করোনায় থেমে নেই পদ্মা সেতুর কাজ, আজ বসছে ২৯তম স্প্যান

করোনা আর ঝড়ো আবহাওয়ার মধ্যেও থেমে নেই পদ্মা সেতুই কাজ। এই রোদ, এই ঝড়-বৃষ্টি, এরিমধ্যে এগিয়ে চলছে বিশাল এই কর্মযজ্ঞ। আজ সোমবার বসতে যাচ্ছে সেতুর ২৯ তম স্প্যান (আইডি-৪এ)। আবহাওয়াসহ সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে মাওয়া প্রান্তের সেতুর ১৯ ও ২০তম পিলারের উপর বসবে এ স্প্যানটি।

গতকাল রবিবার সকাল ৮টার দিকে স্প্যানটিকে মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের মাওয়ার কাছে কুমারভোগ কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড থেকে ভাসমান ক্রেনে করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ১৯ ও ২০ নং পিলারের নিকট। আজ সকাল থেকে স্প্যানটিকে পিলারের উপর বসানোর কাজ শুরু হবে। আর এটি সফল ভাবে বসে গেলে দৃশ্যমান হবে পদ্মা সেতুর ৪ হাজার ৩ শ’ ৫০ মিটার। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন পদ্মা সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান মো. আব্দুল কাদের।

সেতুর দুই প্রান্তে আইসলিশন সেন্টার

এদিকে করোনা মোকবেলায় পদ্মা বহু সেতু প্রকল্পও পিছিয়ে নেই। পুরো প্রকল্প আইসোলেটেট রেখে দেশী-বিদেশী কর্মীরা হরদম কাজ করে যাচ্ছে। তারপরও যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য প্রস্তুতি রাখা হয়েছে। পদ্মা সেতুর দুপ্রান্তের দুই সার্ভিস এরিয়ায় ১২ বেড করে ২৪ বেডের দুটি আইসোলেশন সেন্টার চালু করা হয়েছে। মাওয়া প্রান্তের দোগাছিস্থ সার্ভিস এরিয়া-১ এবং ওপারের জাজিরা প্রান্তের সার্ভিস এরিয়া-২ এ এই আইসোলেশন সেন্টার করা হয়েছে।

দায়িত্বশীল প্রকৌশলী জানান, দু’পারে আইসোলেশন সেন্টারেই দু’জন করে চিকিৎসক এবং দু’জন করে নার্সসহ প্রয়োজনীয় সব জনবল নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তবে আল্লাহ’র রহমতে এখন কারও এই আইসোলেশনে আসতে হয়নি। কোন কর্মীর নূন্যতম উপসর্গ দেখা দিলেই এই আইসোলেশনে সেন্টারে নিয়ে আসা হবে। এর পর সোয়াব পরীক্ষা করা হবে। রিপোর্ট পজেটিভ আসলে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

দায়িত্বশীল প্রকৌশলী আরো জানান, এছাড়াও পদ্মা সেতু প্রকল্পের আওতায় মুন্সীগঞ্জ ও শরীয়তপুর জেলার সিভিল সার্জনদের সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা ইচ্ছা প্রকাশ করলে পদ্মা সেতু প্রকল্পের আওতায় একটি করে আইসিইউ বেড স্থাপন করে দেয়া হবে। একটি ভেন্টিলেশন বেড স্থাপনের ব্যাপারেও আগ্রহ রয়েছে সেতু কর্তৃপক্ষের। তবে এসব যন্ত্রপাতি প্রয়োজনে চীন থেকে নিয়ে আসার ব্যাপারেও সহযোগিতা থাকবে বলে তিনি জানান। একই সঙ্গে পদ্মা সেতুর পুনর্বাসন প্রকল্পে স্থাপিত ৫টি স্বাস্থ্য কেন্দ্রেও সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে। মুন্সীগঞ্জ প্রান্তে দুটি এবং জাজিরা প্রান্তে তিনটি এই পাঁচটি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে এমবিবিএস চিকিৎসকের নেতৃত্বে অন্য স্বাস্থ্য কর্মীরা ছুটির দিনও পিপিই পরিধান করে পুনর্বাসন প্রকল্পের লোকজন ছাড়াও সকলের জন্য এই স্বাস্থ্যকেন্দ্র উন্মুক্ত রয়েছে। চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি বিনামূল্যে যথা সম্ভব প্রয়োজনীয় ওষুধও দেয়া হচ্ছে। আগে প্রতি মাসে প্রতিটি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ১০ হাজার টাকার জরুরী ওষুধ বিনামূল্যে দেয়া হতো। এখন প্রতি মাসে ১৫ হাজার টাকার জরুরী ওষুধ দেয়া হচ্ছে। করোনা কারণে বিভিন্ন চিকিৎসালয়ে যেখানে স্বাভাবিক চিকিৎসা সেবা বিঘিœত হচ্ছে, আর এখানে স্বাস্থ্য স্বাভাবিক চলছে বলে জানান দায়িত্বশীল প্রকৌশলী।

স্প্যানের সর্বশেষ চালান

চীন থেকে স্প্যানের একটি বড় চালান এখন বাংলাদেশে এসে পৌছেছে। এটি এখন মোংলায় রয়েছে। ২-১ দিনের মধ্যে এটি মাওয়ায় পৌছে যাবে। এই চালানটির জন্য দীর্ঘ প্রতীক্ষা চলছিল। ২৭ মার্চ চালানটি সমুদ্র পথে রওনা হয়। সেতুর ৪১টি স্প্যানের ৩৯টি স্প্যানই মাওয়ায় পৌঁছেছে অনেক আগে। কিন্তু বাকি থাকা ২টি স্প্যান নিয়েই নানা শঙ্কা তৈরি হয়। কারণ প্রথম চীনে করোনার শুরু হওয়ায় এই স্প্যান দুটি নিয়ে দায়িত্বশীলরা ভাবনায় পড়েন। পরবর্তীতে চীনের করোনা সঙ্কট কেটে যাওয়ার পর স্প্যান দুটির ফিনিশিং কাজ শেষ করে বড় এই চালানটি রওনা হয়। সর্বশেষ স্প্যান দুটি ২৩০ খন্ডে বিভক্ত। এর মধ্যে ২৭ মার্চ রওনা হওয়া বড় চালানটিতে ১৯৩টি খন্ড রয়েছে। বাকি ৩৭টি খন্ড নিয়ে আরেকটি ছোট চালান রওনা হচ্ছে ৫ মে। এটিই স্প্যানের সর্বশেষ চালান। এর মধ্য দিয়েই চীনে তৈরি করা সেতুর স্টিলের তৈরি স্টাকচার (স্প্যান) আসা শেষ হচ্ছে। সেতুর এই স্প্যান তথা স্টাকচারের প্রতিটি ১৫০ মিটার দীর্ঘ। ৪১টি স্প্যানের ২৮টি খুঁটিতে স্থাপনও হয়ে গেছে। এতে সেতুর বড় অংশ অর্থাৎ ৪.২০ কিলোমিটার এখন দৃশ্যমান হয়েছে। আজ ২৯তম স্প্যান বসে গেলে দৃশ্যমান হবে ৪৩৫০ মিটার বা ৪.৩৫কিলোমিটার।
আগস্টে সব স্প্যান বসানোর চেষ্টা

২৯তম স্প্যাটি বসে গেলে বাকী থাকবে মাত্র ১২টি স্প্যান। সংশোধিত সিডিউল অনুযায়ী আগামী নবেম্বরের মধ্যে সব স্প্যান খুঁটিতে বসে যাওয়ার কথা আছে। তবে দায়িত্বশীল প্রকৌশলীরা মনে করছেন নির্ধারিত সময়ের আগেই আগস্টের মধ্যে খুঁটির ওপর সব স্প্যান বসে যাবে। দ্বিতল সেতুর ওপরে থাকবে সড়কপথ আর নিচে থাকবে রেলপথ। যা এখন ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে।

নির্বাহী প্রকৌশলী (মূল সেতু) দেওয়ান মো. আব্দুল কাদের জানান, পুরো প্রকল্পটিই আইসোলেটেট। তাই এখানকার দেশী বিদেশী কর্মীরা অনেকটাই নিরাপদ। তাই এখানে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থা করে কাজ করতে সমস্যা হচ্ছে না। বাইরের কাউকেই এখানে এখন প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। ভেতরে করোনার স্বাস্থ্যবিধি সবই মেনে চলা হচ্ছে।

তিনি আরো জানান, ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে সেতুটি দ্বিতল হবে, যার ওপর দিয়ে সড়কপথ ও নিচের অংশে থাকবে রেলপথ। সেতুর এক খুঁটি থেকে আরেক খুঁটির দূরত্ব প্রায় ১৫০ মিটার। একেকটি খুঁটি ৫০ হাজার টন লোড নিতে সক্ষম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসিকতায় নিজস্ব অর্থায়নে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। মূলসেতু নির্মাণের জন্য কাজ করছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি) ও নদীশাসনের কাজ করছে চীনের ‘সিনো হাইড্রো করপোরেশন’।

 

সুত্রঃ কালের কণ্ঠ