কেমন ছিলেন আমাদের চেয়ারম্যান

আমার চেয়ারম্যান। অথচ আমি তার সঙ্গে পরিচিত ছিলাম না। কথাটা শুনতে ভালোলাগার কথা নয়। তবু বাস্তবতা হচ্ছে- তাকে চেনার-জানার সুযোগ ছিল না।

ঢাকা থেকে দূরে বহুদূরে থাকি, ঢাকায় যাই কালেভদ্রে, কাজ সেরে ফের চলেও আসি। আমার চেয়ারম্যান প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা বাংলাদেশের শিল্পপ্রাণ নুরুল ইসলামকে চেনার কিংবা কাছে গিয়ে জানার সুযোগ আসলে মফস্বল সাংবাদিকদের কমই।

বেশ কয়েক বছর আগের কথা। সাতক্ষীরা-২ (সাতক্ষীরা সদর) আসনের সংসদ সদস্য জাতীয় পার্টির এমএ জব্বার। খুবই হাস্যরসিক। ঢাকার হোটেল সুন্দরবনসহ বহু শিল্পের মালিক তিনি। প্রয়াত হয়েছেন গত ৭ এপ্রিল।

একদিন সাতক্ষীরায় মর্নিংওয়াক করার সময় দেখা। বললেন, আপনি তো যুগান্তরে। আপনাদের যুগান্তরের মালিক অর্থাৎ যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যানকে চেনেন দাদা। আমার একই জবাব, না কীভাবে চিনব বলুন। তিনি তো বিশাল মহিরুহ, আমি তার নাগাল পাব কী করে! এমপি সাহেব বললেন। ঢাকায় চলেন, আপনার সঙ্গে দেখা করিয়ে দেব। আমি বললাম ধন্যবাদ। জব্বার সাহেব বললেন, শোনেন আপনাদের মালিক নুরুল ইসলাম, বসুন্ধরার মালিক এবং আমি একসঙ্গে মর্নিংওয়াক করি।

সেদিন সংসদ সদস্য এমএ জব্বারের কথায় বুঝেছিলাম তারা দুজনই বাস্তববাদী, সত্যগ্রাহী, সত্যবাদী। এ দুজনের কেউই আর বেঁচে নেই। অথচ কথাগুলো আমার মনে দাগ কেটে আছে। তিনি আরও বলেন, নুরুল ইসলাম আর সালমা ম্যাডামকে সাতক্ষীরায় নিয়ে আসব; কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি।

আমার প্রয়াত চেয়ারম্যানকে নিয়ে আরেকটি কথা। ২০০৬ সালে জনাব আবেদ খান তখন যুগান্তর সম্পাদক। আমাদের প্রতিনিধি সম্মেলন চলছে। সম্মেলনের একপর্যায়ে মফস্বল সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে বেশকিছু দাবি উঠে এলো। যমুনা গ্রুপ চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম মনোযোগ সহকারে সবই শুনলেন।

হাসতে হাসতে বললেন, সম্পাদক উপস্থিত আছেন, তিনি আপনাদের দাবি যেভাবে পূরণ করতে বলবেন আমি সেভাবেই করব। আমরা প্রীত হলাম। কিছুদিন পর থেকেই আমাদের বেতন-ভাতায় সুযোগ-সুবিধায় অনেকটাই পরিবর্তন।

ভাবলাম যমুনার প্রাণ নুরুল ইসলামের কথার মূল্য আছে। তিনি অহেতুক কোনো আশ্বাস দেননি। চেয়ারম্যানের সঙ্গে প্রতিনিধি সম্মেলনে আমার আরও দু-একবার সাক্ষাৎ হলেও নৈকট্যসৃষ্টির কোনো সুযোগ মেলেনি।

আমার চেয়ারম্যান ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। এমন একটি বিশাল পরিচয় নিয়ে তিনি নিজেকে যেমন একজন দেশপ্রেমিক হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন, তেমনি সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের শিল্প সম্ভাবনাকে এগিয়ে নিয়েছিলেন। যার গতিশীল নেতৃত্ব, যার মেধা ও ক্লান্তিহীন চেষ্টা ৪১টি শিল্পের জন্ম দিতে পারে, তাকে নিয়ে দেশবাসীর গর্ব করার বিষয় রয়েছে। তাকে আমার স্যালুট। কারণ এতেও তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি চেয়েছিলেন বাংলাদেশকে একটি শিল্পসমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে।

আমার চেয়ারম্যানের অকাল প্রয়াণের আগে তার বক্তব্যে শুনেছি ‘অপেক্ষা করুন, দেশেই তৈরি করব সিঙ্গাপুরের চেয়েও উন্নত হাসপাতাল, যেখানে থাকবে সব চিকিৎসা ব্যবস্থা’। বুকের পাটা কত বড় ও শক্ত হলে এ কথা বলা সম্ভব। তিনি বেঁচে থাকলে সে কাজ নিশ্চয়ই করে যেতেন।

যমুনা টেলিভিশন অন এয়ার হতে অনেক বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়েছিল। সেসময় সাংবাদিক বন্ধুদের কাছ থেকে শুনেছি, যতদিন যমুনা অনুমোদন পায়নি ততদিন ধরে যমুনা টিভিতে নিয়োগকৃত সব সংবাদকর্মী তাদের বেতন-ভাতা নিয়মিত পেয়েছেন।

তাদের পেছনে তিনি প্রতিমাসে কোটি টাকা ব্যয় করেছেন। অথচ কাউকে তিনি বলেননি চাকরি ছেড়ে দিতে। বরং সবাই তার ওপর আস্থা রেখে চাকরিতে বহাল থেকেছেন। তিনি তাদের বলেছিলেন, ‘যমুনা একদিন আলোর মুখ দেখবেই’। সত্যিই তিনি যমুনাকে আলোর মুখ দেখিয়ে কথা রক্ষা করেছেন। চেয়ারম্যান নুরুল ইসলামের বদান্যতা ও মানবসেবা ছিল অতুলনীয়। চলমান করোনা দুর্যোগে যমুনা গ্রুপ চেয়ারম্যান প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণভাণ্ডারে ১০ কোটি টাকা দিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন।

১৩ জুলাই টিভি দেখে আমার এক স্বজন জানালেন, যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান, দেশের শীর্ষ শিল্পপতি নুরুল ইসলাম আর নেই। কথাটা যেন আমার কানে নয়, বুকে ধাক্কা মারল। জানতে চাইলাম আরেকবার বলুন তো। একই কথা, যমুনার চেয়ারম্যান মারা গেছেন।

যুগান্তর অফিসে ফোন করলাম। ফোনের ও প্রান্ত থেকে কেবলই ডুকরে কান্নার শব্দ ভেসে এলো। এরপর ফোন কেটে দিলাম। সেদিন এমন একটি অশুভ খবরের মুখোমুখি হতে হবে আমাকে, সেটি ভাবিওনি। অথচ সেই কঠিন সত্যটিকে মেনে নিতেই হল।

আমাদের অভিভাবক চলে গেছেন। রেখে গেছেন তার সব শিল্পকর্ম। জীবনব্যাপী যেভাবে তিনি দৈনিক যুগান্তর ও যমুনা টিভিসহ সব শিল্পকে সাজিয়েছেন, ঠিক সেভাবেই তা বেঁচে থাকবে। তার আরাধ্য কাজ পূরণ হবে কি না, ভবিষ্যৎ বলতে পারবে।

তবে তিনি যে তার কর্মযজ্ঞে চিরদিন বেঁচে থাকবেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তিনি অনন্তলোকে বসে সবই প্রত্যক্ষ করবেন। আর আমরা কেবলই তার মহিমাকীর্তন করব। কারণ তিনি এক মৃত্যুহীন প্রাণ। তাই বলতেই হয় ‘এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ, মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান’।

সুভাষ চৌধুরী : যুগান্তরের সাতক্ষীরা প্রতিনিধি

 

সুত্রঃ যুগান্তর