩ সালের মধ্যে। এর পর আর অটোরিকশার নিবন্ধন দেওয়া না হলেও সবগুলো অটোরিকশাতেও সিটি করপোরেশনের নিবন্ধন নম্বর দেখা যায়। যদিও এরই মধ্যে সিটি করপোরেশন অটোরিকশার নীতিমালা তৈরী করে পূর্বের সব নিবন্ধন বাতিল করে নতুন করে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করতে বলে।

সূত্র মতে, অটোরিকশা চালকদের অসহযোগিতার কারণেই দুই শিফটে দুই রংয়ের অটোরিকশা চলাচলের ব্যবস্থা এখনো করতে পারেনি রাসিক। অথচ নগরীতে এখনো প্রতিদিন প্রধান প্রধান সড়ক দখলে থাকছে অটোরিকশার। পূর্বের সব নিবন্ধন বাতিল করা হলেও সেই অটোরিকশাগুলোই আগের ভুয়া নিবন্ধন নিয়ে চলছে নগরীর রাস্তাগুলোতে। কারণ যে সময়ে অটোরিকশার নিবন্ধন দেওয়া হয়েছিল সেই অটোরিকশাগুলো এরই মধ্যে অন্তত নব্বই শতাংশ পুরনো হয়ে অকেজো হয়ে পড়েছে। কিন্তু মাত্র হাতে গোনা সেই নিবন্ধনগুলো নিয়েই এখন নগরীতে চষে বেড়াচ্ছে প্রায় ৮০ হাজার অটোরিকশা।

অভিযোগ রয়েছে, সিটি করপোরেশনেরই একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তারা পুরনো লাইসেন্সের নম্বর বিক্রি করেছেন অবৈধভাবে। ফলে একই নম্বর একাধিক অটোরিকশার নেম্বর প্লেটে দেখা যায় একটু খেয়াল করলেই। যার কারণে দিনের পর দিন নিবন্ধন না নিয়েই অবৈধ অটোরিকশার সংখ্যা বেড়ে রাসিকের গলার কাঁটাই পরিণত হয়েছে এখন সেগুলো।

গতকাল রাজশাহী নগরীর ব্যস্ততম এলাকার সাহেব বাজারে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, আশে-পাশের চারিদিকে অটোরিকশা আর অটোরিকশা। যেন ধাপ ফেলানোরও জায়গা নেই কোথাও। অটোরিকশার ভিড়ে মানুষগুলোকেও চোখে দেখা যায় না। সাহেব বাজারের অটোরিকশার যানজট নিরসনে ট্রাফিক পুলিশের পাশাপাশি নামানো হয়েছে কমিউনিটি ট্রাফিক সদস্যদেরও। কিন্তু কে শোনে কার কথা। এতো অটোরিকশার ভিড়ে কেউ কাউকে সামাল দিতে পারছেন না। এভাবে গোটা শহরে যেন নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে অটোরিকশার দাপটে। বলা যায় অটোর ফাঁদে পড়ে নাভিশ্বাস উঠে নাকাল হয়ে পড়েছেন নগরবাসী।

নগরীর সাহেববাজার এলাকার হোটেল ব্যবসায়ী আকবর আলী মোল্লা বলেন, সেই ভোর থেকেই শুরু হয় অটোরিকশার দাপট। চলে গভীর রাত পর্যন্ত। অটোরিকশার চাপে যেমন হিমশিম খেতে হচ্ছে ট্রাফিক পুলিশকে, তেমনি দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে সাধারণ পথচারীসহ স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গামী শিক্ষার্থীদেরকেউ। আবার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও ক্রেতারা আসতে বেগ পাচ্ছেন অটোরিকশার ভিড়ে।

রাজশাহী মহানগর পুলিশের মূখপাত্র গোলাম রুহুল কুদ্দুস বলেন, অটোরিকশা চালকরা অনেকটাই বেপরোয়া। এদের নিয়ন্ত্রণ করাই কঠিন। ফলে দুর্ঘটনাও ঘটে প্রচুর। আবার যানজট তো লেগেই থাকছে এই অটোরিকশার কারণে।

এদিকে অটোরিকশা ও ইজিবাইকের দাপটের কারণে এভাবে প্রতিদিনই শিক্ষা নগরীর রাজশাহীর হাজার হাজার শিক্ষার্থীসহ পথচারীদের ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। এসব অবৈধ অটোরিকশার ফলে নগরীতে দুর্ঘটনার হারও বেড়েছে আগের চেয়ে কয়েকগুন। এমটিই জানিয়েছেন রাজশাহীর ট্রাফিক পুলিশের কর্মরত একাধিক সদস্য।

জানতে চাইলে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের রাজস্ব কর্মকর্তা আবু সালেহ বলেন, ব্যাটারিচালিত রিকশা যানবাহন হিসেবে ঝুঁকিপূর্ণ। সিটি করপোরেশেনের পক্ষ থেকে এগুলো বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও পরবর্তিতে সেই সিদ্ধান্ত এখন একটু সিথিল করা হয়েছে। তবে দ্রুতই দুই শিফটে দুই রংয়ের অটোরিকশা চলাচলে আমরা কঠোর অবস্থানে যাবো।’

ওই কর্মকর্তা আরো জানান, গত ১ জুলাই থেকে নগরীতে দুই শিফটে কলাপাতা ও পিত্তি রংয়ের অটোরিকশা চালু করার কথা ছিল। ওইদিন মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন ঘটা করে দুই শিফটের অটোরিকশা উদ্বোধনও করেছিলেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত মাত্র দুই হাজার ৯০০ টি আবেদন জমা পড়েছে নিবন্ধনের জন্য। এর মধ্যে চালক ও অটোরিকশার জন্য দুটি আলাদা ক্যাটাগরি রয়েছে। দুই ক্যাটাগরি মিলে এই আবেদন জমা পড়েছে।

জানতে চাইলে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, ‘দ্রুতই নগরীর অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণে দুই শিফটে (সকাল-দুপুর) অটোরিকশা চালু কার্যক্রর করা হবে। এর জন্য সকল প্রক্রিয়া চলছে। চালক ও অটোরিকশার নিবন্ধনও এগিয়ে চলছে। যারা এর আওতায় আসবে না প্রয়োজনে তাদের সেসব অটোরিকশা চলতে দেওয়া হবে না।

 

স/আর