করোনার পর যুদ্ধের খড়গ কী সামলাতে পারবে বিশ্ববাসী?

দুই বছর ধরে প্রাণঘাতী করোনার সঙ্গে লড়াই করে আসছে বিশ্ববাসী। অদৃশ্য শত্রুর দাপট কমতে না কমতেই বেজে উঠেছে সত্যিকারের যুদ্ধের দামামা। সম্প্রতি শুরু হওয়া এই লড়াইয়ে সরাসরি ইউক্রেন-রাশিয়া জড়ালেও পরোক্ষভাবে সারাবিশ্বই এরই মধ্যে বইতে শুরু করছে এর জের।

করোনার কারণে ধুঁকতে থাকা বৈশ্বিক অর্থনীতি বৈরিভাব কাটিয়ে ওঠার আগেই সম্প্রতি শুরু হওয়া যুদ্ধের প্রভাবে বড়ো ধরনের ধাক্কা খেয়েছে। বিশ্ববাজারে বেড়ে গেছে তেল-গ্যাস-স্বর্ণের দাম।

তেলের দামের রেকর্ড বৃদ্ধি
ইউক্রেনে রুশ হামলার পর বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ১১৫ ডলারের বেশি বেড়ে গেছে। তেলের দামের এই বৃদ্ধি গত সাতবছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। রাশিয়া বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী দেশ। তাই স্বাভাবিক ভাবেই রাশিয়া-ইউক্রেন অস্থিরতার প্রভাব লেগেছে তেলের বাজারেও। এমনকি বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ১১৫ ডলারের বেশি বেড়ে যাওয়ার পর সৌদি আরবও বাড়াচ্ছে তেলের দাম।

এই যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে বাড়তি তেলের দামের প্রভাব পড়বে দৈনন্দিন জীবনেও। তেলের দামের প্রভাবে বাড়বে পরিবহণ খরচ। সেই বাড়তি খরচ যাবে ভোক্তাদের পকেট থেকেই। কৃষি পণ্য পরিবহণ খরচ বাড়ার কারণে খাদ্যের বাড়তি দামও মেটাতে হবে ভোক্তাকেই।

বেড়েছে গ্যাসের দামও
তেলের পাশাপাশি বেড়েছে গ্যাসের দামও। বিশ্বের সবচেয়ে বড় গ্যাসের সরবরাহকারী দেশ রাশিয়া। রাশিয়ার গ্যাসের ৪০ শতাংশ ক্রেতা ইউরোপের বিভিন্ন দেশ। ইউক্রেনের রুশ অভিযান শুরুর পর যুক্তরাষ্ট্রে গ্যাসের দাম রেকর্ড পরিমানে বেড়ে গেছে। ২০০৫ সালে ঘূর্ণিঝড় ক্যাটরিনা আঘাত হানার পর দেশটিতে এই প্রথম গ্যাসের দাম এতো বাড়ল।

প্রভাব পড়বে বিদ্যুৎ খাতেও 
তেল আর গ্যাসের দাম বাড়লে অবধারিতভাবেই বাড়বে বিদ্যুতের দাম। কারণ বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত জীবাশ্ম জ্বালানির বড় উৎসই তেল ও গ্যাস। তাই তেল-গ্যাসের দাম বাড়ার প্রভাব পড়বে বিদ্যুৎ খাতে। বেড়ে যাবে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ। আর বাড়তি খরচের বোঝা বইতে হবে সাধারণ মানুষকেই।

স্বর্ণের দাম আকাশ ছোঁয়া
তেল-গ্যাসের পাশাপাশি রাশিয়ার ইউক্রেন হামলার পর থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়েছে স্বর্ণের দাম। বিশ্ব বাজারে দাম বাড়ায় বাংলাদেশেও স্বর্ণের দাম রেকর্ড বেড়ে হয়েছে  ৭৮ হাজার ২৬৫ টাকা ভরি।

বাদ যাচ্ছে না খাদ্যদ্রব্যও
তবে সংকট কেবল তেল-গ্যাস কিংবা স্বর্ণ নয়, প্রভাব ফেলছে মানুষের বেঁচে থাকার অন্যতম অনুষঙ্গ খাদ্যদ্রব্যেও। রাশিয়া ও ইউক্রেন– দুই দেশই বিশ্বের অন্যতম খাদ্য উৎপাদক । বিশ্বের অন্তত ২৮ .৯ শতাংশ গম উৎপাদিত হয় ইউক্রেন-রাশিয়ায়। এরই মধ্যে গমের বাজারে  পড়েছে যুদ্ধের প্রভাব। যুদ্ধের কারণে  শিকাগো ফিউচার এক্সচেঞ্জে গমের দাম ১৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।

শুধু গমই নয়, সূর্যমুখী তেল উৎপাদনের ক্ষেত্রেও বিশ্বের শীর্ষ দেশ ইউক্রেন ও রাশিয়া।

এছাড়া ভুট্টা উৎপাদনেও এগিয়ে এই দুই দেশ।  তাই এই দুই দেশের সংঘাত যে বিশ্ব খাদ্য বাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

বিপাকে আমদানিকারকরা
যুদ্ধের কারণে পশ্চিমা দেশগুলো একের পর এক নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছে রাশিয়ার ওপর। সুইটফ গ্লোবাল ব্যাংকিং সিস্টেম থেকে বাদ পড়েছে রাশিয়া। নিরাপদে লেনদেনের মাধ্যম না পেয়ে তাই রাশিয়ার অনেক আন্তর্জাতিক ক্রেতাই পড়েছে বিপাকে।

এর আগে ইরানকে বাদ দেওয়া হয় সুইফট ব্যাংকিং সিস্টেম থেকে। এর ফলে দেশটির মোট বৈদেশিক বাণিজ্যের ৩০ শতাংশ কমে যায়। তাই সুইটফ গ্লোবাল ব্যাংকিং সিস্টেম থেকে বাদ পড়া রাশিয়ার অর্থনীতির ওপর নিসন্দেহে বড় ধরনের ধাক্কা।

মুদ্রাস্ফীতির লাগামহীন পাগলা ঘোড়া
করোনার কারণে মুদ্রাস্ফীতির ধকল সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা বিশ্ব। এরই মধ্যে নতুন করে এই সংঘাত মুদ্রাস্ফীতির পাগলা ঘোড়াকে লাগামহীন করে দেবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে এই বছর বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতি অন্তত ৩ শতাংশ বেড়ে যেতে পারে এবং ২০২৩ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ট্রিলিয়ন কমে যেতে পারে বলে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল রিসার্চ (এনআইইএসআর) সদ্য প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে।

 

সূত্রঃ যুগান্তর