করোনা টিকা নিয়ে আমাদের দ্বিমুখী আচরণ কেন?

শরীর খারাপ দোয়া চাই, পেট খারাপ ওষুধ চাই, পকেট খালি টাকা চাই, পেটে খিদে খাবার চাই, বিপদে পড়েছি সাহায্য চাই, বাঁক স্বাধীনতার উপর হামলা চলছে বিচার চাই। শুধু চাই আর চাই কিন্তু দেবার বেলাই এটা নাই, ওটা নাই, সেটা নাই, শুধু নাই আর নাই। মোড়াল বা এথিক্স বলে যে কথা রয়েছে তা বাংলাদেশের জন্যও প্রযোজ্য অথচ এ ধরণের নৈতিকতার চর্চা আমাদের সমাজ থেকে বিলীন হতে চলেছে চিরতরে। আমি একটি সদ্য ঘটে যাওয়া ঘটনা প্রবাহ তুলে ধরি তাহলে বুঝতে সুবিধা হবে কেন হঠাৎ নৈতিকতা নিয়ে লিখা।

করোনা ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু হয়েছে গোটা বিশ্বে। আমাদের সুইডেনে তুলনামূলকভাবে বেশি লোক মারা যাওয়া সত্বেও যে পরিমাণ ভ্যাকসিনের প্রয়োজন তার চেয়ে বহুগুণ কম ভ্যাকসিন এসেছে। সুইডেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত থাকায় চুক্তি রয়েছে কোন দেশ কী পরিমাণ ভ্যাকসিন কখন কীভাবে পাবে। যদিও আস্ট্রাজেনিকা সুইডিশ ফারমাসিউটিক্যালস কোম্পানি ইচ্ছা করলে জনগণের জন্য প্রথমেই সুইডেন ভ্যাকসিনের নিশ্চয়তা দিতে পারত। কিন্তু না; সুইডেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে এ পর্যন্ত যা পেয়েছে সেটাই তারা ব্যাবহার করছে। যারা বেশি ক্রিটিক্যাল গ্রুপের মধ্যে পড়েছে তাদেরকে প্রথমে নিয়মানুযায়ী দিয়েছে।

এখানকার বাংলাদেশিদের অগ্রিম ভ্যাকসিন নেবার ইচ্ছে থাকা সত্বেও ক্রিটিক্যাল গ্রুপের মধ্যে যদি কেউ না পড়ে তবে ভ্যাকসিন নেবার কোন সুযোগ নেই। সে ক্ষেত্রে দেরি করতে হবে ভ্যাকসিনের জন্য, কারণ নিয়ম মেনে চলা সুইডিশ জাতির নৈতিকতার একটি বিশেষ দিক। অথচ আমেরিকা প্রবাসী বাংলাদেশির অনেকেই সমস্ত এথিক্স এবং মোড়াল ভ্যালুর বিসর্জন দিয়ে মিথ্যার আশ্রয়ে ছোটবড় সবাই প্রথম লাইনের সারিতেই ভ্যাকসিন নিয়েছে। যেখানে বয়স্করা ভ্যাকসিন নিতে পারছে না পর্যাপ্ত পরিমাণ ভ্যাকসিন না থাকার কারণে।

অন্যান্য দেশের নাগরিকদের কথা শতভাগ জানি না তবে বাংলাদেশিরা সত্য মিথ্যাকে নানাভাবে ব্যবহার করে ভ্যাকসিন নিয়ে চলছে। পক্ষান্তরে বাংলাদেশে পর্যাপ্ত পরিমাণ ভ্যাকসিন রয়েছে সত্বেও অনেকে সেটা ভয়ে নিতে রাজি হচ্ছে না। কারণ একটাই সেটা হলো বাংলাদেশে করোনার মৃত্যুর হার অনেক কম আমেরিকার তুলনায়। সেক্ষেত্রে আমেরিকা প্রবাসী বাংলাদেশিরা স্বাভাবিকভাবেই আতঙ্কের মাঝে আছে। যদিও কোন অজুহাত নয় যে বাংলাদেশ গরীব, সেখানে দুর্নীতি, অনিয়ম হয়। সবাই কমবেশি নিপীড়িত, নির্যাতিত, বিতাড়িত সমাজের কাছে।

এসব কারণে যদি মেনেও নেয়া হয় অন্যায়ের বিষয়টি তবুও আমরা যারা দেশের বাইরে থাকি, বলতে গেলে সবাই ভালোই তো আছি। তারপরও কেন আমরা আমাদের চরিত্রের পরিবর্তন করতে সক্ষম হচ্ছি না? আমাদের স্বভাবের পরিবর্তন কি তাহলে কোন দিনও হবে না? আমাদের চরিত্র কি তাহলে কয়লার মত কালো হয়ে গেছে, যা শত চেষ্টা করলেও রং পাল্টাবে না? আজ এক আমেরিকান বন্ধু ফোন করে বিষয়টি জানালো, শুনতে সময় নিজেকে সত্যিই খুব ছোট মনে হচ্ছিল।

ভাবছি আমাদের নিজেদের মধ্যে, নিজ নিজ পরিবারের মধ্যে এবং শিক্ষা প্রশিক্ষণে কতটুকু নৈতিকতা ও মূল্যবোধ শেখানো হচ্ছে? প্রকৃত মূল্যবোধহীন একটি প্রজন্ম দেশ গড়ার পথে যে বড় বাধা, সেটা কি আমরা জানি? বিশ্বে বিভিন্ন দেশ যখন ছোট বড় সকল নাগরিকদের সুশিক্ষার সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে চেষ্টা করছে এবং পারিবারিক শিক্ষার উপর গুরুত্ব দিচ্ছে, তখন আমরা দুর্নীতির মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছি। আমাদের বিবেক সত্যি বেশ ভিন্ন অন্যদের চেয়ে। যদিও সবাই গর্বিত বাংলাদেশি হতে চায় তা সত্বেও কেন এত জটিলতা? এসব প্রশ্ন কিন্তু অবান্তর নয়।

আমি মনে করি আমরা তুলনামূলকভাবে বড় পরিবার। শেয়ার করতে আমরা অভ্যস্ত। মার বুকের দুধও আমরা ইচ্ছা খুশি মত পান করতে পারিনি, পরবর্তী ছোট ভাই-বোনের কারণে। সেক্ষেত্রে আমি মনে করি আমাদের পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ হবার কথা, মহানুভবতার দিক দিয়ে। আমাদের ত্যাগের অভ্যাস সেই জন্মের শুরুতে। আমরা আবেগপ্রবণ তার পরও দিতে শিখিনি, কিন্তু কেন? আমাদের সামাজিক ও ব্যক্তিজীবনেও অনৈতিকতা ও আদর্শহীনতার ছোঁয়া লেগেছে। অন্যের সফলতা আমাদের সহ্য হয় না। তাই তো সুযোগ পেলেই কাউকে বিপদে ফেলতে এতটুকু দ্বিধা করি না। কারও বিপদে সাহায্য করি না। দাঁড়িয়ে তামাশা দেখি। অন্যের নামে কুৎসা রটানো, অন্যকে অপদস্থ করা, রাস্তাঘাট ও গণপরিবহনে নারীদের কটূক্তি করা, তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে মারামারি, খুন—কোনোটিই বাদ পড়ছে না।

ব্যাপারটা এমন হয়ে গেছে যে আমিই ভালো, আমিই সফল হব, সবকিছু আমারই হতে হবে। আমার থেকে অন্য কেউ ভালো থাকতে পারবে না, সেটা যেভাবেই হোক। রাস্তাঘাট, বন্দর, ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস-আদালত, শিক্ষা, চিকিৎসা— এমন একটা খাত খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে নৈতিকতা চরমভাবে বিপর্যস্ত নয়। কর্মকর্তা, কর্মচারী, রাজনৈতিক নেতা, আমজনতা কেউ বাদ নেই। পুরো সিস্টেম একটা সিন্ডিকেটে হয়ে গেছে। অনেকেই হয়তো চাইলেও এই সিন্ডিকেট থেকে বের হতে পারছেন না। আবার অনেকে ইচ্ছা করেই বের হতে চাইছেন না।

এত সহজে অনেক টাকা উপার্জনের সুযোগ সহজে কেউ হাতছাড়া করতে চাইবেন না, এটাই স্বাভাবিক। এসব দুর্নীতি ও অপকর্ম রোধ করা যাদের দায়িত্ব, সেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিজেই কতটা নৈতিক অবস্থানে আছে, বর্তমানে তা সহজেই অনুমেয়। সুতরাং নীতিহীন এই কর্মকাণ্ডগুলো প্রতিরোধ বা নির্মূল করা সম্ভব নয়। তাই বলে সমাজে কি ভালো মানুষ নেই? আছে, তবে দিন শেষে ভালো মানুষগুলোও এ ধরনের দুর্নীতির শিকার। এর থেকে উত্তরণের কোনো উপায় কি নেই? খুব জানতে ইচ্ছে করে!

ভালো কাজ হচ্ছে না তা কিন্তু নয়। তবে বর্তমানে দুর্নীতির যে অবাধ বিচরণ ও অস্থিরতা, মনুষ্যত্বের বিপর্যয়ের যে উচ্চমাত্রা, তা এই অল্পসংখ্যক ভালো কাজ দিয়ে পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়। শক্ত আইন প্রণয়ন ও কোনো রকম পক্ষপাতদুষ্ট না হয়ে সঠিকভাবে বাস্তবায়নই পারবে উত্তরণের পথ দেখতে।

এ তো গেল রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে শুদ্ধি অভিযান। ব্যক্তিজীবনেও আমাদের অনেক কিছু করণীয় আছে। আইন করেই সবকিছু বন্ধ করা যাবে না। আমাকে, আপনাকে সচেতন হতে হবে, নীতিবিরুদ্ধ কাজ করা থেকে নিজেকে সংবরণ করতে হবে। নিজের পরিবারের আয়-উপার্জন সঠিক পথে কি না, দুর্নীতি হয়েছে কি না, খেয়াল রাখুন। নিজেকে সংশোধন করুন, নিজের পরিবারকে দুর্নীতি ও নৈতিক অবক্ষয় থেকে দূরে রাখুন, তাহলেই সম্ভব দিতে শেখা। Some of you May Die, But it’s a Sacrifice I am Willing to Make…

লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন থেকে, rahman.mridha@gmail.com

 

সুত্রঃ যুগান্তর