কানের যত্নে করণীয়

সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক:

কান শুধুই শুনতে সাহায্য করে না, শরীরের ভারসাম্যও বজায় রাখতে সাহায্য করে। তাই কানের যত্নে অবহেলা করা উচিত নয়।

কটন বাড ব্যবহারকে ‘না’ বলুন

প্রাকৃতিকভাবেই কানের ময়লা বেরিয়ে আসে। কানের ময়লা সাধারণত বিশেষ কারণ ছাড়া আলাদাভাবে পরিষ্কার করার প্রয়োজন পড়ে না। যদি ময়লা বেশি জমে শুনতে অসুবিধা হয়, তাহলে বুঝতে হবে কানের ভেতর স্বাভাবিক কার্যক্রমে কোনো কারণে ব্যাঘাত হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে কানে অলিভ অয়েল অথবা কানের ময়লা নরম করে এমন কিছু ড্রপ তিন-চার ফোঁটা ড্রপারে করে দিনে দু-তিনবার দিতে পারেন। অনেক সময় নিজে থেকে নরম হয়ে বের হয়ে যেতে পারে। তার পরও যদি বের না হয়, নিকটস্থ একজন নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞের কাছে যান। সাকার মেশিন অথবা বিভিন্ন ধরনের কানের ফরেন বডি হুক দিয়ে কান ও কানের পর্দার ক্ষতি না করে সহজেই তিনি ময়লা বের করে দেবেন।

অন্যদিকে কটন বাড ব্যবহার সাময়িক আরাম দিতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির আশঙ্কাই প্রবল। কানের ভেতরে চামড়ার নানা সমস্যা এবং ব্যথার কারণও কটন বাড। এ ছাড়া কাঠি, তেল, পিন, ক্লিপ ব্যবহারের ফলে কানে জীবাণু সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে। বহুদিন ধরে এগুলো ব্যবহার করলে ছত্রাক সংক্রমণও হতে পারে। অহেতুক কান খোঁচাখুঁচি বিপজ্জনক। অনেক সময় কটন বাডের তুলার খানিকটা অংশ কানে থেকে গিয়ে বিপদ বাড়ায়।

কান চুলকানোর সাধারণ কারণ হলো খইল, ছত্রাক সংক্রমণ, অ্যালার্জি, দীর্ঘস্থায়ী চর্মরোগ ও বহিঃকর্ণের সংক্রমণ। তাই কটন বাড দিয়ে কান চুলকালে উপকারের চেয়ে ক্ষতিই হতে পারে বেশি।

কান ব্যথা

কান ব্যথার সম্ভাব্য কারণ হলো কানের মধ্যে খইল জমা হওয়া, কানে জীবাণুর সংক্রমণ হওয়া, মধ্যকর্ণে বা পর্দার পেছনে পানি জমা হওয়া।

কান বন্ধ

কান বন্ধ অনুভবের প্রধান কারণ হলো বহিঃকর্ণের খইল জমা হওয়া অথবা কানের মধ্যে বাইরের কোনো বস্তুর (ফরেন বডি) প্রবেশ। কানের খইল হওয়া একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। খইলের কারণে কান পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে খইল বা ফরেন বডি অপসারণ জরুরি। এ ছাড়া মধ্যকর্ণের সংক্রমণ বা পানি জমে থাকায় কান বন্ধ অনুভব হতে পারে।

কানের খইল সব সময় সাকশন দিয়ে আনা যায় না। অনেক সময় পর্যাপ্ত সফটেনার বা নরম করার উপাদান দেওয়ার পরও খইল শক্ত থাকে। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের হুক, ফোরসেপ ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়ে থাকে, যা একজন অভিজ্ঞ ও দক্ষ চিকিৎসক অতি যত্নের সঙ্গে কানের পর্দার ক্ষতি না করে বের করে দিতে পারেন।

আর দীর্ঘ সময় এবং উচ্চ ভলিউমে গান শোনা শ্রবণশক্তি কমিয়ে দেয়। হেডফোনে গান শোনার সময় বিরতি দিয়ে এবং ভলিউম কমিয়ে শোনা উচিত।

কানে ভোঁ ভোঁ বা শোঁ শোঁ

কানে ভোঁ ভোঁ বা শোঁ শোঁ শব্দ হওয়াকে টিনটাস বলে। এটি অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কানে শোঁ শোঁ শব্দ হওয়া লোকেরা কম শুনে থাকে। কানে খইল, জীবাণু সংক্রমণ, আঘাত, ক্যান্সার এবং অন্তঃকর্ণের সমস্যায় কানে ভোঁ ভোঁ বা শোঁ শোঁঁ শব্দ হতে পারে। সংশ্লিষ্ট রোগের সঠিক চিকিৎসায় টিনিটাস ভালো হতে পারে।

কানের জন্য ক্ষতিকর ওষুধ

নির্দিষ্ট কিছু ওষুধ কানের জন্য ক্ষতিকর। এসব ওষুধ ব্যবহারে অন্তঃকর্ণের কিছু সংবেদনশীল অংশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। ফলে শ্রবণশক্তি হ্রাস পায়। তাই এসব ওষুধ অবশ্যই একজন অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শে ব্যবহার করা উচিত।

কেন আমরা কানে কম শুনি?

যেকোনো বয়সের মানুষ, একেবারে সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া শিশু থেকে বৃদ্ধ বয়সের ব্যক্তি শ্রুতির সমস্যায় ভুগতে পারেন।

বয়সজনিত পরিবর্তন

এটিকে সবচেয়ে বড় কারণ ধরা হয়। বয়স বাড়লে শারীরবৃত্তীয় অনেক পরিবর্তন হয়। এর মধ্যে শ্রবণশক্তি হ্রাস অন্যতম। অন্তঃকর্ণের সেন্সরি কোষ (Hair cell) ক্ষতিগ্রস্ত বা ক্ষয়গ্রস্ত হয়। এ ক্ষেত্রে হিয়ারিং এইডের বিকল্প নেই।

শব্দদূষণ

এটিকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কারণ হিসেবে দেখা হয়। এটিকে নীরব ঘাতক হিসেবে বিবেচনা করা যায়। গাড়ির হর্ন, কলকারখানার ভারী যন্ত্রাংশের শব্দ, মাইকের অসতর্ক উচ্চমাত্রার ব্যবহার, নির্মাণকাজ থেকে দূষণ সৃষ্টিকারী তীব্র শব্দের উৎপত্তি হয়। পরিবেশের কোলাহল থেকেও মারাত্মক শব্দদূষণের সৃষ্টি হতে পারে, যা আমাদের কানের শুনানি মারাত্মক ব্যাহত করে।

ইনফেকশন, কান পাকা ও কানের ওয়াক্স

ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গাস সংক্রমণ হয়ে কানে ইনফেকশন হতে পারে। সাধারণত কটন বাড, কাঠি ব্যবহারকারীদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। এ ছাড়া ময়লা পানিতে সাঁতার বা গোসল করা ও শরীরের অন্য কোনো ইনফেকশনের কারণে হতে পারে। কান পাকা বা কানের পর্দায় ছিদ্র থাকলে কানের শুনানি ধীরে ধীরে কমতে থাকে। কানের ওয়াক্স বেশি মাত্রায় জমে গেলেও শুনানি কমতে পারে, যা বের করে দিলে শুনানি স্বাভাবিক হয়ে যায়।

জেনেটিক বা জন্মগত ত্রুটি বা অসুখ : বিভিন্ন কারণে সারা বিশ্বে এটি এখন মহামারির রূপ নিচ্ছে।

আঘাত ও ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া

কানে ও মাথায় আঘাত এবং নির্দিষ্ট কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে শুনানি কমতে থাকে।

টিউমার

কান, ব্রেন ও আশপাশের কিছু টিউমারের কারণে কান ও শ্রবণের স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

সেন্ট্রাল অডিটরি প্রসেসিং ডিজ-অর্ডার

এতে কান ও কানের কার্যকারিতা ঠিক থাকে, কিন্তু শব্দের তথ্যগুলো ঠিকমতো পড়তে পারে না মস্তিষ্ক।

অডিটরি নিউরোপ্যাথি

কান থেকে ব্রেনে শব্দ পৌঁছে দেওয়ার কাজে নিযুক্ত স্নায়ু (ককলিয়ার নার্ভ) সক্ষমতা হারালে।

সাধারণ কিছু রোগ

ডায়াবেটিস, থাইরয়েড, কিছু অটোইমিউন রোগের কারণে শুনানি কমার হার বেশি দেখা যায়।

প্রয়োজনে ব্যবহার করুন হিয়ারিং এইড

শ্রবণশক্তি দুর্বল হলে ব্যবহার করতে পারেন হিয়ারিং এইড। সব ধরনের হিয়ারিং এইডই কিছু নির্দিষ্ট যন্ত্রাংশ দিয়ে তৈরি, যার মাধ্যমে পরিবেশ থেকে সংগৃহীত শব্দের মাত্রা কানের প্রয়োজন অনুসারে বাড়ানো হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হিয়ারিং এইডগুলো ডিজিটাল হয়ে থাকে, যেগুলো সাধারণ বা রিচার্জেবল ব্যাটারির মাধ্যমে চালানো হয়। প্রতিটি হিয়ারিং এইডে ছোট একটি মাইক্রোফোন থাকে, যার মাধ্যমে পরিবেশ থেকে শব্দতরঙ্গ সংগৃহীত হয়। একটি অ্যামপ্লিফায়ার (শব্দ পরিবর্ধক) যুক্ত কম্পিউটার চিপ সংগৃহীত শব্দতরঙ্গকে একটি ডিজিটাল সংকেতে পরিবর্তিত করে। এটি শব্দকে অ্যানালিসিস এবং অ্যাডজাস্ট করে আপনার কানের কমে যাওয়া শুনানির মাত্রা ও পরিবেশ থেকে আসা শব্দের মাত্রা অনুযায়ী। এই পরিবর্ধিত সিগন্যাল আবার শব্দতরঙ্গে রূপান্তরিত হয়, যা স্পিকারের (অনেক সময় এটিকে রিসিভার বলা হয়) মাধ্যমে কানের ভেতর ডেলিভারি করা হয়। বেশি ছোট আকৃতির হিয়ারিং এইড অনেক সময় পর্যাপ্ত শব্দ উৎপাদন করতে পারে না।

হিয়ারিং এইড কেন ব্যবহার করবেন?

► আমরা অনেকেই হিয়ারিং এইড ব্যবহার করার ব্যাপারে অনীহা প্রকাশ করি বা লজ্জা বোধ করি এবং কিছু ক্ষেত্রে সামাজিকভাবে অপদস্থ হওয়ার নজির আছে, যা মোটেই কাম্য নয়। শ্রবণ আপনার অধিকার। চশমা ব্যবহারে যদি আমরা লজ্জিত না হই, তবে কেন হিয়ারিং এইড ব্যবহারে লজ্জা বোধ করব! এ ব্যাপারে সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে।

► শ্রবণক্ষমতা হ্রাসের প্রতিকার না করলে মানুষের ব্রেনের উদ্দীপনা কমতে থাকে। কোনো ব্যক্তি আস্তে আস্তে নিজেকে সামাজিক কর্মকাণ্ড থেকে দূরে রাখতে শুরু করেন এবং নিজেকে বিচ্ছিন্ন, দুর্বল ও একা মনে করেন, যা তাঁর মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি করে। এতে স্মৃতিশক্তি লোপ পেতে থাকে, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা হ্রাস পায়। একসময় নিজেকে নিজের ও সমাজের কাছে বোঝা মনে হতে থাকে।

► শ্রবণক্ষমতা হ্রাসের প্রতিকার করতে পারলে মানুষের যোগাযোগের দক্ষতা বৃদ্ধি পায়, বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ সহজতর হয়, যা তার ব্রেনকে সক্রিয় রাখে এবং মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির ঝুঁকিকে হ্রাস করে।

হিয়ারিং এইড ব্যবহারের সফলতা নির্ভর করবে আপনি এটি নিয়মিত নির্দেশমতো ব্যবহার করছেন কি না, মেশিনের যত্ন ঠিকমতো নিতে পারছেন কি না এবং আমরা সাধারণ মানুষ আপনার সঙ্গে মানবিক ও ধৈর্যশীল আচরণ করছি কি না তার ওপর।

এ ছাড়া আপনার অডিওলজিস্ট নিয়মিত নতুন আসা হিয়ারিং এইড সম্পর্কে ধারণা প্রদান করবেন, যাতে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আপনি আরো উন্নত প্রযুক্তি নিতে পারেন। সূত্র: কালের কণ্ঠ