কোম্পানীগঞ্জে আ. লীগে বিরোধ সংঘর্ষ প্রাণহানি: বিব্রত ও ক্ষুব্ধ কেন্দ্র

নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বসুরহাট পৌরসভার নির্বাচনের সময় বিভিন্ন বিস্ফোরক বক্তব্য দিয়ে আলোচনায় আসেন আবদুল কাদের মির্জা। তখন থেকেই স্থানীয় আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা চলছিল, যা সম্প্রতি মোড় নিয়েছে সংঘাতের দিকে।

মঙ্গলবার সন্ধ্যায় পৌর এলাকায় দুই পক্ষের সংঘর্ষে একজন নিহত হন। এর ১৫ দিন আগেই দুই পক্ষের আরেকটি সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ যায় এক সাংবাদিকের। প্রকাশ্যে দলের প্রভাবশালী দুই পক্ষের এমন সংঘর্ষ, প্রাণহানি, বাকযুদ্ধে বিব্রত ও ক্ষুব্ধ কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। ক্ষমতাসীন দলের দুই পক্ষের লাগামহীন এমন বিবাদে ক্ষুব্ধ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও।

মঙ্গলবারের সংঘর্ষের জের ধরে গতকাল বুধবার সকাল ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত বসুরহাট পৌর এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে প্রশাসন। দিনভর পৌর এলাকা ছিল থমথমে। বেশির ভাগ দোকানপাট বন্ধ, রাস্তায় যানবাহনও তেমন দেখা যায়নি। শহরজুড়ে ছিল পুলিশ ও র‌্যাবের টহল। মঙ্গলবার রাত থেকে গতকাল বিকেল পর্যন্ত ২৮ জনকে আটক করে পুলিশ। ওই দিন সন্ধ্যায় পৌর এলাকার রূপালী চত্বরে প্রতিবাদ সমাবেশ চলাকালে পৌর মেয়র আবদুল কাদের মির্জা ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বাদলের অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষে একজন নিহত হওয়া ছাড়াও অন্তত ১০ জন গুলিবিদ্ধ ও ৩০ জন আহত হন।

আওয়ামী লীগের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা জানান, নোয়াখালী অঞ্চলে দলের নেতাদের গৃহবিবাদে বিব্রত কেন্দ্রীয় নেতারা। সেখানে এক পক্ষের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই আবদুল কাদের মির্জা এবং অন্য পক্ষে রয়েছেন প্রভাবশালী দুজন সংসদ সদস্য। এই কারণে কেন্দ্রীয় নেতারা কাউকেই জোর দিয়ে কিছু বলতে পারছেন না। কেউ কিছু বলতে গেলেই বিবদমান নেতারা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের ‘রেফারেন্স’ দেন। ফলে শিগগিরই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে দলের আনুষ্ঠানিক একটি বৈঠক প্রয়োজন বলে মনে করেন কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকে। দোষীদের বিরুদ্ধে শিগগিরই কঠোর সাংগঠনিক ও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে বলে আভাস দিয়েছেন একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা।

কোম্পানীগঞ্জের ঘটনায় যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেছেন, এ ঘটনায় কাউকে ছাড় দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। গতকাল বিকেলে ঢাকায় নিজ বাসভবনে নিয়মিত ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, ‘কোম্পানীগঞ্জে বিশৃঙ্খলার সাথে যারাই জড়িত থাকুক, তাদের পরিচয় না দেখে আইনের আওতায় আনা হবে। প্রাণঘাতী সংঘর্ষে একজন দলীয় কর্মী নিহতের ঘটনাটি অত্যন্ত দুঃখজনক। এ ঘটনা অত্যন্ত নিন্দনীয় এবং সাংগঠনিক শৃঙ্খলা পরিপন্থী। ইতিমধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ আইজিপি, চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি ও জেলা পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে কথা হয়েছে। আইন সমানভাবে প্রযোজ্য। ইতিমধ্যে ঘটনার সঙ্গে জড়িত অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, অভিযান চলছে।’

ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘শেখ হাসিনা সরকারের উন্নয়ন ও অর্জনকে কারো অপকর্মের জন্য ম্লান হতে দিতে পারি না। এই দুঃখজনক ঘটনার বিচারকাজ তদন্ত করে রিপোর্ট গঠনের জন্য নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, রিপোর্ট এলে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। বেশ কিছুদিন থেকে কোম্পানীগঞ্জের বসুরহাট এলাকায় জনজীবনে অস্থিরতা বিরাজ করছিল। সরকার এখন কঠোরভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ শুরু করছে। তাই আশা করা হচ্ছে, শিগগিরই জনজীবনে স্বস্তি ফিরে আসবে।’

ওবায়দুল কাদের কোম্পানীগঞ্জের জনগণকে পরিস্থিতি মোকাবেলায় ধৈর্যধারণ এবং সরকারকে সহযোগিতা করার আহ্বান জানান। তিনি মঙ্গলবার নিহত আলাউদ্দিন ও এর আগে সাংবাদিক মোজাক্কিরের মৃত্যুতে গভীর শোক এবং তাঁদের পরিবার-পরিজনের প্রতি সমবেদনা জানান।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ বলেন, ‘নোয়াখালীর বিষয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা। কিন্তু সেই সভা তো হচ্ছে না। বাস্তবতা হলো, আমরা পত্রিকা পড়ে নোয়াখালীর খবর জানছি। এ নিয়ে আমাদের মধ্যে এখনো কোনো আলোচনা হয়নি।’

দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘এলাকাটি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নির্বাচনী আসনের মধ্যে। ফলে বিষয়টি আমাদের জন্য স্পর্শকাতর। মির্জা কাদের দলের সাধারণ সম্পাদকের ভাই হওয়ার কারণে মিডিয়ার ফোকাস পাচ্ছেন। সেই সুযোগেই তিনি দলের শৃঙ্খলার বাইরে গিয়ে অনেক কথা বলছেন। আমি মনে করি, বিষয়টি আরো আগে থেকেই শক্ত হাতে দেখা উচিত ছিল। দোষী যে-ই হোক তার বিরুদ্ধে আইনগত ও সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’

সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য আব্দুর রহমান বলেন, ‘নোয়াখালীর সাম্প্রতিক বিষয়গুলো আমাদের নজরদারির মধ্যে আছে। তবে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলে আমরা অচিরেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব।’

দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘এটার অবসান অবশ্যই হতে হবে। এর অন্যথা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সেখানে জীবনহানি ঘটছে, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। যারাই এর সঙ্গে যুক্ত, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া সাংগঠনিকভাবেও দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে আওয়ামী লীগ। এ ধরনের বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলো জাতীয় রাজনীতিতে তেমন প্রভাব না ফেললেও দলের ভাবমূর্তি ও শৃঙ্খলার জন্য ক্ষতিকর।’

জানা গেছে, কোম্পানীগঞ্জের সংসদ সদস্য ওবায়দুল কাদের দলের সাধারণ সম্পাদক হওয়ায় জাতীয় রাজনীতি নিয়ে তাঁকে ব্যস্ত থাকতে হয়। এত দিন তাঁর পক্ষে ছোট ভাই কাদের মির্জা স্থানীয় রাজনীতি দেখভাল করতেন। কিন্তু কিছুদিন ধরে কাদের মির্জা প্রকাশ্যে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের বিরুদ্ধে বিতর্কিত নানা মন্তব্য করছেন। এমনকি বড় ভাই ওবায়দুল কাদেরের বিরুদ্ধেও কটূক্তি করছেন। বিষয়টিকে অনেক নেতাকর্মীই ভালোভাবে দেখছেন না। ফলে অনেক নেতাকর্মীই তাঁর সঙ্গ ত্যাগ করছেন, তিনি একা হয়ে পড়ছেন।

কিছুদিন আগে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাচনে মনোনয়নবঞ্চিত উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান বাদল, তাঁর তিন ভাগিনা ফখরুল ইসলাম রাহাত, সাবেক ছাত্রনেতা মামুনুর রশিদ মঞ্জু ও সাবেকুন রিমন কাদের মির্জার প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা খিজির হায়াত খান, সাধারণ সম্পাদক নুর নবী চৌধুরী, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আজম পাশা চৌধুরীসহ অনেক নেতাই এখন কাদের মির্জার বিরুদ্ধে। কাদের মির্জার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের একটি অংশকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন মিজানুর রহমান বাদল। বাদলের পক্ষে আছেন নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরী এবং ফেনীর সংসদ সদস্য নিজাম হাজারী। প্রায় দুই মাস ধরে দুই পক্ষের প্রকাশ্য বিবাদ চলছে।

নোয়াখালী ও কোম্পানীগঞ্জ আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীর মতে, অভ্যন্তরীণ কোন্দলে প্রাণহানি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। টানা দুই মাস ধরে এই বিবাদ চলে এলেও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় পর্যায় কোনো পক্ষকেই থামাতে পারেনি। এটি কাম্য নয়। স্থানীয় নেতাদের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের দ্বন্দ্বে সাধারণ নেতাকর্মী ও মানুষ প্রাণ হারাবে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তা সমর্থনযোগ্য নয়।

জানতে চাইলে বসুরহাট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি নুর হোসেন ফরহাদ বলেন, ‘গত এক বছর আমরা কভিডের জন্য ব্যবসা করতে পারিনি। এখন যে অবস্থা চলছে, এতে সবাই আতঙ্কিত। বর্তমান অবস্থায় মন্ত্রী মহোদয়ের হস্তক্ষেপ একান্ত প্রয়োজন।’

নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যক্ষ খায়রুল আনম সেলিম বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে। সেখানে আমি নিজে গিয়েছি। শুধু মন্ত্রী মহোদয় নয়, আমি নেত্রীকে (শেখ হাসিনা) এ বিষয়ে অবহিত করেছি। ইনশাআল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে।’

কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি মীর জাহিদুল হক রনি বলেন, মঙ্গলবারের সংঘর্ষ, গোলাগুলি, পুলিশের কাজে বাধা ও হামলার ঘটনায় এসআই জাকির হোসেন বাদী হয়ে ৮২ জন নামীয় এবং অজ্ঞাতনামা দুই-তিন শ লোকের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেছেন।

 

সুত্রঃ কালের কণ্ঠ