করোনা কি বায়ুবাহিত? ছড়াচ্ছে আতঙ্ক, চিকিৎসকদের পরামর্শ মেনে কী করবেন

রোজই বাড়ছে কোভিড-১৯ আক্রান্তের সংখ্যা, নতুন করে আক্রান্ত অঞ্চলে শুরু হয়েছে লকডাউন। এরই মধ্যে বিশ্বের কিছু সেরা চিকিৎসা গবেষণা কেন্দ্রের এরোসল বিজ্ঞানীদের গবেষণায় উঠে এল আরও এক ভয়ানক তথ্য। তাঁদের আশঙ্কা, বিশ্ব জুড়ে ত্রাস সৃষ্টিকারী কোভিড-১৯ ভাইরাস বাতাসে ভেসে সংক্রমণ ছড়িয়ে দিতে পারে অনেক দূর পর্যন্ত। ভার্জিনিয়ার এরোসল বিশেষজ্ঞ লিন্ডসে মার-সহ ২০০ জনেরও বেশি বিজ্ঞানী এই মর্মে এক খোলা চিঠি লিখেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) প্রধানকে।

বিজ্ঞানীদের এই গবেষণার মূল উদ্দেশ্য বিশ্ব মহামারি ছড়িয়ে পড়া প্রতিরোধে নতুন স্ট্র্যাটেজি তৈরি করা। কিন্তু তা হলে এত দিন ধরে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এবং হু যে সব নিয়ম জারি করেছেন তা কি সঠিক নয়? প্রশ্ন তুললেন সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অমিতাভ নন্দী। ড্রপলেট সংক্রমণ বাতাস দিয়েই ছড়িয়েপড়ে। করোনা সংক্রমণের শুরু থেকেই এই কথা বলে আসছেন অমিতাভবাবু। হাঁচি,কাশি বা কথা বলার সময় যে ড্রপলেট নিঃসৃত হয় তা বাতাসে ভেসে কিছু দূর পর্যন্ত যায় এ কিন্তু কোনও নতুন কথা নয়। ড্রপলেট হল মানুষের মুখ বা শ্বাস নিঃসৃত স্যালাইভা  যার মধ্যে নানান ব্যাক্টেরিয়া, ভাইরাস বা ফাঙ্গাস থাকে। খালি চোখে এই ড্রপলেট দেখা যায় না। কোভিড-১৯ ভাইরাস আক্রান্তদের শ্বাসপ্রশ্বাস, কথা বলা বা হাঁচি-কাশির মাধ্যমে এই অদৃশ্য ড্রপলেট বাতাসে মিশে যায়। সুস্থ মানুষের শ্বাসের সঙ্গে জীবাণুরা শ্বাসনালীতে প্রবেশ করলে তিনিও অসুস্থ হয়ে পড়েন।
চিনের উহানে নভেল করোনাভাইরাস সম্পর্কে জানার সময় থেকেই এই ড্রপলেটের মাধ্যমে অসুখ ছড়িয়ে পড়ার কথা বলা হয়। তবে তিন ফুট বা ছয় ফুটের কথা বলে মানুষকে সঠিক তথ্য জানানোর ব্যাপারে কিছু ত্রুটি আছে বলে মনে করেন অমিতাভবাবু। কেননা ড্রপলেট কত দূর বাতাসে ভেসে যেতে পারে বা কত ক্ষণ বেঁচে থাকে সে বিষয়টি নিয়ে আরও গবেষণা করে স্ট্র্যাটেজি ঠিক করা উচিত ছিল। তখন থেকেই সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অমিতাভবাবু মানুষে মানুষে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রাখার পরামর্শ দেন।

এয়ার বোর্ন ভাইরাস ঠিক কী

বাতাসে ভেসে বেড়ানো কোনও ভাইরাস যদি কোনও ভাবে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে রোগ সৃষ্টি করতে পারে তাকে এয়ার বোর্ন ভাইরাস বলা যায়। এইচআইভি ভাইরাস এই পর্যায়ে পড়ে না। কিন্তু হাম, অর্থাৎ মিসল ভাইরাস এয়ার বোর্ন। কেননা এই জীবাণুরা প্রায় ২ ঘণ্টা বাতাসে ভেসে বেড়াতে পারে। অন্য দিকে, কোভিড-১৯ আরএনএ ভাইরাস যে বাতাসে ভেসে বেশি দূর যেতে পারে না সে বিষয়ে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত। কিন্তু তাঁরা প্রমাণ পেয়েছেন, অতিমারি সৃষ্টিকারী ভাইরাস বাতাসে প্রায় তিন ঘণ্টা সক্রিয় থাকে। আর এই তথ্যই ভাঁজ ফেলেছে এরোসল বিজ্ঞানীদের কপালে। সেই কারণেই চিকিৎসকেরা নভেল করোনা রুখতে নতুন স্ট্র্যাটেজি তৈরির কথা চিন্তা করছেন।

এরোসল আর ড্রপলেট তফাৎ শুধু আকারে

বাতাস বাহিত হয়ে করোনা ছড়িয়ে পড়ার ব্যাপারে এরোসল আর ড্রপলেটের প্রসঙ্গ নিয়ে বিতর্ক চলছে। আসলে দু’টি একই বস্তু, এপিথেলিয়াল কোষে ভেসে বেড়ানো জীবাণু। ড্রপলেটের আকৃতি এরোসলের থেকে বড়, তাই এর সংক্রমণ ক্ষমতা তুলনামূলক ভাবে বেশি। তবে ড্রপলেট আকারে বড় বলে সংক্রমিত মানুষের হাঁচি-কাশি বা কথা বলার সঙ্গে দ্রুত নীচের দিকে নেমে যায়। আর এই কারণেই মহামারির শুরুতে মানুষে মানুষে ৬ ফুট দূরত্ব বজায় রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। বিজ্ঞানীরা জেনেছেন, সংক্রমিত মানুষের উপসর্গ না থাকলে এবং হাঁচি-কাশি ছাড়াও তিনি রোগ ছড়াতে পারেন। বদ্ধ ঘরে বা এয়ার কন্ডিশনড ঘরে
কোনও উপসর্গহীন রোগী থাকলে তাঁর মারফৎ অন্যদের সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি। সত্যি কথা বলতে কি ড্রপলেট বাহিত আর এরোসল বাহিত এই দুটির বিশেষ তফাৎ নেই বলে মনে করেন অমিতাভ নন্দী। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, রাস্তায় কোনও কোভিড আক্রান্ত মানুষের যদি হাঁচি কাশি হয় এবং রাস্তার অন্যপ্রান্তে থাকা মানুষটি যদি তাঁর থেকে সংক্রমিত হন তাহলে কখনওই ফুট বা ইঞ্চি দিয়ে ভাইরাসের এরোসল বা ড্রপলেটে ভেসে বেড়ানোর ব্যাপারটা বেঁধেদেওয়া ঠিক নয়। বদ্ধ রেস্তরাঁয় গিয়ে এই ভাবেই চিনের একটি পরিবারের সদস্যরা কোভিড আক্রান্ত হয়েছিলেন। তবে হাওয়ায় নভেল করোনাভাইরাস উড়ে বেড়াচ্ছে এমন কোনও প্রমাণ আমাদের হাতে নেই’’, বললেন মেডিসিনের চিকিৎসক সুকুমার মুখোপাধ্যায়।

তা হলে কোভিড এড়াতে কী কী ব্যবস্থা নিতে হবে

প্রতি দিনই কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। তাই বিশেষ কাজ না থাকলে বাড়ি থেকে বেরোন একেবারেই অনুচিত, বললেন সুকুমার মুখোপাধ্যায়। শহর ও মফসসল অঞ্চলে ক্লাস্টার ট্রান্সমিশন প্রতিরোধ করতে সংক্রমিত অঞ্চলে পুনরায় লকডাউন চালু করা হয়েছে। কঠোর ভাবে লকডাউন মেনে চললে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন বা গোষ্ঠী সংক্রমণ প্রতিরোধ করা যাবে বলে ভরসা দিলেন সুকুমারবাবু।

নভেল করোনা প্রতিরোধ করতে অমিতাভ নন্দী এবং সুকুমার মুখোপাধ্যায় দু’জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ—

• মাস্ক ছাড়া বাড়ির বাইরে যাওয়া একেবারেই অনুচিত। নাক-মুখ ঢেকে মাস্ক পরতে হবে। কাপড়ের তিন লেয়ার মাস্কই যথেষ্ট। স্বাস্থ্যকর্মীদের এন –৯৫ মাস্ক বাধ্যতামূলক। বাড়িতে কাছের মানু্ষদের সঙ্গে থাকলে মাস্ক পরার দরকার নেই। তবে বাড়ির কোনও মানুষের সংক্রমণ হলে সকলেরই উচিৎ মাস্ক পরা ও অন্যদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখা।

• নিয়মিত মাস্ক পরিষ্কার করা উচিত।

• শপিং মল, বাজার, দোকান বা সুপার মার্কেটে না যাওয়াই ভাল।

• বদ্ধ ঘরে থাকবেন না। অফিসে গেলে যথাযথ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা মেনে চলার দিকে খেয়াল রাখতে হবে। অফিসে এয়ার পিউরিফায়ার  এবং ভাইরোলজিক্যাল  ফিল্টার থাকলে ভাল হয়।

• টি জোন, অর্থাৎ চোখ, নাক ও মুখে হাত দেবেন না। হাত দেওয়ার দরকার পড়লে স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করে নিতে হবে। কিংবা সাবান
দিয়ে ভাল করে ২০ সেকেন্ড ধরে রগড়ে হাত পরিষ্কার করে ধুয়ে নিন।

• পাবলিক টয়লেটের বদ্ধ বাতাসে এরোসলে ভাইরাস থাকার ঝুঁকি খুব  বেশি। তাই ব্যবহার করবেন না।

• বাড়ির জানলা-দরজা খোলা রেখে বাতাস চলাচল করতে দিন।

• মিটিং, মিছিল বা জমায়েতে এরোসল থেকে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা খুব বেশি। এই সব জমায়েত নিষিদ্ধ করা দরকার।

• নিজেরা সচেতন না হলে দুর্ভোগ হবে নিজের ও পরিবারের মানুষদের, সুতরাং ফাঁকি না দিয়ে যথাযথ নিয়ম পালন করে কোভিডের মহামারি রুখুন।

 

সূত্র: আনন্দবাজার