কেন কুঁড়িতেই ঝরে যাবে ক্রিকেটাররা?

আব্দুুল্লাহ আল মারুফ

সবশেষ জিম্বাবুয়ে সিরিজ এবং চলমান অষ্ট্রেলিয়া সিরিজের সবচেয়ে বড় দুই বিজ্ঞাপনের নাম আফিফ ও শামীম পাটোয়ারি। মাত্র কয়েক ম্যাচ খেলেই এই দু’জন ক্রিকেটার এখন এদেশের কোটি ক্রিকেটভক্ত ও বোদ্ধাদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। অনেকেই এ দু’জনের মধ্যে আগামীর বড় তারকা হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন। মাত্র কয়েকটি ইনিংস দিয়েই যে অনেকের মনেই আশার বীজ বুনেছেন এই দুু’জন অকুতোভয়, সে কথা আজ বলায় যায়।

কিন্তু ক্রিকেট প্রেমীদের হৃদয়ে এমন আশার বীজ তো এর আগেও অনেকেই বুনেছিলেন! আফতাব, নাসির, বিজয়, এনামুল জুনিয়র, আবুল হোসেন, সোহাগ গাজী, নাইম, আরো কত কত নাম। সকলেই তো ফুল হয়ে ফোটার আগেই ঝরে গেছেন কুুঁড়িতে! হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ছাড়া আর কিছুই যে দিতে পারেননি তাঁরা। তাইতো স্বপ্ন দেখতেই ভয়, এদেশের ক্রিকেট প্রেমীদের। কতশত প্রতিভা চোখের সামনে অতীত হয়েছে, তার হিসেব যে সবচেয়ে বেশি রাখে এদেশের ক্রিকেট প্রেমীরাই।

কিন্তু কেন এমনটা হয়? কেন এমনটা হয়েছে? আবার কেনই বা এমনটা হবে? এসব প্রশ্নের উত্তরে অধিকাংশ ক্রিকেট প্রেমীদের আঙ্গুল এদেশের ক্রিকেট কর্তাদের দিকে হলেও, ক্রিকেটারদের ব্যক্তিগত জীবনযাপন, মানসিকতা এবং পরিশ্রমের অভাবকে দায়ী করার মানুষও নেহাত কম নয়। আবার কেউ কেউ, অতি উৎসাহী ক্রিকেটপ্রেমী এবং গণমাধ্যমের ভূমিকাকেও দায়ী করেন।

রুমেল রহমান বলেন, “বিসিবির অবহেলা, সঠিক পরিচর্যা এবং ক্রিকেটারদের ভালো করার ক্ষুধার অভাবে এমনটি হয়।” তিনি ঘরোয়া ক্রিকেটে নিম্ন মানের উইকেটের পাশাপাশি লীগের মানকেও দায়ী করেন।

শাহাদাত হোসেন জানান “এর সবচেয়ে বড় দায় বোর্ডের, তারপর খেলোয়ারদের। সাব্বির, নাসির হারিয়ে যাওয়ার পেছনে যেমন ওদের ব্যক্তিগত দায় সবচেয়ে বেশি, ঠিক বিজয়, ইমরুল হারিয়ে যাওয়ার পেছনে বোর্ডের দায় অনেক।” এরপর তিনি কোহলি, বাবর আজমদের উদাহরণ টেনে বলেন, “ওরা যেমন নিজেদের পরিশ্রমে এতদূর এসেছে, তেমনি ওদের পিছনে বোর্ডের পরিশ্রমটাও নেহাত কম নয়।”

আসিফ নীল এজন্য খেলোয়ারদের প্রতি বিসিবির দায়িত্বহীনতাকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, ” সব থেকে বড় কারন, বিসিবি খেলোয়ারদের মূল্য দিতে জানেনা। খেলোয়ারদের স্বাধীনতা দিতে হবে, তাদের চাপমুক্ত রাখতে হবে।” দু’এক ম্যাচ দেখে গণমাধ্যমের অতিরিক্ত খবরকেও তিনি ক্রিকেটারদের জন্য চাপের কারন বলে মনে করেন। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমকে সহনশীল ভূমিকা তথা মাত্রাতিরিক্ত কিছু না করার জন্যও বলেন।

ইমরান রউফ এক্ষেত্রে ক্রিকেটারদের সঠিক মানসিক গ্রুমিং, তাঁদের জীবনযাপন সম্পর্কে সঠিক দিক নির্দেশনার অভাব এবং বিদ্যমান ক্রিকেট পরিবেশকে দায়ী করেন। ক্রিকেট কোচ মাহাবুব আলম মুস্তাকিম ক্রিকেটারদের সঠিক পরিচর্যার বিষয়টিতে গুরুত্বারোপ করেন।

তানসিম আলম সৈকত ক্রিকেটারদের আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তার পাশাপাশি তাদের শারিরীক ও মানসিক বিকাশের উপর গুরুত্ব দিয়ে বলেন, “ক্রিকেটারদের সার্বক্ষণিক পরিচর্যার প্রয়োজন। অনেক প্রতিভাবানকে নিজের দোষে অকালে ঝরে যেতে দেখেছি। এর জন্য কাঠামোগত পরিবর্তন আনা জরুরি। উন্নত বিশ্বের খেলোয়াররা ছোট থেকেই খেলার পাশাপাশি অন্যান্য সব কিছুতেই অনেক সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকে, সেখানে বাংলাদেশের কেউ কেবল সর্বোচ্চ পর্যায়ের ক্রিকেটার হলেই সেইসব সুবিধাগুলো পায়। আবার অনেকেই অতিরিক্ত টাকা হাতে পেয়ে যা খুশি করে ক্যারিয়ার নষ্ট করে ফেলে। শুধু একজনের দোষ দিয়ে লাভ নেই, সর্বক্ষেত্রে সংশোধন প্রয়োজন।”
ক্রিকেটের কাঠামো পরিবর্তনের পাশাপাশি ক্লাব ও বোর্ড কর্মকর্তাদের আরো সাংগঠনিক মনোভাবাপন্ন এবং পরিচ্ছন্ন হতে হবে। শরীর গঠনে অবশ্যই ভালো শারিরীক শিক্ষকের উপর গুরুত্ব দিতে হবে, সেই সাথে সব সময় মনোবিদদের সংস্পর্শে ক্রিকেটারদের রাখতে হবে বলে মনে করেন সৈকত।

সুমন ক্রিকেটারদের আত্মবিশ্বাসের অভাবকে দায়ী করে বলেন, “তারা নিজেরাই চাপে ভুগতে থাকে। মনে করে খারাপ করলেই বুঝি বাদ পড়ে যাবো। এভাবে খেলে সামনে যাওয়া যাবেনা।” মাথায় রাখতে হবে, বাদ পড়লে পড়বো, কিন্তু নিজের খেলাটা নিজের মতো করে চালিয়ে যাবো, যোগ করেন সুমন।

জুবায়ের আহমেদ ক্রিকেটারদের ধারাবাহিকতা ও পরিশ্রমের অভাবকে দায়ী করে জানান, “বড় ক্রিকেটার না হওয়ার কারণ হচ্ছে, তারা ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারেনা, আবার ধারাবাহিতা ধরে রাখতে যে কঠোর পরিশ্রম, সেটাও তারা করতে চায়না।”

সুব্রত গুণ এবং মাহমুদুল হাসান ইমন এক্ষেত্রে অভিযোগের আঙ্গুল তোলেন অতিউৎসাহী ভক্ত ও গণমাধ্যমের দিকে।

সুব্রত গুণ এবং ইমন বলেন, “আমরা জনগন ও আমাদের মিডিয়া দুইয়ে মিলে ওদের মস্তিস্কে এতই প্রত্যাশার ভার চাপিয়ে দিই যা ওরা নিতে পারেনা। ফলে প্রদীপ ঠিকমতো জ্বলে ওঠার আগেই নিভে যায়।”

শফিকুল আলম দল নির্বাচনের প্রতি গুরুত্বারোপ করে জানান, “আমাদের এখানে কেউ টি-টোয়েন্টিতে ভালো করলেই তাকে টেষ্ট বা ওয়ানডে দলে সুযোগ দেওয়া হয়। ফলে সেই ক্রিকেটারটি স্বাভাবিক নিয়মে নতুন পরিবেশ পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারেনা। ফলাফল কয়েক ম্যাচ খারাপ করার পর তার মধ্যে যে চাপ সৃষ্টি হয়, সেটি থেকেই সে আর বের হতে পারেনা। এভাবেই একটা সময় সে হারিয়ে যায়।”

সবুজ সাহা বোর্ড কর্মকর্তা ও দেশি কোচদের উপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, “সবার আগে ঘরোয়া ক্রিকেটের মান উন্নত করে আমাদের পাইপলাইন আরো সমৃদ্ধ করতে হবে। দেশি কোচদের গুরুত্ব দিতে হবে। কেবল টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের খেলা দেখেই একজনকে অন্য ফরম্যাটে সুযোগ দেওয়া উচিৎ হবেনা। ঘরোয়া ক্রিকেটে ভালো করাদের সবসময় অগ্রাধিকার দিতে হবে।” যদি নিজেদের ঘরোয়া ক্রিকেটের মান নিয়ে নিজেরাই প্রশ্ন তোলে, তবে কি সে আয়োজন করার বা আয়োজনের দায়িত্বে থাকার অধিকার তাঁদের থাকে? প্রশ্ন করেন সবুজ।

ক্রিকেট প্রেমীদের নিজস্ব এ উপলব্ধি গুলো কখনোই অস্বীকার করার সুযোগ নেই। এগুলো নিছক কোন আবেগ নয়। ঘন্টার পর ঘন্টা টিভি পর্দায় চোখ রেখে, বছরের পর বছর ক্রিকেট খেলে, পত্রিকার পাতা বা ক্রিকেটার বন্ধুর থেকে এদেশের ক্রিকেট সম্পর্কে খুঁটিনাটি জেনেই এই উপলব্ধি। তাই, গুরুত্ব না দিলে হয়তো একদিন জয় গোস্বামীর ভাষায় বলতে হবে,
“অতল, তোমার সাক্ষাৎ পেয়ে চিনতে পারিনি বলে, হৃদি ভেসে গেল অলকানন্দা জলে”

স/এআর