কাবুল থেকে কিয়েভ : ‘সভ্যতা’র বলি মানুষ

উত্তর-বিশ্ব তথা উন্নত বিশ্বের চলমান ইউক্রেন ট্র্যাজেডির জন্য কে দায়ী—এই প্রশ্নে বিভক্ত হয়ে পড়েছে দক্ষিণ-বিশ্ব তথা তৃতীয় বিশ্ব। অনেকেই সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন ও কিয়েভকে অধীন করে রাখার প্রচেষ্টার জন্য রাশিয়াকে দোষারোপ করেন। অন্যরা ন্যাটোর পূর্বমুখী ও আক্রমণাত্মক সম্প্রসারণ এবং ইউক্রেনকে সশস্ত্র করার মাধ্যমে রাশিয়াকে যুদ্ধে উসকানি দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের দোষারোপ করেন। কিন্তু ঐতিহাসিক রেকর্ডপত্র বলছে, এখানে কোনো পক্ষই নির্দোষ নয়।

মাত্রা ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু দুই পক্ষকেই দোষারোপ করা যায়। দুই পক্ষই তাদের নতুন স্নায়ুযুদ্ধের বেদিতে ইউক্রেনকে বলি দিয়েছে। নিজেদের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হওয়ার তিন দশক পরও মস্কো ও ওয়াশিংটন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মেরুকরণ ও পঙ্গু করার কাজটি অব্যাহত রেখেছে। ট্র্যাজেডি হচ্ছে স্নায়ুযুদ্ধ এমন এক যুদ্ধ, যা উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য প্রতারণাপূর্ণ ও ধ্বংসাত্মক বলে প্রমাণিত হয়েছে।
মূলত যখন থেকে পুরনো ইউরোপীয় দৈত্যগুলো শক্তি হারাতে শুরু করে, তখন থেকে ওয়াশিংটন ও মস্কো ব্রিটিশ-ফরাসিদের একই ক্রীড়া কৌশল ব্যবহার করতে শুরু করে। ফলে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ, গোপন যুদ্ধ, প্রক্সি যুদ্ধ, আকাশে আধিপত্যের যুদ্ধ, তথ্য যুদ্ধ, সাইবার যুদ্ধ এবং পারমাণবিক যুদ্ধের হুমকিসহ নানা ধরনের যুদ্ধের মাধ্যমে তারা সাম্রাজ্যবাদী কূটকৌশল অব্যাহত রেখেছে।

তার পরও দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, ইরাক, আফগানিস্তান, ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন দেশে আমেরিকার ভয়াবহ যুদ্ধ এবং মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের যুদ্ধ ও দখলদারির প্রতি এর অব্যাহত সমর্থনের কথা উল্লেখ করে ওয়াশিংটনের নিন্দুকরা রুশ সহিংসতাকে ন্যায্যতা দিতে এক মুহূর্তও দেরি করে না। আবার মস্কোর নিন্দুকরা আফগানিস্তান, চেচনিয়া, জর্জিয়া, সিরিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে রাশিয়ার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের দিকে ইঙ্গিত করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনকে সঙ্গে সঙ্গেই ক্ষমা করে দেয়।

অথচ খারকিভ ও আলেপ্পোতে বোমা হামলাকে কিভাবে বাগদাদ বা হ্যানয়ের বোমা হামলা থেকে আলাদা করা যায়? ১৯ ও ২০ শতকে বিশ্বজুড়ে চলা রুশ, ইউরোপীয় ও মার্কিন যুদ্ধ, অভ্যুত্থান, আক্রমণ ও দখলদারি থেকে বর্তমানের আধিপত্যবাদী আগ্রাসনকে কি সত্যিই আলাদাভাবে দেখা যায়?

প্রকৃতপক্ষে ‘সভ্য’ দাবি করা উত্তর-বিশ্ব (গ্লোবাল নর্থ) দীর্ঘকাল ধরেই বিশেষভাবে সহিংসতায় ভরপুর ছিল এবং তা ভেতরে ও বাইরে দুই দিক থেকেই। তারা যত বেশি ‘সভ্য’, তত বেশি হিংস্র। অথচ সহিংসতা হচ্ছে সভ্যতার বিপরীত জিনিস। উত্তর-বিশ্ব শত শত বছর ধরে ধর্মীয়, জাতীয়তাবাদী ও মতাদর্শগত যুদ্ধে জর্জরিত হয়েছে। এর মধ্যে কিছু কিছু যুদ্ধ কয়েক দশক স্থায়ী হয়েছে, আর কিছু কিছু যুদ্ধ দ্বিতীয় ও তৃতীয়বারের মতো সংঘটিত হয়েছে। এসব যুদ্ধেরই পরিণতি হচ্ছে দুটি ভয়াবহ ধরনের বিশ্বযুদ্ধ।

তাদের এই ‘সভ্যতা’র বলি হয়েছে দক্ষিণ-বিশ্ব (গ্লোবাল সাউথ)। নিজেদের মধ্যে রক্তপাত ও কোটি কোটি মানুষের গণহত্যার পাশাপাশি দক্ষিণ-বিশ্বের বেসরকারিক ঔপনিবেশিক যুদ্ধ পরিচালনা করে আরো অগণিত ও অসংখ্য মানুষকে হত্যা করে। নিষ্ঠুরভাবে তারা দক্ষিণ-বিশ্বের প্রাচীন সভ্যতাগুলোকেও আক্রমণ করে, সেটা ভারতীয়, চীনা, মুসলিম বা অন্য যা-ই হোক না কেন। বড় বড় ইউরোপীয় বড় সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পাশাপাশি বেলজীয়, ডাচ ও পর্তুগিজদের মতো ছোট ছোট ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোও একই ধরনের নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছে।

প্রয়াত আমেরিকান পণ্ডিত স্যামুয়েল হান্টিংটন তাঁর ‘দ্য ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশনস’ (সভ্যতার সংঘাত) বাইয়ে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন : ‘পাশ্চাত্য বিশ্বকে জয় করেছে তাদের আদর্শ, মূল্যবোধ বা ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে নয় বরং ‘পরিকল্পিত সহিংসতা’ প্রয়োগের মাধ্যমে। এই কাজটি যে অ-পশ্চিমারা কখনোই করেনি—এই সত্যটি পশ্চিমারা প্রায়ই ভুলে যায়।

বর্ণবাদের মতো অজ্ঞতারও কোনো সীমানা জানা নেই এবং আজকের প্রভাবশালী গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোসহ কোনো পেশাই এর থেকে মুক্ত নয়। বর্ণবাদীদের অনেকেই রুডইয়ার্ড কিপলিংয়ের কুখ্যাত কবিতা ‘দ্য হোয়াইট ম্যানস বার্ডেন’-এ বর্ণিত কথাগুলো ঠিকই সাদরে গ্রহণ করেন। যে কবিতাটিতে (ক্ষয়িষ্ণু) ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা ফিলিপাইনে তার ঔপনিবেশিক দায়িত্ব গ্রহণ করার জন্য আমেরিকাকে আহ্বান জানায়। তাতে বলা হয়, আমেরিকান যেন ব্রিটিশদের শুরু করা ‘সভ্যতার মিশন’ পরিপূর্ণ করে।

অথচ এই বর্ণবাদীই ‘টু দ্য পারসন ইন ডার্কনেস’ (অন্ধকারে বসে থাকা লোকদের প্রতি) প্রবন্ধে মার্ক টোয়েইনের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আহ্বানকে এড়িয়ে যেতে খুব পছন্দ করে। বিশ্বখ্যাত এই আমেরিকান লেখক তাঁর প্রবন্ধটিতে বলেছিলেন, ‘আমরা বিশ্বাসঘাতক হয়েছি;…আমরা আমাদের প্রতি বিশ্বাস রাখা লোকদের প্রতারিত ও চূর্ণ-বিচূর্ণ করেছি; আমরা দুর্বল ও বন্ধুহীনদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছি, যারা আমাদের বিশ্বাস করেছিল আমরা তাদের বিরোধী হয়েছি। … আমরা বিশ্বস্ত বন্ধুকে তার জমি এবং তার স্বাধীনতা থেকে ছিনিয়ে নিয়েছি। ’

এক শতাব্দী পর এই সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো আবারও তাদের ক্ষমতা ও সহিংসতার পূর্বাভাস দিচ্ছে এবং গত দুই দশক ধরেই তা টের পাওয়া যাচ্ছে। আসলে সহিংসতার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। সে কোনো জাতি, ধর্ম বা জাতীয়তা জানে না। কিন্তু ‘পরিকল্পিত সহিংসতা’ হলে সেটা খুব তীব্র হয়।

আমরা কিভাবে আশা করতে পারি যে বারবার একই কাজ করে যাব, কিন্তু ফল পাব ভিন্ন ভিন্ন? তাই এ ধরনের পাগলামি বন্ধ করার এখই সময়। পাল্টা প্রশ্ন করে জবাব এড়িয়ে যাওয়ার নির্বোধ কৌশলের অবসান ঘটাতে এখনই সর্বোত্তম সময়।

ইউক্রেন ট্র্যাজেডি থেকে অবশ্যই ভালো কিছুই বেরিয়ে আসবে না। ইরাকি, আফগান, সিরীয়, ভিয়েতনামি, ফিলিপিনো, হাঙ্গেরীয়, চীনা, ভারতীয়, আলজেরীয়, কঙ্গোয়ী, চিলীয় এবং আরো অগণিত সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন থেকে অতীতেও ভালো কিছুই বেরিয়ে আসেনি। না ভুক্তভোগীদের জন্য, না অপরাধীদের জন্য, না ‘অন্ধকারে বসে থাকা’ আমাদের বাকিদের জন্য—কারো জন্যই ভালো কিছু হয়নি।

সুতরাং এখন সময় এসেছে ওপরের দিকে তাকানোর এবং আলো দেখার।

লেখক : আলজাজিরার জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক বিশ্লেষক

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ