কিডনি রোগ কিভাবে প্রতিরোধ করবেন

বাংলাদেশে ১০ বছর আগে কিডনি রোগী ছিল শতকরা ১৬ ভাগ; বর্তমানে ২০২১ সালে তা বেড়ে হয়েছে প্রায় ২০ ভাগ। এর প্রধান কারণ প্রতিবছর ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ বৃদ্ধি পাওয়া। ২০১১ সালে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগী ছিল ৮০ লাখ এবং ২০১৮ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক কোটি ১০ লাখ; তেমনি ২০১১ সালে উচ্চ রক্তচাপের রোগী ছিল এক কোটি ৮০ লাখ, বর্তমানে বেড়ে হয়েছে দুই কোটির ওপরে। এর প্রধান কারণ এসব রোগের কোনো উপসর্গ হয় না।

ফলে আক্রান্তরা চিকিৎসকের কাছে যান না। আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, মাত্র ৪০ শতাংশ মানুষ জানেনই না তাঁর ডায়াবেটিস আছে; আর ৬০ শতাংশ মানুষ জানেন না তাঁরা উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। ৯০ শতাংশ মানুষ জানেন না তাঁদের প্রস্রাব দিয়ে আমিষ নির্গত হয়। এর ফলে নিজের অজান্তেই তাঁরা দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে (ক্রনিক কিডনি ডিজিজ) আক্রান্ত হয়। ওই সময়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দেখা যায়, তাঁদের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশের দুটি কিডনিই অকেজো হয়ে পড়েছে। এই সময়ে চিকিৎসা করে সেই রোগের অগ্রগতি কমানো সম্ভব হয় না। ফলে পাঁচ-ছয় বছরের ভেতর তাঁদের দুটি কিডনি ৯০ শতাংশের ওপর বিনষ্ট হয়ে যায়। উপসর্গ না হওয়ায় তাঁরা বিশ্বাসই করেন না যে তাঁদের দুটি কিডনি নষ্ট হয়ে গেছে।
এর সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের রক্তস্বল্পতা বৃদ্ধি পায়। হৃিপণ্ডের অবস্থা খারাপ হতে থাকে। হঠাৎ করে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের প্রবণতা বেড়ে যায় এবং শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। স্বল্পমধ্য আয়ের দেশ হওয়ায় আমাদের ৮০ শতাংশ মানুষ ডায়ালিসিস অথবা কিডনি সংযোজনের মতো ব্যয়বহুল চিকিৎসা করাতে অক্ষম। ফলে চিকিৎসা নিতে না পারায় তাঁরা ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুবরণ করে থাকেন। এ রকম মৃত্যু বেশির ভাগই প্রতিরোধ করা সম্ভব। এর একটি উপায় হলো প্রাথমিক পর্যায়ে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ এবং কিডনি রোগ শনাক্ত করা। আমাদের দেশে প্রায় ১৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক কাজ করছে। প্রতিটি কমিউনিটি ক্লিনিকে একজন নন-মেডিক্যাল স্টাফ নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। এসব রোগীকে, যাঁদের বয়স ২০ বছরের ওপরে তাঁদের কয়েকটি প্রশ্ন করে তাঁর কিডনি রোগ আছে কি না, তা প্রাথমিকভাবে নির্ণয় করা যায়। যেমন—

♦আপনি কি জানেন আপনার ডায়াবেটিস আছে?

♦আপনি কি জানেন আপনি উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন?

♦আপনি কি জানেন আপনার হৃিপণ্ডের রোগ বা হৃিপণ্ডের কার্যকারিতা কমে গেছে?

♦আপনি কি জানেন আপনার পায়ের পাতা বা পায়ের নিচের অংশে অথবা চোখের নিচের পাতা বা মুখমণ্ডল ফুলে যাচ্ছে?

♦আপনার আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে কেউ কি আছে, যার কিডনি সংযোজন করা হয়েছে অথবা কেউ ডায়ালিসিস করে যাচ্ছে কিংবা কিডনি অকেজো রোগে ভুগছে?

♦আপনি বেশির ভাগ সময় ব্যথানাশক ওষুধ সেবন করেছেন কি না?

♦আপনি কি কবিরাজি ওষুধ অথবা গাছগাছড়ার পাতা বেটে আপনার অসুস্থতার জন্য বা ওজন কমানোর জন্য ব্যবহার করে থাকেন?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর যদি না-সূচক হয়, তাহলে বর্তমানে আপনার কোনো কিডনি রোগ ধরা পড়েনি। তার মানে এই নয় যে ভবিষ্যতে আপনার কোনো কিডনি রোগ হবে না। আর যদি এই প্রশ্নগুলোর মধ্যে কোনো একটি প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ-সূচক হয়, তাহলে আপনাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কিডনি রোগ আছে কি না এবং কী পর্যায়ে আছে, তা জেনে নিতে হবে। আপনার কিডনি রোগের লক্ষণ থাকুক বা না থাকুক, আপনাকে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ মিনিট হাঁটতে হবে অথবা ব্যায়াম করতে হবে, সুষম খাদ্য গ্রহণ করতে হবে, দৈনিক দু-তিন লিটার পানি পান করতে হবে। আর পরিহার করতে হবে অতিরিক্ত লবণ, অতিরিক্ত মিষ্টিজাতীয় খাবার, কোমল পানীয় ও ধূমপান। এগুলো মেনে চললে আপনি কিডনি রোগ হওয়ার আশঙ্কা থেকে রেহাই পাবেন।

কিডনি রোগ প্রতিরোধ করতে হলে প্রাথমিক পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিক, যেখানে স্বাস্থ্য পরিচর্যায় একজন নিয়োজিত থাকবেন, তিনি রোগীর নাম, বয়স, রোগীর লিঙ্গ—এগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখবেন। রোগীর উচ্চতা ও ওজন লিখে রাখার পাশাপাশি পরীক্ষা করতে হবে—রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, রক্তের সুগার, প্রস্রাবে সুগার ও আমিষ যাচ্ছে কি না।

মাত্র ৩০০ টাকা খরচ করে এই পরীক্ষাগুলো করা সম্ভব। এর ফলে প্রাথমিক পর্যায়ে তিনটি রোগ শনাক্ত করা সম্ভব এবং তাৎক্ষণিকভাবে প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা নিলে কিডনি রোগ থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব। স্বাস্থ্য পরিচর্যায় নিয়োজিত ব্যক্তি সব রোগীকে, যারা কমিউনিটি ক্লিনিকে প্রতিদিন আসে, তাদের সবাইকে কিছু অত্যাবশ্যকীয় প্রশ্ন করে তা লিপিবদ্ধ করবেন। তাদের যেকোনো একটি পরীক্ষা পজিটিভ হলে নিকটস্থ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডাক্তারের কাছে পাঠাবেন এবং ডাক্তার রক্তের ক্রিয়েটিনিন পরীক্ষা করবেন অথবা না করতে পারলে স্বাস্থ্যবিধি বলে দেবেন।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অত্যাবশ্যকীয় উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ হিসেবে এসিই, এআরবি এবং ডায়াবেটিসের জন্য মেটফরমিন সরবরাহ করা হয়। রোগীকে কবিরাজি ওষুধ এবং ব্যথানাশক ওষুধ খাওয়া থেকে বিরত রাখতে হবে।

এই ব্যবস্থা করা গেলে সুদূরপ্রসারী ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপ ও কিডনি রোগ কমে আসবে।

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ