করোনাকালেও শৃঙ্খলা ফিরছে না বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে

সরকারি সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্ত দেশের বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শৃঙ্খলা ফেরানো যাচ্ছে না। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট ব্ভিাগে থেকে বার বার নির্দেশনা দিলেও কোনও নির্দেশনাই মানছেন না এসব প্রতিষ্ঠানের প্রধানরা এবং পরিচালনা কমিটি। করোনাকালেও এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে অবৈধভাবে চলছে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ, অর্থিক দুর্নীতি, চিঠি জালিয়াতি ও এমপিও দেওয়ার ক্ষেত্রে অনিয়মসহ নানা বিশৃঙ্খলা। মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার শ্যামপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নিজামুল কাদিরের বিরুদ্ধে অভিযোগ— ওই প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন খাতের টাকা ব্যয়ের ক্ষেত্রে বিধি অনুসরণ করা হয়নি। আর  চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী মো. শাহ আলম শরিফের পরিবর্ততে শাহজাহান শরিফকে চাকরিতে রাখার অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় গত ২ মার্চ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বেতন-ভাতা স্থগিত করা হয়েছে।

ঢাকা শিক্ষা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, এমপিওভুক্ত রাজধানীর উত্তরা হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজে অধ্যক্ষ নিয়োগের সুযোগ না থাকলেও অধ্যক্ষ নিয়োগ করেছে কর্তৃপক্ষ। বিষয়টি নিয়ে  অভিযোগ ওঠার পর গত ১ জুলাই প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটিকে চিঠি দিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড।

প্রসঙ্গত, এমপিও নীতিমালা ও জনবল কাঠামো অনুযায়ী মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (স্কুল) প্রতিষ্ঠান প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন প্রধান শিক্ষক। কোনও স্কুল অ্যান্ড কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক (কলেজ) স্তর এমপিওভুক্ত না হলে প্রধান শিক্ষকই প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করবেন। অধ্যক্ষ নিয়োগ দেওয়া যাবে না।

কিন্তু উত্তরা হাই স্কুলে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি খুলে অধ্যক্ষ নিয়োগের প্রক্রিয়া নেওয়া হয় অনেক আগেই। বিষয়টি জানতে পেরে এমপিও নীতিমালার আলোকে ২০১৬ সালের ৪ সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ওই প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেওয়া হয় যে, অধ্যক্ষ নিয়োগ করা যাবে না। একইসঙ্গে যোগ্য প্রধান শিক্ষক নিয়োগের নির্দেশ দেয় মন্ত্রণালয়। কিন্তু তা আমলে নেয়নি কলেজ কর্তৃপক্ষ।

অবৈধভাবে অধ্যক্ষ নিয়োগের পর সর্বশেষ গত ১ জুলাই প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটির সভাপতিকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেয় ঢাকা শিক্ষা বোর্ড।

করোনার এই মহাদুর্যোগের মধ্যে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে উপাধ্যক্ষ নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হয়। উচ্চ মাধ্যমিক কলেজে উপাধ্যক্ষ নিয়োগের সুযোগ না থাকলেও কমিটিতে প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। গভর্নিং বডির সভাপিত বিষয়টির আইনগত  ভিত্তি আছে কিনা তা নিশ্চিত করতে বলেন অধ্যক্ষকে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের  অধ্যক্ষ ফওজিয়া রেওয়ান  বলেন, ‘কমিটিতে প্রস্তাব আনা হয়েছিল। কিন্তু জনবল কাঠামো অনুযায়ী নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ নেই।’

টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার সদরদীঘি কলেজে আবুল কাশেম ২০০৫ সালের ১৬ মার্চ থেকে কর্মরত আছেন। কিন্তু ওই কলেজের পক্ষ থেকে এমপিওভুক্তির জন্য তার বদলে মাজেদুর রহমানের নাম পাঠানো হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ পাওয়ার পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা ঢাকা অঞ্চলের উপ-পরিচালককে তদন্তের (কলেজ) নির্দেশ দিয়েছেন গত ১৭ জুন।

ঢাকার ন্যাশনাল ব্যাংক পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নিয়োগ এবং এমপিওভুক্তিতে বেআইনিভাবে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর।  ঢাকা অঞ্চলের পরিচালককে গত ২৪ জুন তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

ফরিদপুরের সদর উপজেলার চন্দ্রপাড়া সুলতানিয়া আলিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানার একজন প্রভাষককে বিধি ভঙ্গ করে অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অথচ বিধি অনুযায়ী কোনও প্রভাষক অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ পাওয়ার যোগ্য নন। অধ্যক্ষ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে ন্যূনতম সহকারী অধ্যাপক হতে হয়। গত ৪ জুলাই একজন সহকারী পরিচালককে বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর।

রাজধানীর কদমতলী এলাকার শ্যামপুর বহুমুখী হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতির সঙ্গে কমিটির সদস্যদের সমন্বয়হীনতার কারণে দীর্ঘদিন শিক্ষকরা বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না। করোনা সংকটের কারণে তদন্ত শেষ না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত গত ৫ মে গভর্নিং বডির কার্যক্রম স্থগিত করেছে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড। পাশাপাশি শিক্ষকদের বেতন বিলে জেলা শিক্ষা অফিসারকে স্বাক্ষর করে বেতন-ভাতা পরিশোধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা বোর্ড।

গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ভুরাট ঘাট এম ইউ বহুমুখী ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসার বহিষ্কৃত ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এবং আরও চার জন শিক্ষককের বেতন ‘স্টপ পেমেন্ট’ করা ছিল। এরপরও মন্ত্রণালয় ও মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদফতরের দুটি চিঠি জাল করে তাদের এমপিও ছাড় করানো হয়। বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ উঠলে জালিয়াতচক্রের বিরুদ্ধে গত ১৯ মার্চ আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। গাইবান্ধার জেলা প্রশাসককে মাদ্রাসা অধিদফতরের পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) মো. জিয়াউল আহসান স্বাক্ষরিত আদেশে ওই নির্দেশনা দেওয়া হয়।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা অধিদফতর ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ড করেনা পরিস্থিতিতেও প্রায় অর্ধ শতাধিক অভিযোগ নিয়ে তদন্ত করছে বলে জানা গেছে।

এ বিষয়ে  জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, ‘আমরা আইনের মধ্যে থেকে যতটা সম্ভব বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শৃঙ্খলা ফেরাতে চেষ্টা করছি। করোনাকালেও যতটা সম্ভব কাজ করে যাচ্ছি। যথাযথ ব্যবস্থাও নিচ্ছি।’

শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটির ক্ষমতা অপরিসীম। এটি  না কমালে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে শৃঙ্খলায় ফেরানো সম্ভব নয়। করোনার সময়েও মন্ত্রণালয়, অধিদফতর এবং শিক্ষা বোর্ডগুলো প্রায় অর্ধশতাধিক অভিযোগ তদন্তে কাজ করছে।

আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব-কমিটির সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মু. জিয়াউল হক বলেন, ‘প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটির প্রতিটি অনিয়মের বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছি।  প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটির নীতিমালা-বিধিবিধান পরিবর্তনের প্রস্তাব চলমান রয়েছে। শিক্ষা আইন বাস্তবায়ন হলেও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি কমে যাবে।’

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের পরিচালক (প্রশাসন ও কলেজ) অধ্যাপক শাহেদুল খবির চৌধুরী বলেন, ‘বিধি অনুযায়ী আমরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছি। তবে শিক্ষা আইন  হলে নিয়োগ, আর্থিক দুর্নীতিসহ অন্যান্য অনিয়ম কমে যাবে।’

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন