কেরানীগঞ্জ প্লাস্টিক কারখানার আগুনে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১৪

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের প্লাস্টিক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দগ্ধ আরও ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। বুধবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তারা মারা যান।

এর আগে ঘটনাস্থলে মারা যান ১ জন। সবমিলে এ পর্যন্ত অগ্নিকাণ্ডে ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরও ১৮ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাদের মধ্যে ঢামেক বার্ন ইউনিটে ৮ এবং শেখ হাসিনা বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটে ১০ জনকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।

বুধবার বিকালে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়ার হিজলতলা এলাকার প্রাইম প্লেট অ্যান্ড প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড কারখানায় ভয়াবহ আগুন লাগে। আগুনে পুরো কারখানা পুড়ে যায়। আগুন লাগার প্রকৃত কারণ এখনও জানা যায়নি। এর আগেও ওই কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।

অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে ফায়ার সার্ভিস এবং শ্রম মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। দুই সপ্তাহের মধ্যে এই কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এদিকে কেরানীগঞ্জের কারখানাটির অনুমোদন ছিল না বলে জানিয়েছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব কেএম আলী আজম। বৃহস্পতিবার সকালে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে তিনি এ তথ্য জানান।

বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন ৩২ জনের মধ্যে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। চরম শঙ্কাটাপন্ন অবস্থায় রয়েছেন বাকিরা। চিকিৎসকরা বলছেন, অগ্নিকাণ্ডে আহতদের সবাই জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছেন। এদের মধ্যে ৮ জনকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে। আইসিইউ-এইচডিউ’র বারান্দায় স্বজনদের আর্তনাদ।

আহতদের সর্বশেষ অবস্থা প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটের সমন্বয়ক অধ্যাপক সামন্তলাল সেন বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় হাসপাতালে ভর্তি কারও অবস্থা আশঙ্কামুক্ত নয়। সবার শ্বাসনালি পোড়া। চাকরি-জীবনে এমন ভয়াবহ পোড়া রোগী দেখেননি বলেও জানান তিনি।

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় যারা মারা গেছেন তারা হলেন- কারখানার ইলেকট্রিশিয়ান বাবুল হোসেন (২৬), মেশিন ম্যান্টেইনার্স সালাউদ্দিন (৩২), মেশিন অপারেটর আবদুল খালেক খলিফা (৩৫), সিনিয়র অপারেটর জিনারুল ইসলাম মোল্লাহ (৩২), ইলেকট্রিশিয়ান জাহাঙ্গীর হোসেন (৫৫), ইমরান (১৮), সুজন (১৯), আলম (২৫), জাকির হোসেন, রায়হান বিশ্বাস (১৬), ফয়সাল (২৯), আবদুর রাজ্জাক এবং মেহেদী হোসেন (২০)। এছাড়া ঘটনাস্থলে বুধবার যিনি নিহত হন তার পরিচয় জানা গেছে। তার নাম মাহাবুব (২৫)। তার বাবা গুলজার হোসেন একজন রিকশাচালক।

কারখানাটিতে বিরিয়ানির প্লেট, প্যাকেট ও একবার ব্যবহার উপযোগী (ওয়ান টাইম ইউস) গ্লাস তৈরি করা হয়। পুরান ঢাকার ওয়ারী এলাকার ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম কারখানাটির মালিক। কারখানায় কর্মীর সংখ্যা প্রায় ২০০। যে ইউনিটে আগুন লাগে, সেখানে ৮০ জন কর্মরত ছিলেন।

বুধবার রাতে দগ্ধদের দেখতে হাসপাতালে যান বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। এ সময় তিনি বলেন, কারখানাটির অনুমোদন ছিল না। এই কারখানাসহ আরও কয়েকটি অবেধ কারখানার ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে তিনি স্থানীয় সরকার ও পরিবেশ অধিদফতরকে বলেছিলেন। কিন্তু কারখানাগুলো সরানো যায়নি।

বৃহস্পতিবার সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব কেএম আলী আজম জানান, করানীগঞ্জের প্রাইম প্লেট অ্যান্ড প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ লি. নামের কারখানাটির অনুমোদন ছিল না। ৫ নভেম্বর শ্রম মন্ত্রণালয়ের একজন পরিদর্শক এসে কারখানা কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে সতর্ক করে নোটিশ দিয়েছিলেন। কিন্তু সেটা উপেক্ষা করেই কারখানা চালু ছিল। তিনি আরও বলেন, শিল্পের উন্নয়নের পাশাপাশি কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। এ সময় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের মহাপরিচালক শাহাদাৎ হোসেন, ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক আবুল হোসেন, বিস্ফোরক অধিদফতরের সহকারী পরিদর্শক আবুল হাসেম উপস্থিত ছিলেন।

বৃহস্পতিবার ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক আবুল হোসেন জানান, কারখানাটিতে প্রচুর পরিমাণে এলপি গ্যাসের ব্যবহার হতো। এ ছাড়াও বিভিন্ন কেমিক্যাল তারা ব্যবহার করত। কীভাবে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, সেটি তদন্তের পরই জানা যাবে। তবে কারখানার শ্রমিক ও নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে কথা বলে প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছি, গ্যাস লিকেজের কারণে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।

এদিকে ভয়াবহ এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পক্ষ থেকে সংস্থাটির অ্যাম্বুলেন্স শাখার উপপরিচালক আবুল হোসেনকে প্রধান করে ৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এছাড়া আগুনের ঘটনায় মামলার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই কারখানায় তৃতীয়বারের মতো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর আগে ২০১৬ সালের ২৮ নভেম্বর ও চলতি বছরের ২৫ নভেম্বর আগুন লাগে কারখানাটিতে। আগের দুটি অগ্নিকাণ্ডে কারখানার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলেও কেউ হতাহত হয়নি। সর্বশেষ বুধবার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে বহু মানুষ হতাহত হয়েছে। ২০ শতাংশ জায়গার ওপর সেমিপাকা কারখানাটি পুড়ে গেছে।

প্রাইম প্লেট অ্যান্ড প্লাস্টিক কারখানার একজন সাবেক শ্রমিক কবির হোসেন। ভয়াবহ এ ঘটনার সংবাদ পেয়ে বৃহস্পতিবার তিনি পুড়ে যাওয়া কারখানা দেখতে এসেছেন। তিনি বলেন, প্রায় দুই বছর এখানে কাজ করেছি। কারখানার পরিবেশ শ্রমিকবান্ধব না। ভেতরে প্রচুর কেমিক্যাল ও এলপি গ্যাসের ব্যবহার হয়। কিন্তু পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা না নিয়েই এসব রাখা হয়। এ ছাড়াও বিশাল কারখানা হলেও ঢোকার ও বের হওয়ার রাস্তা মাত্র একটি। জরুরি বহির্গমন পথ নেই। শ্রমিকদের বেতনও ঠিকমতো দেয়া হতো না। এসব কারণে তিনি চাকরি ছেড়ে দেন।

স্থানীয় বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম অভিযোগ করেন, আবাসিক এলাকায় কারখানাটি অবস্থিত। কয়েকবার অগ্নিকাণ্ডের পর এলাকাবাসী প্রচণ্ড আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। নভেম্বরে অগ্নিকাণ্ডের পর কারখানাটি এখান থেকে সরিয়ে নেয়ার জন্য এলাকাবাসীর দাবি ছিল। ওই সময় কিছুদিন বন্ধ ছিল। এরপর আবারও তারা সেটি চালু করে।

কেরানীগঞ্জ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কামরুল হাসান সোহেল বৃহস্পতিবার দুপুরে জানান, কেরানীগঞ্জের উত্তর শুভাঢ্যা এলাকায় এ রকম আরও একটি কারখানা ছিল। সেখানেও একই পণ্য উৎপাদন করত তারা। যেহেতু এই প্রতিষ্ঠানের কোনো অনুমোদন ছিল না, তাই উত্তর শুভাঢ্যার কারখানাটি সিলগালা করে দেয়া হয়েছে। তবে অভিযানের সময় সেখানে কাউকে পাওয়া যায়নি।