কর্মজীবী নারী গ্রামেই বাড়ছে বেশি

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। বিশেষ করে শহরের চাইতে গ্রামে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। ১৫ বছর আগেও যেখানে শহরে কর্মজীবী নারীর অংশগ্রহণ বেশি ছিল এখন তা পুরোপুরি উলটে গেছে। শহরের মেয়েদের পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছেন গ্রামের মেয়েরা। নারীরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার কারণে তাদের সামাজিক ও পারিবারিক গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে ও অর্থনৈতিক-ভাবে পরিবারের ওপর তাদের নির্ভরশীলতা কমেছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৫-১৬ সালের পরিসংখ্যানে জানা যায়, বিভাগীয় পর্যায়ে রাজশাহী, খুলনা ও রংপুরের শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ সবচেয়ে বেশি হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। রংপুরে এ হার ৪১ দশমিক ৫ শতাংশ। এ প্রসঙ্গে নারী নেত্রীরা বলছেন, গ্রামে কাজে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি অবশ্যই ইতিবাচক। তা নারীর ক্ষমতায়নে প্রভাব ফেলবে। নারীর অনানুষ্ঠানিক কাজের অর্থনৈতিক মূল্যায়ন করা দরকার। কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গ সংবেদনশীল পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। এসব কিছুর চাইতে সবচেয়ে বেশি জরুরি কর্মক্ষেত্রে, পথে-ঘাটে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। নারীরা ঘরের গণ্ডি পেরিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসছেন ঠিক তবে এটাও ঠিক পথ চলতি কর্মজীবী মেয়েদের পথে-ঘাট থেকে তুলে নিয়ে ধর্ষণের মাত্রাও বেড়েছে। এই নিরাপত্তা দিতে হবে রাষ্ট্রকে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশের কর্মক্ষেত্র অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত থেকে প্রাতিষ্ঠানিক খাত বৃদ্ধির ক্ষেত্রে মধ্যবর্তী পর্যায় পার হচ্ছে। যদি আমরা প্রাতিষ্ঠানিক খাতে দক্ষ কর্মীর চাকরির ক্ষেত্র বাড়াতে না পারি, যদি প্রতিষ্ঠানিক খাতকে তৃণমূল পর্যায়ে নিয়ে যেতে না পারি, তবে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতেই সীমাবদ্ধ রয়ে যাবে আমাদের চাকরির বাজার। আর সর্বত্র নারীর শুধু অংশগ্রহণ বাড়ালে চলবে না, তার গুণগত উন্নয়ন জরুরি। কোনো দেশের উন্নয়নের জন্য নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন গুরুত্বপূর্ণ। নারীকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে।

খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার উত্তর ডুমুরিয়া গ্রামের ৩০ বছর বয়সের মারিয়া আফরিন পায়েলের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল এইচএসসি পাস করার পরেই। দুটি বাচ্চাও হয়েছে। শুধু সংসারে রান্না আর বাচ্চা মানুষ করার গণ্ডি থেকে বেরিয়ে তিনি অধিদপ্তরের আওতায় ব্লক, বাটিকের ট্রেনিং করেছেন। ট্রেনিং শেষ করেই তিনি মাসে ব্লক বাটিকের পোশাক বিক্রি করে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা আয় করছেন। পরিচিতি বাড়লে আরো আয় বাড়বে বলে আশা মারিয়ার।

রংপুরের গাইবান্ধার বাসিন্দা সুরাইয়া সূচিকর্ম করে পরিবারের ভরণপোষণে অবদান রাখছেন। সাভারের ষোলমাসী গ্রামের হাফিজা বেগমের তিনটি গরু। ৪০ বছর বয়সি হাফিজা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে গরু কিনেছেন। এমনিভাবে ঘরের গৃহিণীরা ঘর চৌহদ্দি থেকে বেরিয়ে কর্মক্ষেত্রে অংশ নিচ্ছেন।

বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলে, শহরের চেয়ে গ্রামে নারী কর্মজীবীর সংখ্যা বেশি। নিজ পরিবারেও ফসল উত্পাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে নারীর শ্রম পুরুষের তুলনায় বেশি। গ্রামে শতকরা ৩৮ দশমিক ৬ শতাংশ শ্রমজীবী হিসেবে রয়েছে। শহরে কমে হয়েছে ৩১ শতাংশ। শ্রমশক্তি জরিপ ২০১০ অনুযায়ী, শহর ও গ্রাম মিলিয়ে শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ ছিল ৩৬ শতাংশ ,২০০৫ সালে যা ছিল ২৯ শতাংশ। সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) বলছে, ১৯৯৫-৯৬ সালে শ্রমে নারীর অবস্থান ছিল শহরে ২০ দশমিক ৫ শতাংশ, গ্রামে ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০০৩ সাল পর্যন্ত শহরে এ হার বেশি ছিল।

দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে প্রায় ৫ কোটি ৪১ লাখ কর্মজীবী মানুষের মধ্যে ১ কোটি ৬২ লাখ নারী। প্রায় ১৬ হাজার ৭০০ নারী ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তা রয়েছেন। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের ৮০ শতাংশের বেশি নারী। সুতরাং বাংলাদেশ নারীর উন্নয়ন ও অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে অনেক দূর এগিয়েছে, কিন্তু পথটা অনেক লম্বা। আমাদের আরো অনেক দূর যেতে হবে।

সামগ্রিকভাবেই কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ আগের তুলনায় বেড়েছে। বিশেষ করে গ্রামের নারীদের কাজের ক্ষেত্র বেড়ে গেছে। আগে যেটা শুধুই পুরুষের কাজ বলে বিবেচিত হতো সেসব কাজেও নারীরা পুরুষের পাশাপাশি সমানতালে অংশ নিচ্ছেন। গ্রামের নারীরা বাড়ির নিকটবর্তী পুকুর, ধানক্ষেত ও বড় পুকুরে খাঁচায় অনায়াসেই মাছ চাষ করছেন। কয়েক বছর যাবত্ নারী শুধু গার্মেন্টস সেক্টর নয়, কৃষিখাত, সূচিশিল্প, মত্স্যচাষ ও চিংড়ি রপ্তানির কাজেও তাদের সম্পৃক্ততা বাড়িয়েছেন।

গ্রামে জনশক্তিতে যুক্ত নারীদের ৬০ শতাংশই শ্রম দিচ্ছেন কৃষিতে। আর শহরে গার্মেন্টসে। পোশাক শিল্পে নারী শ্রমিকের অংশগ্রহণ ছিল ৬৪ শতাংশ এখন তা কমে ৬০ দশমিক ৮ শতাংশ। ব্যুরো আরো জানায়, সবশেষে ২০১৫ -২০১৭ সালে গ্রামে নারীর কাজের হার বেড়েছে। গ্রামে ৩৮ দশমিক ৬ শতাংশ শ্রমজীবী হিসেবে রয়েছেন। শহরে কমে হয়েছে ৩১ শতাংশ।

বাংলাদেশ উন্নয়ন সংস্থা জানায়, ৯০ শতাংশের বেশি ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহণকারী হচ্ছেন নারী। ঋণের টাকায় ফসল উত্পাদন, পশুর খামার ও হাঁস-মুরগি পালন করছেন। খামারে যুক্ত আছেন ৯ দশমিক ৫ শতাংশ। ফসল উত্পাদনে ৪২ দশমিক ৩ শতাংশ। খুলনায় রপ্তানিমুখী চিংড়ি খাতেও নারী শ্রমিকের অংশগ্রহণ বাড়ছে।

মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, গ্রামের অংশগ্রহণ বাড়ছে এটা যেমন খুশির বিষয় তেমনি শহরের অংশগ্রহণ কমাটা কোনো ভালো লক্ষণ নয়। মেয়েরা সমস্ত ধরনের ট্যাবু ভেঙে বাইরে বেরিয়ে আসছেন। উদ্যোক্তা হিসেবে আসছেন, অবদান রাখছেন কৃষি, মত্স্য চাষের মতো কাজেও। গ্রাম ছেড়ে ছেলেরা শহরমুখী কিংবা বিদেশে চলে যাচ্ছেন। কর্মক্ষেত্রে ছেলেদের সেই শূন্যস্থানটা পূরণ করছেন মেয়েরা। কাজের ক্ষেত্রে নারীদের মান বাড়াতে আমাদের প্রশিক্ষণ, কর্মপরিবেশের নিরাপত্তা দিতে হবে। অপরদিকে, শহরের মেয়েদের পিছিয়ে পড়ার সবচেয়ে বড়ো কারণ এই কর্মপরিবেশ। মেয়েরা লেখাপড়ায় অংশ নিচ্ছেন কিন্তু চাকরি ক্ষেত্রে ড্রপআউটের সংখ্যা বাড়ছে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশ  বলেন, দেশে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে মেয়েদের কাজের ক্ষেত্র বাড়ছে। প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজের চাহিদা কমছে। তাই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মীদের ভিড় বাড়ছে। প্রতিষ্ঠানিক খাতেও শিক্ষা ও গার্মেন্টস খাতে কম বেতনের কর্মীর কাজের চাহিদা বাড়ছে। শহরেও প্রাতিষ্ঠাানিক ক্ষেত্রে যে নারীরা অংশ নিচ্ছেন বিশেষত গার্মেন্ট খাত, সেখানেও মূল শক্তি গ্রাম থেকে আসা নারীরাই। গ্রামাঞ্চলে এনজিওর বিস্তৃতির ফলে মেয়েদের বাইরে বের হয়ে আসার বাধাটা কেটে গেছে। ফলে গ্রামের নারীরা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত যমন কৃষি, মত্স্য চাষ প্রভৃতি ক্ষেত্রে কাজে যুক্ত হচ্ছেন। প্রাতিষ্ঠানিক খাতে তা হচ্ছে না। খুব দক্ষ না হলে নারীর কাজের ক্ষেত্র প্রাতিষ্ঠানিক খাতে সংকুচিত।