ঢাকার বসুন্ধরা এলাকায় রিকশা চালান খোরশেদ। জমা বাদে ন্যূনতম এক হাজার টাকা আয় করেন। নভেম্বর এলে রিকশা চালানো থেকে বিরতি নেন। তখন গ্রামে ফিরে কৃষিশ্রমে যুক্ত হন। দক্ষতার দিক থেকে একেবারেই প্রান্তিক খোরশেদের মতো শ্রমিকদের কেউ কেউ ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে কাছাকাছি দূরত্বে ইজি বাইক চালাচ্ছেন, আয় দৈনিক ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা। অথচ দুই দশক আগেও কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের শ্রমবাজারের ৫১ শতাংশেরও বেশি মানুষ কৃষিশ্রমের সঙ্গে জড়িত ছিল, বর্তমানে যা ৩০ শতাংশ। চারঘাটের কৃষক শরিফের তাই নাভিশ্বাস অবস্থা।
কখনো কখনো ৮০০ টাকা রোজে কামলা পাওয়াও তার জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। জনপ্রতি আবাদযোগ্য জমি কমে আসছে, নদীবিধৌত উর্বর জমির প্রকৃতিনির্ভর কৃষিতে প্রকট হয়ে উঠছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের কৃষির এই চালচিত্র ভাবিয়ে তুলছে খাদ্য নিরাপত্তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মহলকে। ফসল উৎপাদনের খরচ কমাতে হবে, ন্যূনতম জমিতে অধিক ফসল ফলাতে হবে, বাংলাদেশের কৃষিকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সামলে উঠতে হবে।
মাঠ পর্যায়ে কৃষিপণ্য উৎপাদন এবং একজন ভোক্তার কাছে সেটি পৌঁছানো পর্যন্ত প্রতিটি কর্মকাণ্ডে সঠিক প্রযুক্তির প্রয়োগ ঝুঁকি ও উৎপাদন ব্যয় কমাতে পারে। তথাপি কৃষির মতো একটি বিশাল সাপ্লাই চেইনে কৃষকের বেঁচে থাকা, ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি খাদ্য নিরাপত্তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। সম্প্রতি কৃষিতে তুলনামূলক সক্ষম, শিক্ষিত তরুণরাও হাই ভ্যালু ক্রপস উৎপাদনে মনোনিবেশ করছে। অধিক মূল্যের পণ্য চাষে প্রযুক্তির সফল প্রয়োগ যত দ্রুত ঘটছে, ধান কৃষকের প্রধান আবাদ হওয়া সত্ত্বেও আপামর কৃষকের ধান চাষের ব্যয় কমানো ততটা সহজ হচ্ছে না। এরই মধ্যে নিজ তাগিদে কৃষক হালের বলদ ছেড়ে যান্ত্রিক ভূমিকর্ষণ বেছে নিয়েছেন, বর্তমানে যা ৯০ শতাংশেরও বেশি। সেচের কাজে যন্ত্রের ব্যবহার ৮০ শতাংশের ওপরে। তবে যন্ত্রের ব্যবহার বাড়লেও জ্বালানি সাশ্রয়ের জন্য উপযুক্ত টেকনোলজির পরীক্ষা-নিরীক্ষা অব্যাহত রয়েছে। কৃষিশ্রম উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে অনুধাবন করে সরকার ২০১৬ সালে ২০৪১-এর মধ্যে কৃষিতে যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ানোর লক্ষ্যে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদি রোডম্যাপ অনুমোদন করে। অতিমারির শুরুতে হাওরে ধান কাটা ও মাড়াইয়ের জন্য শ্রমিকসংকট চরমে পৌঁছলে সরকার সেই সময় দ্রুত ২০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের অধীনে কম্বাইন হারভেস্টারের বন্দোবস্ত করে। এতে হাওরাঞ্চলের বহু কৃষক উপকৃত হন। বর্তমানে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর তিন হাজার ২০ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের অধীনে কম্বাইন হারভেস্টার ক্রয়ের জন্য ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ ভর্তুকি দিচ্ছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্ম পাওয়ার অ্যান্ড মেশিনারি বিভাগের অধ্যাপক ড. চয়ন কুমার সাহার মতে, ‘কম্বাইন হারভেস্টার ধান কাটা ও মাড়াইয়ের খরচ প্রায় এক-তৃতীয়াংশে নামিয়ে আনে। আর স্বল্প সময়ে ধান কাটা ও মাড়াই সম্ভব বলে পরবর্তী ফসলের জন্য জমিও তাড়াতাড়ি প্রস্তুত করা যায়।’
কম্বাইন হারভেস্টার বাংলাদেশের ক্ষুদ্র চাষিদের কতটা উপকারে আসবে, যেখানে বাংলাদেশের বেশির ভাগ কৃষকের জমি ১০০ শতাংশের নিচে। বড় আয়তনের ক্ষেত কম্বাইন হারভেস্টার ব্যবহারের উপযোগী হলে এবং ক্ষুদ্র ধান চাষিরা ব্যয়বহুল ও উচ্চ প্রযুক্তির কম্বাইন হারভেস্টার থেকে উপকৃত হবেন কি? কিংবা উচ্চ প্রযুক্তি ও ব্যয়বহুল কম্বাইন হারভেস্টার ক্রয়ে সরকার ভর্তুকি দিলেও কম্বাইন হারভেস্টারে রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট আশাপ্রদ কি?
কয়েক দশক ধরেই কৃষি উপকরণের পাশাপাশি কৃষিযন্ত্র ভাড়া দেওয়া সার্ভিস সেক্টর হিসেবে ক্রমেই আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। কৃষিসেবা সেক্টরে ভূমিকর্ষণ ও সেচযন্ত্র এরই মধ্যে জনপ্রিয়। বর্তমানে চাহিদার কারণে কম্বাইন হারভেস্টার এই সেক্টরে স্থান করে নিচ্ছে। প্রকৌশলী হাবিবুর রহমান বিগত ছয় বছরে ২৭টি কম্বাইন হারভেস্টার কিনেছেন, বর্তমানে চালু আছে ২২টি। কৃষি সার্ভিস সেক্টরে অভিজ্ঞ উদ্যোক্তা তিনি। তাঁর মতে, এমন একটি জটিল যন্ত্রের জন্য দক্ষ অপারেটর তৈরি অত্যন্ত জরুরি। বিদেশ থেকে আমদানি করা হারভেস্টারের বিক্রয়োত্তর সেবা এবং খুচরা যন্ত্রপাতির প্রাপ্যতা আরো সহজলভ্য করা প্রয়োজন। তাঁর প্রত্যাশা, ‘কম্বাইন হারভেস্টার যেভাবে জনপ্রিয় হচ্ছে, সরকার অদূর ভবিষ্যতে আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে নিজস্ব প্রযুক্তিতে দেশীয় কম্বাইন হারভেস্টার তৈরির উপযুক্ত পরিকাঠামো তৈরিতে অধিক মনোযোগী হবে।’
বগুড়ার শেরপুরের লালন দেড় বছর আগে কম্বাইন হারভেস্টার কিনেছেন, ভাড়ায় বিভিন্ন জায়গায় ধান কাটেন। লালন আত্মবিশ্বাসী, তাঁর বিনিয়োগ উঠে আসবে। তাঁর মতে, পাশাপাশি জমিতে একই জাতের ধান, একই সময় রোপণ সম্ভব হলে কৃষকের ধান কাটা ও মাড়াইয়ের খরচ সত্যিই সাশ্রয়ী হবে। কৃষকরা সংঘবদ্ধভাবে ট্রান্সপ্লান্টার ও কম্বাইন হারভেস্টার ব্যবহার করলে সহজেই ২০৪১-এর মধ্যে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের লক্ষ্য অর্জন সম্ভব।
সেবা খাত হিসেবে কৃষিযন্ত্র ভাড়া দেওয়া একটি বৃহৎ বাজার। এই সেবাকে অংশীজনদের কাছে সহজলভ্য করতে কেনিয়ায় ‘হ্যালো ট্রাক্টর’ উবারের মতো সার্ভিস চালু করেছে। সেখানে যে কেউ কৃষিযন্ত্র ট্যাক্সি সার্ভিসের মতোই ভাড়া দিতে পারেন। ‘হ্যালো ট্রাক্টর’-এর বাংলাদেশি সংস্করণ নিয়ে আসছে স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠান স্ট্যানমেক। স্ট্যানমেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জেরেমি ডেভিস জানান, কৃষক পাওয়ার টিলার, ট্রান্সপ্লান্টার, সেচযন্ত্র, কম্বাইন হারভেস্টার মালিকদের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হবেন এই অ্যাপসের মাধ্যমে, অগ্রিম বুকিং দিতে পারবেন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, জিপিএস ও জিআইএসের কল্যাণে সেবা প্রদানকারী উদ্যোক্তারা কৃষকদের আরো কাস্টমাইজড সেবা দিতে পারবেন। শেয়ারে কৃষিপণ্য পরিবহন এই সার্ভিসের সঙ্গে যুক্ত হবে।
নতুন নতুন সেবার হাত ধরে আরো স্মার্ট উদ্যোক্তার জন্ম সময়ের ব্যাপার। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বাংলার কৃষকের দ্বারেও কড়া নাড়ছে।
লেখক : কো-ফাউন্ডার, পার্ট টু, ম্যানেজমেন্ট কনসালট্যান্ট ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক বিশ্লেষক
সূত্রঃ কালের কণ্ঠ