কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাতে : নিয়ন্ত্রণে কৌশলী ভূমিকায় রাজশাহীর প্রশাসন

পুরনো ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক:

‘ইউরোপিয়ান কালচারে’ কিশোর গ্যাংয়ের অস্তিত্ব দীর্ঘদিনের। ‘অন্তর্জাল’র সহজলভ্যতায় যোগাযোগ ব্যবস্থা এখন হাতের মুঠোয়। ফলে পশ্চিমা সংস্কৃতির এই ‘গ্যাং কালচার’ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশে। সারাদেশের মতই শিক্ষানগরী খ্যাত রাজশাহীতে কিশোর উৎপাত দিন দিন বাড়তে থাকে। কিশোর গ্যাংয়ের নানা অপরাধমূলক কার্যকলাপে ধীরে ধীরে শান্ত-স্নিগ্ধ ছিমছাম এই মহানগরী হয়ে উঠে অশান্ত। তাদের অপরাধের কারণে সবুজে ঘেরা রাজশাহী শহর মাঝে-মধ্যেই হচ্ছে রক্তে রঞ্জিত। মহানগরীর ৩০টি ওয়ার্ডে বর্তমানে অন্তত ৫০টি কিশোর গ্যাংয়ের পাঁচ শতাধিক সদস্যের উৎপাতে অনেকটা দিশেহারা নগরবাসী। আর এসব কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্মের লাগাম টানতে আইন-শৃক্সক্ষলা বাহিনীর সদস্যরা ইতোমধ্যেই সামাজিক আন্দোলনসহ বিভিন্ন কৌশলী পদক্ষেপ নিয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজশাহী মহানগরীতে ছোট-বড় প্রায় অর্ধশত কিশোর গ্যাংয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ‘ডি-হট বয়েজ’, ‘হট বয়েজ কিশোর গ্যাং’, সিএন্ডবি বয়েজ, হিটার বয়েজ, রাজশাহী ডেঞ্জার বয়েস (আরডিবি), খুলিপাড়া গ্যাং, বিটক্যাল গ্রুপ, বুলেট গ্যাং, গুড়িপাড়া, কাটাখালী মাফিয়া বাহিনী অন্যতম। এই কিশোর গ্যাংগুলোর মধ্যে ‘ডি-হট বয়েজ’, ‘হট বয়েজ কিশোর গ্যাং’, সিএন্ডবি বয়েজ, খুলিপাড়া গ্যাং সবচেয়ে বেশি অপরাধমূলক কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের ছত্রছায়ায় এসব কিশোর বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এছাড়া নিজ নিজ এলাকায় আধিপত্য ধরে রাখতে এলাকার কথিত ‘বড় ভাই খ্যাত’ প্রভাবশালী মহল তাদেরকে আরও বেশি ভয়ঙ্কর করে তুলছে। ‘হিরোইজম’ প্রকাশ করতেও পাড়া-মহল্লায় কিশোর গ্যাং গড়ে উঠছে। এসব গ্যাং সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব, চাঁদাবাজি, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, ইভটিজিং, চুরি, ছিনতাই, প্রেমঘটিত বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্বের জেওে হত্যাকাণ্ডসহ সর্বনাশা মাদক কারবারীর সঙ্গে জড়িত।

সূত্র জানায়, অর্ধশত কিশোর গ্যাংয়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভয়ানক নগরীর প্রাণকেন্দ্র নিউমার্কেট ও গোরহাঙ্গা রেলগেট সুলতানাবাদ এলাকার ‘হটবয়েজ কিশোর গ্যাং’। গ্যাংটির অর্ধশতাধিক সদস্যদের ছোট-খাটো বিষয়ে দেশিও ও আগ্নেয়াস্ত্রেও অস্ত্রের মহড়া প্রায় নিত্যদিনের কুকর্ম। এই গ্যাংটির নেতৃত্বে রয়েছে- বিশাল, সজিব, হৃদয়, রানা ও শাওন। তারা এলাকার কিছু পরিত্যাক্ত ভবনকে বানিয়েছে চেম্বার। আর এসব চেম্বারে একাধিক টর্চার সেল রয়েছে বলে বিশ^স্ত একাধিক সূত্র জানিয়েছে।

রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ (আরএমপি) সূত্র জানায়, সম্প্রতি (৩ জুলাই) রাজশাহী নগরীতে সনি হত্যাকাণ্ডের পিছনে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরাই জড়িত। নগরীর হেতেমখাঁ সবজিপাড়া মহল্লার ‘কিশোর গ্যাং লিডার’ মঈন ওরফে আন্নাফসহ কয়েকজন কিশোরের সঙ্গে দড়িখরবনা এলাকার নিহত সনিসহ আরও কয়েকজনের বিরোধ ছিলো। গত ২১ মার্চ রাজশাহী নগরীর নিউ মার্কেট এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রিয়াজ নামের এক কিশোর খুন হন। এই হত্যাকান্ডেও কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা জড়িত বলে আইন-শৃক্সক্ষলা বাহিনীর সদস্যরা জানিয়েছে। এছাড়া গত ৭ সেপ্টেম্বর রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলায় মেহেদী পলাশ (১৮) নামের এক কিশোর গ্যাং লিডারের নেতৃত্বে এক এসএসসি পরীক্ষার্থী ছাত্রকে পহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে ওই ছাত্রকে তারা শরীরের বিভিন্ন স্থানে সিগারেটের আগুনের ছ্যাঁকা দিয়ে রাস্তায় ফেলে যায়। এরপর তাকে উদ্ধার করে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি চিকিৎসা দেয়া হয়। এই ঘটনায় ভুক্তভোগী স্কুলছাত্রের বাবা গোদাগাড়ী মডেল থানায় মামলা করেন। পরবর্তীতে ওই মামলায় কিশোর গ্যাং লিডার পলাশ গ্রেপ্তার হলে কয়েক দিন কারাভোগের পর জামিনে মুক্তি পান। মুক্তি পেয়েই ভুক্তভোগী স্কুলছাত্রের চাচাতো বোনকে নানাভাবে উত্যক্তসহ করতে থাকে মেহেদী পলাশ। এরই এক পর্যায়ে গত ৪ অক্টোবর বিকালে উপজেলার মহিশালবাড়ী পুরাতন জেনারেল হাসপাতালের সামনে থেকে ভুক্তভোগী ওই ছাত্রীকে জোরপূর্বক সিএনজিতে তুলে নিয়ে মেহেদী পলাশ দ্রুতগতিতে পালিয়ে যায়। অপহরণে ঘটনায় মামলা হলে গত ৬ অক্টোবর রাত সাড়ে ১১টার দিকে উপজেলার লস্করহাটি গ্রামে অভিযান চালিয়ে র‌্যাব-৫ এর সদস্যরা অপহৃত স্কুলছাত্রীকে উদ্ধার ও অপহরণকারী কিশোর গ্যাং লিডার পলাশ গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়।

অনুসন্ধানে উঠে এসেছে- রাজশাহী সীমান্ত এলাকা হওয়ায় রয়েছে মাদকের সহজলভ্যতা। ফলে উঠতি বয়সের কিশোর-কিশোরীরা মাদকের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। এছাড়া ইন্টারনেটের সহজলভ্যতায় তারা অনলাইনে নিষিদ্ধ বিষয়গুলোর দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে। এতে আবেগ ও হতাশাগ্রস্ত হয়ে তারা মাদকের ভয়াল ছোঁবলে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। আর মাদকের টাকা যোগাড় করতেই এসকল কিশোর গ্যাং বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে।

আরএমপি সূত্র জানায়, অধর্তব্য বেশ কিছু অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় মহানগরীর ৭০-৮০ জন কিশোরের বিরুদ্ধে আদালতে প্রসিকিউশন দাখিল করা হয়েছে। সূত্র বলছে, মহানগরীর তালিকাভুক্ত কিশোর অপরাধীদের মধ্যে নিম্ন-মধ্যবিত্ত ৫০ শতাংশ, নিম্নবিত্ত ৪০ শতাংশ আর উচ্চবিত্ত ১০ শতাংশ রয়েছে। এদের ৫০ শতাংশই শিক্ষার্থী। যাদের বয়স ১৪ থেকে ২২ বছরের মধ্যে। ৩৫ ভাগ কিশোর আগে লেখাপড়া করলেও এখন করে না। এসব কিশোরের মধ্যে ৩৫ ভাগ মাদকাসক্ত, ১০ ভাগ অনিয়মিত মাদক সেবনকারী। এরা প্রভাব বিস্তারের জন্য মারামারি, ছিনতাই, ইভ টিজিংয়ের সঙ্গে জড়িত।

রাজশাহী শহরে কিশোর গ্যাংয়ের অপরাধ প্রতিরোধে র‌্যাব-পুলিশ বিভিন্নভাবে নানা কৌশল অবলম্বনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিশোর অপরাধ প্রতিরোধে র‌্যাবের ভূমিকার বিষয়ে র‌্যাব-০৫ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল রিয়াজ শাহরিয়ার বলেন, ‘যোগাযোগের সহজল্যতার কারণে বর্তমান উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েরা ইউরোপিয়ান কালচার ফলো করছে। তারা নিজেদেরকে ওইভাবে গড়ে তোলার চেষ্টায় আস্তে আস্তে অপরাধ জগতের দিকে ধাবিত হচ্ছে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ‘মোটিভেশনাল স্পিস’ এর মাধ্যমে রাজশাহীতে র‌্যাব কিশোর-কিশোরীদের অপরাধ প্রবণতা প্রতিরোধে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে র‌্যাব সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইনেরও আয়োজন করেছে। যাতে অঙ্কুরেই তারা বিনষ্ট হয়ে না যায়।’

আরএমপি কমিশনার মো. আবু কালাম সিদ্দিক বলেন, ‘২০২০ সালে আরএমপি কমিশনার হিসেবে যোগদানের পর রাজশাহীতে প্রচুর সাইবার ক্রাইমের বিষয়টি জানতে পারি। যোগদানের এক সপ্তাহের মাথায় সাইবার ক্রাইম ইউনিট করি। সাইবার ইউনিট করার পর দেখলাম, পাড়া-মহল্লায় কিশোররা ইভ টিজিংসহ বিভিন্ন অপরাধ করছে। মেয়েরা এর শিকার হচ্ছে। এরপরই আমরা কিশোর গ্যাংয়ের ডাটাবেজ তৈরি করলাম। প্রায় সাড়ে চার’শ কিশোরকে আমরা ধরতে পারলাম।’ পুলিশ কমিশনার বলেন, ‘এরপর পুরো মহানগরীজুড়ে প্রায় সাড়ে চারশত সিসি ক্যামেরা স্থাপন করলাম। এর মাধ্যমে কিশোররা কী করে, কোথায় যায় সবকিছুই ডাটাবেজের মধ্যে করা হলো। প্রায় ৫০০ ছেলেমেয়েকে এই ডাটাবেজের আওতায় আনা হলো। পরে তাদের অভিভাবকদের ডেকে মুচলেকায় ছেড়ে দেয়া হলো। পুলিশের কাছে এখন পাড়া-মহল্লার বখাটেদের তালিকা রয়েছে। তালিকায় যাদের নাম রয়েছে তাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। তাদের পরিবারকে বলা হয়েছে নজর রাখতে।’ তিনি আরও বলেন, ‘কিশোর অপরাধ দমনে বাবা-মাসহ পরিবারের সদস্যদের বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। আমরা কমিউনিটি ও বিটপুলিশিং এর সদস্যদের মাধ্যমে বিভিন্ন থানা এলাকায় সচেতনতামূলক বৈঠক এবং প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছি। সর্বোপরি কিশোর গ্যাং নির্মুলে বাবা-মাসহ পরিবারের সদস্যদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।’

রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, ‘সন্তানরা যাতে কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িয়ে না পরে সেজন্য প্রত্যেক বাবা-মাকে নিজ সন্তানের সার্বিক বিষয়ে খোঁজ-খবর রাখতে হবে। সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কার সাথে মিশে, তার বন্ধু কারা এ বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। কিশোর গ্যাং অপসংস্কৃতি প্রতিরোধে পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘কিশোর গ্যাং প্রতিরোধে সরকার ও আইন-শৃক্সক্ষলা বাহিনী বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। কিশোর গ্যাং সদস্যদের কোনভাবেই রাজনৈতিক প্রশয় দেওয়া যাবে না। আশা করছি, সকলের গৃহীত পদক্ষেপ ও সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আগামীতে কিশোর গ্যাং বলে কোন গ্যাং থাকবে না।’

এএইচ/এস